নির্বাচনে কে এলো না তা দেখার বিষয় নয়

image-713791-1693689145

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি বলেছেন, বাংলাদেশের প্রায় ১৫ বছরের উন্নয়ন ও অগ্রগতির একমাত্র গ্যারান্টার হচ্ছে সাংবিধানিক ধারা রক্ষা করা। সুতরাং এই ধারা রক্ষা করতে সরকার ও প্রশাসন যা যা করা দরকার, তাই করবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

তিনি আরও বলেন, সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী নির্বাচন অপরিহার্য। এই নির্বাচনে কে এলো, কে এলো না-তার ওপর ভিত্তি করে সাংবিধানিক ধারার মাপকাঠি নির্ণয় করা হবে না। এমনকি তার ওপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রের মাপকাঠিও বিবেচনা করা হবে না। বরং যারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়, তাদেরকে নির্বাচন বানচাল করার প্রচেষ্টার মাপকাঠিতে বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি।

সম্প্রতি দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসানুল হক ইনু এসব কথা বলেন।

দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এই নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলের অংশ নেওয়া-না-নেওয়া, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রায় ১৫ বছরের শাসনামলের সফলতা-ব্যর্থতা, ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে থাকা মতবিরোধ, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের নানা তৎপরতা, নোবেলজয়ী ড. ইউনূস প্রসঙ্গসহ বিভিন্ন ইস্যুতে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।

হাসানুল হক ইনু বলেন, যে কোনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে অব্যাহত রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এটা আমারও পরিষ্কার কথা। কিন্তু নির্বাচন বানচালের যখন যুদ্ধ চলে, সেই যুদ্ধের ভেতরে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি সাংবিধানিক ধারা রক্ষা করার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পায়।

অতীতে নির্বাচন বানচাল করা এবং নির্বাচন বন্ধের যুদ্ধের ভেতরে সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনটা করতে হয়েছে। যারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়, যারা নির্বাচন বানচালকারীদের পক্ষে ওকালতি করেন; তাদের সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় বসা অর্থহীন।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষের বড় অভিযোগ হচ্ছে-তাদের প্রায় ১৫ বছরের শাসনামলে সিমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। খেলাপি ঋণ বেড়েছে, মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ বড় বড় ব্যবসায়ীকে নানাভাবে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

জোটের শরিক দল হিসাবে এর দায়ভার কতটা নেবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে জাসদ সভাপতি বলেন, প্রায় ১৫ বছরের শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশে উন্নয়ন এবং অগ্রগতির একটি চমৎকার ধারা তৈরি করেছে। এটা ঠিক, এই দীর্ঘ সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। খেলাপি ঋণ বেড়েছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। জোটের শরিক দলের নেতা হিসাবে সংসদে এবং সংসদের বাইরে আমরা এসব নিয়ে কথা বলেছি। এখনো বলছি।

হাসানুল হক ইনু বলেন, এটা ঠিক-দুর্নীতি, লুটপাট, দলবাজি, অর্থ পাচার আমাদের জন্য এটা একটা বড় সমস্যা। দুর্নীতি একটি ক্যানসার। এটা মোকাবিলা করা কঠিন কাজ। এগুলো উন্নয়নের ট্রেনকে এগিয়ে নিতে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে এটাও ঠিক-যাদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থ পাচারের অভিযোগ নানা সময়ে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে; তাদের অনেকেরই বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অনেক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতে তাদের বিচার হচ্ছে।

বড় ব্যবসায়ী হোক, আর ছোটই হোক-অনিয়মের জন্য তাদের জাবাবদিহি করতে হচ্ছে। অতীতের সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের পার্থক্য এখানেই, এমনকি তিনি এজন্য প্রশংসারও দাবি রাখেন। মিলিয়ে দেখেন-আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যতজন নানা অপরাধে জড়িয়ে জেলে আছেন; ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা অতীতে কখনো এতজন জেলে ছিল না।

তিনি বলেন, এতসব নেতিবাচক দিক এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা ১৪ দল দলগতভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে আছি, আগামী দিনেও থাকব। কারণ, ১৪ দলীয় জোট একটি আদর্শিক জোট। এই জোটের হাত ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাংবিধানিক ধারা এবং গণতান্ত্রিক ধারাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে এগিয়ে নিতে আমাদের একসঙ্গে থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। হত্যা-খুন ও গুমের রাজনীতির বিপক্ষে, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের অপরাজনীতির বিপক্ষে ১৪ দলীয় জোট অতীতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।

