নানা উদ্যোগেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি

image-731452-1697906735

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। পরিবহণ খাতে মেগা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, গড়ে উঠছে বড় বড় অবকাঠামো। তবে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ অনুপাতে গণপরিবহণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসেনি। উলটো প্রতিবছর সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলছে। যদিও প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেও ভিন্নতা রয়েছে।

বিআরটিএ-এর পরিসংখ্যা অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭২৭ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৭৮১ জন আহত হয়েছেন। অপরদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, এই সময়ে ৪ হাজার ২৯৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪ হাজার ৩৬২ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৮২৩ জন। এ সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৫ হাজার ৯২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৯ হাজার একজন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ৪২ হাজার ৩৮৮ জন। এমন পরিস্থিতিতে রোববার পালন করা হচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘আইন মেনে চলি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’।

নিরাপদ সড়ক পরিবহণ নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের নেতারা জানান, সড়কের বিশৃঙ্খলার কারণে প্রতিবছর দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকার থাকলেও সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয়ে রোড সেফটি ইউনিট গঠিত হলেও মূলত সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কোনো গবেষণা কার্যক্রম নেই। গবেষণা নেই, নেই কোনো বাজেট বরাদ্দ। ফলে প্রতিবছর সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।

সড়ক খাতে বড় বিনিয়োগ হলেও শৃঙ্খলা না থাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা আরেক সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. এআই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দেশে সড়ক অবকাঠামো উন্নত ও বিস্তৃত হয়েছে। নানা ধরনের যানবাহন বেড়েছে। যানবাহনের গতি বেড়েছে। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়েনি। এই বেপরোয়া গতির কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ যেমন দরকার, তেমনই আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিআরটিএ-এর হিসাব অনুযায়ী দেশে ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন মোটরযান রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। এ যদি হয় অবস্থা, তাহলে দেশে সড়ক নিরাপত্তা বলে কিছু নেই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সবার সহযোগিতা ও সচেতনতা দরকার। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়।’

তিনি বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে চালক, মালিক, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতন হতে হবে।’ উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যপুস্তকে একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে। অথচ স্কুল ছুটি হলে দেখা যায়, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এমনকি শিক্ষকরাও নিয়ম না মেনেই রাস্তা পার হন।’

সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহত বেড়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘দেশে মানুষ বেড়েছে, যানবাহন বেড়েছে, বেড়েছে গাড়ির গতি। সার্বিক দিক বিবেচনায় আনা হলে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে কি না, তা একবাক্যে বলা যাবে না। তবে সরকার দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে অনেক ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএ-এর কর্মকর্তা জানান, সড়ক খাতের নিয়ন্ত্রণ মূলত সরকারি দলের নেতাকর্মীদের হাতে চলে গেছে। পরিবহণ মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে রাজনৈতিক নেতারা রয়েছেন। তাদের ছত্রছায়ায় অনেক মালিক ও চালক বেপরোয়া গাড়ি পরিচালনা করলেও পুলিশ ও প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না। আবার কখনো কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তাদের চাপে ছেড়ে দিতে হয়।

সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে : সড়ক পরিবহণ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি বেড়েই চলছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৩৫৬ জন। এর আগের বছর ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন মারা যান এবং ৯ হাজার ৩৯ জন আহত হন। ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আরও কম ছিল। ওই বছর ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন মারা যান ও আহত হন ৮ হাজার ৬০০ জন।

আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৪৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪৩১ জন মারা যান ও আহত হন ৭৩৭৯ জন। ২০২১ সালে বেড়ে ৫৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৬২৮৪ জন নিহত ও ৭৪৬৮ জন আহত হন। ২০২২ সালে সড়কে মৃত্যুর হার আরও বেড়ে যায়। বিদায়ি বছরে ৬৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৭১৩ জন নিহত এবং ১২৬১৫ জন আহত হন।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি : জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষ্যে শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ টাকার পরিবর্তে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানায়। এতে সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮-এর অধীনে জারিকৃত বিধিমালা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ও আহত অঙ্গহানি বা পঙ্গু হলে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। ওই আইন কার্যকরের ৫ বছরের মাথায় বৃহস্পতিবার মাত্র ১৬২ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। বিআরটিএ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭২৭ জন নিহত এবং ৫৭৮১ জন আহত হয়েছেন। সেই হিসাবে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকাররা ১৮৬ কোটি ৩৫ লাখ এবং আহত ব্যক্তিরা ১৭৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবিদার। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র ৭ কোটি ৮ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না থাকায় দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছেই। প্রতিবছর দেশে ৮০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হচ্ছেন।

শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধান বাধা ক্ষমতাসীনরা : এদিন রাজধানীর ধানমন্ডিতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে আয়োজিত ‘দেশের গণপরিবহণ ব্যবস্থাপনা ও সড়ক নিরাপত্তা পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ক্ষমতাসীন দলের একটা অংশ সড়ক পরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি করছে। এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠীই পরিবহণ খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এআই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগই ঠিকমতো আলোর মুখ দেখছে না। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগই যথেষ্ট মাত্রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে জনগণ সচেতন হচ্ছে না, সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থাপনায়ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।

সংবাদ সম্মেলনে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক হাসিনা বেগম, আবদুল্লাহ মো. ফেরদৌস খান, রাশেদ খান, রোড সেফটি ওয়াচ ডটকমের সম্পাদক হারুন অর-রশীদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Pin It