বৈশ্বিক ও দেশীয় মন্দার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া পূর্বাভাস মিলছে না। বিভিন্ন খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে বহু দূরে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পূর্বাভাস সংশোধন করে লক্ষ্যমাত্রা কমানো অথবা বাড়ানো হচ্ছে। এতে মন্দার কবল থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ সফল না হওয়ায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তির মাত্রা আরও বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতির হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, টাকার প্রবাহ, সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ, আমদানি, রপ্তানি খাতে পূর্বাভাসের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। শুধু রেমিট্যান্স প্রবাহ পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি বেড়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে গভর্নর বলেছিলেন ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনা হবে।
এ মাসের মধ্যে ওই হার ৬ শতাংশের ঘরে নিয়ে আসার লক্ষ্য ছিল। ওই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। গত ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে) মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করবে।
মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি গ্রহণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। আগে টাকার প্রবাহ গড়ে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ বাড়ানো হতো। এখন সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির আওতায় তা অনেক কম বাড়ানো হচ্ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত টাকার প্রবাহ ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ওই সময়ে বেড়েছে ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ মাস পর্যন্ত ১০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে মার্চ পর্যন্ত বেড়েছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বাজারে টাকার প্রবাহ বেশি কমেছে। তারপরও মূল্যস্ফীতির হার কমছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে তা টাকার প্রবাহ বৃদ্ধিজনিত কারণে হয়নি। হয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও আমদানি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে না কমার কারণে এমনটি হয়েছে।
বৈশ্বিক ও দেশীয় সংকটের কারণে ডলার আয় কমে যাচ্ছে। এতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও কমছে। বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিট বৈদেশিক সম্পদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য অফশোর ব্যাংকিং হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলার সুযোগ সহজ করা হয়েছে। এতে বাড়তি মুনাফা দেওয়া হচ্ছে। রপ্তানি আয় দেশে আনার উদ্যোগ নিতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। রপ্তানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের সুবিধা পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত নিট বৈদেশিক সম্পদ ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাসের মধ্যে সীমিত রাখার কথা ছিল। ওই সময়ে তা কমেছিল ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম কমেছিল। আমদানি বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারে খরচ তুলনামূলকভাবে কিছুটা কমিয়েছে। যে কারণে নিট বৈদেশিক সম্পদ কমেছে কম। এ মাস পর্যন্ত তা ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। পরে তা সংশোধন করে ২ দশমিক ৪ শতাংশ কমার মধ্যে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে মার্চ পর্যন্ত ১৬ দশমিক ০৬ শতাংশ কমেছে। ফলে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ঋণ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ওই সময় পর্যন্ত বেড়েছে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। এ মাসে তা ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার ছিল, পরে তা কমিয়ে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ করা হয়। এর বিপরীতে গত মার্চ পর্যন্ত বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই সময়ে সরকারের ঋণ বাড়েনি। বরং আগের চেয়ে ৯ দশমিক ২১ শতাংশ কমেছিল। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে সরকার ঋণ কম নিয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা খরচনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিয়ে দেওয়ায়ও সরকারের ঋণ কমেছে। এ মাস পর্যন্ত এ খাতে ঋণ ৩১ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল, পরে আরও কমিয়ে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য ঠিক করা হয়। এর বিপরীতে মার্চ পর্যন্ত সরকারের ঋণ বেড়েছে দশমিক ৭৯ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই সময়ে বেড়েছিল ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। এ মাস পর্যন্ত তা বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা প্রথমে ধরা হয়েছিল ১১ শতাংশ, পরে তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। মার্চ পর্যন্ত এ খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এ মাসে ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার রাখার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২১ মে পর্যন্ত রয়েছে ২ হাজার ৪০৯ কোটি ডলার। এ মাসের মধ্যে রিজার্ভ ওই মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব নয়। রেমিট্যান্স প্রবাহ ২ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ। রেমিট্যান্স প্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রয়েছে।
এ মাসে আমদানি গত অর্থবছরের তুলনায় ৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। মার্চ পর্যন্ত কমেছে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। মূলত ডলার সংকটের কারণে আমদানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কমেছে।
জুনের মধ্যে রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের তুলনায় ৪ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
রপ্তানি আয় বাড়িয়ে ও আমদানি ব্যয় কমিয়ে চলতি অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে ১ হাজার ২০ কোটি ডলারে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। মার্চ পর্যন্ত এ ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় কম হওয়ায় এ ঘাটতি বেশি কমেছে। এতে আমদানি পণ্যনির্ভর বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ৩৩ কোটি ডলারে নামানোর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ পর্যন্ত এ হিসাবে কোনো ঘাটতি হয়নি, বরং উদ্বৃত্ত হয়েছে ৫৮০ কোটি ডলার। ডলারের চলতি ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হওয়ায় এ হিসাবে ঘাটতি দূর হয়ে উদ্বৃত্ত হয়েছে। আর্থিক হিসাবে ২০ কোটি ডলারে উদ্বৃত্ত রাখার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ পর্যন্ত ৯২৬ কোটি ডলার ঘাটতি রয়েছে। বৈদেশিক ঋণসহ বকেয়া দায় পরিশোধ করতে ডলার খরচ বেশি হওয়ায় এ খাতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এ হিসাবে ঘাটতি ছিল ২৯৩ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে এ হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে তিনগুণের বেশি। যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এ হিসাবে চাপ কমলেই রিজার্ভের ওপর চাপ কমে যাবে।
চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক ব্যালেন্সে ঘাটতি ৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ পর্যন্ত ছিল ৪৭৫ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ কম।