আগামী দিনে স্বনির্ভর অর্থনীতির স্বার্থে এই সরকারকেই এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমি ওকালতি করছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলমান ধারা বজায় রেখেই আমরা দুর্নীতি-দলবাজি মোকাবিলা করতে পারব। বিদেশে সম্পদ পাচার মোকাবিলা করতে পারব।

প্রশাসনসহ সর্বত্র দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে-এ প্রসঙ্গে হাসানুল হক ইনু বলেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অতীতেও নিয়োগ হয়েছে, এখনো হচ্ছে। বর্তমান সরকার এখানে নতুন করে কোনো আইন বা বিধিবিধান তৈরি করেনি। বলতে পারেন, ’৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি একই পদ্ধতিতে নিয়োগ হচ্ছে, পদোন্নতি হচ্ছে। এখানে কোনো হেরফের হয়নি।

বরং বলতে পারি, গত ১৫ বছরে যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাদের অনেকেই বিএনপির শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত। যারা সচিব হিসাবে কর্মরত রয়েছেন, তাদের অনেকেই চিহ্নিত বিএনপির লোক। তারা ছাত্রজীবনে বিএনপি কিংবা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। আমার কাছে এমন অভিযোগও রয়েছে, বর্তমান সরকারের আমলে অনেক বিএনপির লোক, ছাত্রদলের লোক, জামায়াত-শিবিরের লোক পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে জনপ্রশাসনের মাধ্যমে সরকারি চাকরি পেয়েছেন। নিয়োগ পেয়েছেন এবং তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। সুতরাং এ সরকারের বিরুদ্ধে দলবাজির অভিযোগটা সঠিক বলে মনে হচ্ছে না আমার কাছে।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে কি কোনো ক্ষোভ নেই-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ; আছে। জোট শরিকদের মধ্যে দেনা-পাওনা নিয়ে, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা আছে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে ক্ষোভ আছে। আরও নানা বিষয় নিয়ে ক্ষোভ আছে। এটা থাকবেই। কারণ, আমরাও ক্ষমতার ভাগীদার।

আগামী নির্বাচনে শরিক দলের আসনে ছাড় দিতে নারাজ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তারা কেউ কেউ শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনে প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণাও দিয়েছেন, এরকম হলে তখন কী করবেন-জবাবে জাসদ সভাপতি বলেন, যারা শেখ হাসিনার ঐক্যের নীতি পছন্দ করেন না, তারা এরকম কথাবার্তা বলছেন। নানারকম তৎপরতা চালাচ্ছেন।

এ ঘটনা ১৫ বছর ধরেই চলছে। এসব মোকাবিলা করেই রাজনীতি করছি। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা যে শুধু শরিকদের আসনেই এরকম করছেন, তা নয়-যেখানে তাদের দলের সংসদ-সদস্য রয়েছেন, সেখানেও তারা এসব করছেন। আসলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতার কারণে এই অপতৎপরতা চলছে। তবে ঐক্য রক্ষায় জোটের প্রধান নেতা হিসাবে শেখ হাসিনা সব সময়ই আন্তরিক।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ক্ষেত্র তৈরির জন্য আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা সরাসরি জাসদকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছেন। জাসদ সভাপতি হিসাবে আপনাকেও দায়ী করছেন তারা-এ প্রসঙ্গে হাসানুল হক ইনু বলেন, আওয়ামী লীগ একাটি বড় দল। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পেছনে জাসদকে জড়িয়ে আঙুল তুলছেন, তারা শেখ হাসিনার ঐক্যের নীতিকে আসলে ঠাট্টা করছেন। জাসদের প্রতি আঙুল তোলার ঘটনায় মনে হচ্ছে শেখ হাসিনার ঐক্যের রাজনীতিকে তারা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন।

শেখ হাসিনা বিষয়টি বিবেচনা করবেন এবং তিনি তার দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন। এ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন না। কারণ, শেখ হাসিনা সবকিছু জেনে-বুঝে বিবেচনায় নিয়ে, এমনকি বিচারবিশ্লেষণ করে জাসদসহ বাকি দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলীয় ঐক্য করেছেন। এ ঐক্য আজকের না, দীর্ঘদিনের ঐক্য। এই ঐক্যের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে।

আমি শুধু বলব, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এখনো খন্দকার মোশতাকের প্রেতাত্মা লুকিয়ে আছে। যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা হয়তো এখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুক, তা পছন্দ করেন না।

সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন করে, যার কিছু ধারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অবশেষে এটি বাতিল করে সাইবার সিকিউরিটি আইন করা হচ্ছে। এ নিয়েও সমালোচনা চলছে নানা মহলে। আপনার কি মনে হয়, আইনটি জনগণের স্বার্থেই করা হচ্ছে নাকি ভিন্নমত দমনে-এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই তথ্যমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল সমাজে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে এরকম আইনকানুন আছে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন দরকার, সাইবার সিকিউরিটি আইন দরকার। এটা মানতে হবে। যারা মানেন না, তাদের সঙ্গে বিতর্ক করে সময় নষ্ট করা সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি না। একটা কথা পরিষ্কার-সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাইবার সিকিউরিটি আইন তৈরি করা হয়নি। এটা করা হয়েছে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এখানে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে আলোচনা-পর্যালোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছানো যেতে পারে। কিন্তু আইনটি নিয়ে যেভাবে বিতর্ক চলছে, এতে মনে হচ্ছে-এর সঙ্গে রাজনৈতিক বিতর্ক জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তা আইনকে পুঁজি করে সরকার উৎখাতের খেলায় মত্ত কেউ কেউ।

হাসানুল হক ইনু বলেন, এ আইনের বিপক্ষে যারা, সেসব সমালোচনাকারীকে আমি সম্মান প্রদর্শন করে বলব-ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের ফর্মুলা হাজির করুক। কিন্তু তারা তা করছেন না। প্রচলিত আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না। তাই যদি হতো, আমেরিকা ইউরোপ এ ধরনের আইন করত না। তাদের যে প্রচলিত আইন আছে, তা দিয়েই কাজ হতো।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি বলেন, আমেরিকা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করে, প্রয়োগ করে থাকে। কাকে তারা তার দেশে আসতে দেবে, কাকে দেবে না, কাকে ভিসা দেবে, কাকে দেবে না-এটা স্রেফ তাদের নিজস্ব বিষয়। তাদের যেমন ভিসা দেওয়ার অধিকার রয়েছে, না দেওয়ারও অধিকার রয়েছে। এ নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই।

হাসানুল হক ইনু বলেন, ভিসানীতি নিয়ে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে, রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে যারা পক্ষে-বিপক্ষে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন-এটা হালকা রাজনীতির প্রকাশ। এটা নিয়ে মন্তব্য না করাই উচিত। আমেরিকা তাদের কাজ করেছে। তাতে আমাদের ১৬ কোটি মানুষের কার কী আসে যায়। আমেরিকা যাওয়ার জন্য ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ হাজারেরও আগ্রহ নেই। শুধু তাদের আগ্রহ-যারা তাদের নাগরিক হতে চান আর যারা বড় রাজনীতিবিদ, টাকাওয়ালা রাজনীতিবিদ, টাকাওয়ালা আমলা, টাকাওয়ালা ব্যবসায়ী। তাদের আগ্রহ এই ভিসানীতি নিয়ে। তারা আমেরিকায় ঢুকতে পারল কি পারল না, তাতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু যায় আসে না।

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন দেশ এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের নানা তৎপরতাকে কোন চোখে দেখছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ এই বাম নেতা বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, তাদের দেশীয় রাজনীতির মূল্যবোধের মানদণ্ডে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে থাকে। বিবৃতি দিয়ে থাকে। এটা রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত, চীন ও উত্তর কোরিয়া থেকে আফ্রিকার দেশগুলো-এসব দেশের প্রশ্নে এবং উন্নয়নশীল দেশের প্রশ্নে তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মাপকাঠি তৈরি করে। কোথাও তারা সমালোচনামুখর, কোথাও আবার নীরব। কোথাও তারা নিষ্ক্রিয়। সুতরাং আমি মনে করি, উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়ায় যারা কাজ করছেন, তাদের আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

হাসানুল হক ইনু আরও বলেন, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারের কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। এক মুখে তারা গণতন্ত্রের কথা বলে, আরেক মুখে তারা খুনিদের পক্ষে কথা বলে। তারা খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। তারা সামরিক শাসক এবং তাদের রেখে যাওয়া জঞ্জালের পক্ষে ওকালতি করে। সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গিবাদের তৎপরতাকে অনুমোদন করে।

সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী তৎপরতাকে উসকে দেয়। কোথাও তারা গণতন্ত্রের প্রশ্নে নীরব থাকে। যেমন: মধ্যপ্রচ্যের প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে, বিশেষ করে আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে, পাকিস্তানের ঘটনা দেখলে এই কথার সত্যতা মেলবে। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে গণতন্ত্রের মাপকাঠিটা কী-এটা আসলে সবার কাছেই ধোঁয়াটে। এই ধোঁয়াটে মাপকাঠি নিয়ে বাংলাদেশের কতিপয় রাজনীতিবিদ কখনো উৎফুল্ল হন। কখনো তারা হতাশ হয়ে পড়েন।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আমি আশির দশকে একটি কথা বলেছিলাম-ক্যান্টনমেন্টের দিকে তাকিয়ে এবং বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল রাখা যাবে না। সুতরাং, ক্যান্টনমেন্টের দিকে তাকিয়ে, বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি নির্ণয় করার অপসংস্কৃতি বর্জন করাটাই মঙ্গলজনক।

তিনি বলেন, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ভোট হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষদিকে না হয় ২০২৪ সালের প্রথমদিকে যথারীতি আবার ভোট হবে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রকাশ্যে খুনিদের পক্ষে বিবৃতি দিচ্ছে। তারা প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের দলের সঙ্গে বৈঠক করছে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।

সুতরাং, বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনীতিতে ইউরোপ-আমেরিকার এসব বিবৃতি এবং নানামুখী তৎপরতা আমলে নেওয়ার কিছু নেই। আমরা নজর রাখব। কিন্তু এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিজ গতিতে ও নিজ শক্তিতে এগিয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ এবং সংসদের বাইরে একাধিকবার বলেছেন, আমেরিকা তাকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আপনার কি মনে হয়, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এসব তৎপরতার মূলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা-জবাবে হাসানুল হক ইনু বলেন, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপরিচালনা করছেন।

তার কাছে অনেক তথ্য থাকে, যা আমার কাছে নেই। তিনি যখন সংসদে এবং সংসদের বাইরে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেন, তখন আমি এটা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করি। ’৭১ সাল থেকে পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডসহ অদ্যাবধি এবং বিশ্বের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি আমেরিকা অবৈধভাবে ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিভিন্ন দেশের সরকারকে উৎখাত করেছে। সরকার অদলবদলের খেলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, এটা রেকর্ডেড ইতিহাস। এই ইতিহাস যখন আছে এবং বাংলাদেশের সরকার অদলবদলে আমেরিকার ইন্ধনে অনেক ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা অতীতে ঘটেছে, তাই আমি মনে করি-প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

আমেরিকা প্রত্যক্ষভাবে একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। তারা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। জামায়াত প্রত্যক্ষভাবে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গি লালন করছে। তারা একুশে আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। জামায়াত চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আমেরিকা কখনো তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেনি।

টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করেনি। বরং সাম্প্রতিককালে আমেরিকা কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশে সফরে এসে জামায়াতে ইসলামী এবং জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের দিয়ে গঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্লজ্জের মতো বৈঠক করেছে।

জাসদ সভাপতি বলেন, আমি যতটুকু জেনেছি-আমেরিকা আমাদের ‘বে অব বেঙ্গল’ বা বঙ্গোপসাগরে সামরিক সুযোগ-সুবিধা নিতে চায় বহুদিন ধরে। তাদের একটা ‘নন ডিসক্লোজার ফ্যাক্ট’, যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। যদিও আমেরিকা এটা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করছে না। আমরাও এ নিয়ে কথা বলছি না। সুতরাং সব মিলিয়ে বঙ্গোপসাগরে সামরিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে আমেরিকার যে দৃষ্টি রয়েছে, তা আমি নিজেও সংসদে বলেছি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও আমার কথার সমর্থনে বক্তব্য দিয়েছেন।

আমি আবারও বলছি, বঙ্গোপসাগরে সামরিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে আমেরিকা। দেশবাসী এবং সরকারকে এ বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

এবার আসা যাক নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে। তাকে নিয়ে বিশ্বনেতারা বিবৃতি দিয়েছেন। তাকে কেন্দ্র করেও দেশের রাজনীতিতে নানা ধরনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি কী মনে হয় আপনার-জবাবে হাসানুল হক ইনু বলেন, সম্প্রতি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদালতে আত্মসমর্পণ এবং কয়েদির নম্বরসহ ছবি দেওয়াকে আমি অভিনন্দন জানাই। তাতে যদি কারও আপত্তি না থাকে, তাহলে নোবেলজয়ীই হোক, প্রধানমন্ত্রীই হোক কিংবা রাষ্ট্রপতিই হোক, কিংবা আমি হই-আমাদের বিরুদ্ধে কোনো বেআইনি কাজের জন্য আদালতে মামলা চালু থাকে, সেটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করা অশোভন। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আচরণ একযাত্রায় দুই ফল কেন হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেলায় যে ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে ড. ইউনূসের বিষয়ে তো আপত্তি থাকার কথা না। কারণ, তার বিষয়ে যা ঘটছে, তা প্রকাশ্য আদালতে ঘটছে।

তিনি বলেন, ১৫ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনে, উন্নয়ন-অগ্রগতিতে তার কোনো ভূমিকা নেই। তিনি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। তিনি কোনো আইনের বরখেলাপ করে থাকলে তা আদালত দেখবেন। এর সঙ্গে সরকার এবং নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা ড. ইউনূসের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানেন না। তারা দ্বৈত সত্তার অধিকারী।

এক মুখে তারা ড. ইউনূসের পক্ষে ওকালতি করছেন; আরেক মুখে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিষয়ে সমর্থন দিয়ে বলছেন-ভালো কাজ করছ, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাচ্ছ। আইনের শাসনের মনদণ্ডে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেখানে আছেন, ড. ইউনূসও সেখানে আছেন। সুতরাং এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ কারও কারও অভিযোগ-দেশে আবারও একটি ‘এক-এগারো’র মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৎপরতায়ও এমনটা মনে করছেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি বলেন, আমেরিকা ও ইউরোপ তাদের মানদণ্ডে পক্ষপাতমূলকভাবে পৃথিবীকে বিচার করে। তাই তাদের নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশে সাংবিধানিক সরকারের চেয়ে অতীব খারাপ সরকার হচ্ছে সামরিক সরকার। অসাংবিধানিক সরকার।

আর এর চেয়েও খারাপ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক-তালেবানি সরকার। আমি তালেবানি সরকার, অসাংবিধানিক সরকার ও সামরিক সরকারের চেয়ে সাংবিধানিক সরকারের পক্ষেই ওকালতি করব এবং থাকব।

সম্প্রতি তিন বাম দলের শীর্ষ নেতারাসহ আপনি চীন সফরে যান। আপনারা বর্তমান সরকারের পাশে থাকতে চীনের সহায়তা চেয়েছেন। এমন আলোচনা রয়েছে, সত্যিটা কী-জবাবে জাসদ সভাপতি বলেন, চীন গত ৫০ বছরে আমাদের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বাইরে কোনো রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। আমরা বামপন্থি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে। তাদের আমন্ত্রণে আমরা সেখানে গিয়েছি। এটা নতুন কিছু নয়। চীনের অভিজ্ঞতাকে আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কীভাবে কাজে লাগাতে পারি, তা নিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়েছে। তবে চীন কখনো কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে না।

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা সম্প্রতি ভারত থেকে ঘুরে এসেছেন। নির্বাচনের আগে তাদের এই সফর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না-জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনু বলেন, ভারত আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাশে ছিল তারা। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ সময় এদেশে সামরিক সরকারের উপস্থিতি ছিল। বাংলাদেশের জনগণের দিকে তাকিয়ে ভারত তাদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রেখেছে।

আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতকে কখনো মাথা ঘামাতে দেখিনি। ভারত সব সময় গণতন্ত্রের চর্চা করেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করেছে। তারাও কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে বিশ্বাস করে। আমরা তাদের এই নীতিকে সম্মান করি। শ্রদ্ধার সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক রাখার পক্ষে ওকালতি করি।

Pin It