ঢাকার দুই সিটি:বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভেঙে পড়েছে সেবা কার্যক্রম

image-842289-1724533453

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ কাউন্সিলর পলাতক রয়েছেন। এজন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস থেকে জনগণ সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বাস্তবতা অনুধাবন করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন সেবা আঞ্চলিক কার্যালয়ে স্থানান্তর করেছে। তবে দুই সিটির কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে দেওয়া সনদ ও ওয়ার্ড পর্যায়ের সেবা কার্যক্রম তদারকি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, মেয়রদের অপসারণ করে কাউন্সিলরদের রেখে নগর প্রশাসন ও সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। কেননা, কাউন্সিলর পদে যারা অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তারা বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী। ওয়ার্ড পর্যায়ের এসব জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছেন। নানাভাবে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং মানুষের সম্পদ দখল করেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেকে মানুষ হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিল। আর দুই সিটি করপোরেশনের বর্তমান পরিষদের ৯৫ ভাগ কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদের বহাল রেখে নগরসেবা কার্যক্রম সচল রাখা সম্ভব নয় বলে অভিমত তাদের।

তারা বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের উচিত হবে মেয়রদের মতো কাউন্সিলরদেরও বহিষ্কার করে দেওয়া। একই সঙ্গে আঞ্চলিক কার্যালয়ে ওই সেবা স্থানান্তর করা। আগে অনেকবার এভাবে জনসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। ওই আঞ্চলিক কার্যালয়ে উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে দক্ষ কর্মীবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে। আপদকালীন হিসাবে এটাই সর্বোত্তম হবে। এরপর বর্তমানের সরকারের উচিত হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। সেটা করতে না পারলে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মেয়র পদে ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রশাসক নিয়োগ করা। এতে জনসেবা ঠিক থাকবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারের মূল দর্শনও অনেকাংশে বজায় থাকবে।

সরেজমিন ডিএনসিসি’র মিরপুরের ওয়ার্ডগুলো ঘুরে দেখেছেন মিরপুর প্রতিনিধি। তিনি জানান, ডিএনসিসির ওয়ার্ড কাউন্সিলররা লাপাত্তা। তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন সেবাপ্রার্থীরা। ডিএনসিসি’র ৩, ৪, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১৩, ১৪ , ১৫ এবং ১৬ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায় ওয়ার্ড সচিবরা দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ততা থাকলেও কাউন্সিলরদের দেখা নেই। আবার জনরোষে কয়েকটি কাউন্সিলর কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. পাপ্পু জানান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস থেকে বিভিন্ন নাগরিক সেবা দেওয়া হয়। এসব সেবার সনদ নিতে কাউন্সিলরের স্বাক্ষর লাগে। গত সপ্তাহে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সির কার্যালয়ে গিয়ে জন্মসনদ করতে পারিনি। কাউন্সিলরের মোবাইল বন্ধ থাকায় অফিসের লোকজনও এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি।

মিরপুর ২ নম্বরের ৬০ ফুট এলাকার বাসিন্দা মজনু বলেন, আগে কাউন্সিলর অফিস থেকে মশা মারার ওষুধ ছিটানোর কাজ তদারকি করা হতো। কয়েক দিন ধরে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। এ ব্যাপারে কার কাছে বলব তাও বুঝতে পারছি না। কাউন্সিলর অফিসে তালা ঝুলছে।

ডিএনসিসি’র ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর বেগম মেহেরুন্নেছা হক জানান, কাউন্সিলররা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তারা জনগণের প্রতিনিধি। তারা যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। মশার ওষুধ ছিটানো, রাস্তাঘাট পরিষ্কার, জন্ম-মৃত্যু সনদসহ ১৪টি খাতে সেবা দিয়ে থাকেন কাউন্সিলররা। অন্য কাউন্সিলরা কী করছেন জানি না; তবে আমি নিয়মিত অফিস করছি। এলাকাবাসীর যেকোনো সমস্যা সমাধানে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।

ডিএনসিসি’র ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আব্দুল মান্নান বলেন, ৬ আগস্ট আমার অফিসে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে কম্পিউটারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে গেছে। আমি অফিসে না বসলেও আড়ালে থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে স্বাক্ষর করছি।

তিনি আরও বলেন, ২-৩ দিন আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মিরপুরের বেশির ভাগ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরও রয়েছেন। মামলা খেলেও কাউন্সিলররা সেবা দিতে প্রস্তুত।

ডিএনসিসির নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, আমার অঞ্চলে বিএনপি সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছাড়া অন্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। কাউন্সিলররা না থাকায় কাজের গতি কমে গেছে। অবশ্য অনেকে আড়ালে থেকে কাজ করার চেষ্টা করছেন। আর ওয়ার্ড সচিবরা নিয়মিত অফিসে বসছেন। এভাবে তো সেবা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা যাবে না। বিভিন্ন জায়গা থেকে সেবা না পেয়ে অনেকে বিরক্ত হয়ে তাকে ফোন করছেন বলে জানান।

উত্তরা প্রতিনিধি জানান, উত্তরার অঞ্চলের কাউন্সিলররা গাঢাকা দেওয়ায় সেবা পাচ্ছেন বাসিন্দারা। মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে উত্তরা এলাকার ডিএনসিসি’র ১, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। দুপুরে তুরাগের কামারপাড়া এলাকার ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম যুবরাজের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতীয়তলার কার্যালয় তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। কাউন্সিলর অফিসের নিচে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর থেকেই পলাতক রয়েছেন তিনি। ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানোর অভিযোগে এলাকায় যুবরাজের বিচারের দাবিতে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। একই অবস্থা উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ শরীফুর রহমানের কার্যালয়েরও। এলাকাবাসী জানান, ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পর থেকে পলাতক রয়েছেন এই কাউন্সিলর।

এলাকাবাসী জানান, সেবা কার্যক্রম বন্ধ রেখে গাঢাকা দিয়েছেন ডিএনসিসি ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা আফসার উদ্দিন খান, দক্ষিণখান-আশকোনার ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আনিসুর রহমান নাঈম এবং ৫০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা ডিএম শামীমও। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে আওয়ামী লীগের সক্রিয় থাকায় জনতার ভয়ে তারা সবাই পালিয়েছেন। নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে ডিএনসিসির ৫২ ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন তুরাগের বিশাল এলাকায়ও।

মতিঝিল প্রতিনিধি ও নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫, ৮, ৯, ১০, ১৩, ৩২, ৩৫, ৩৭ ও ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে কার্যালয় তালাবদ্ধ দেখতে পেয়েছেন। দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। এমনকি কেউ মোবাইল ফোনও ধরছেন না। অথচ কিছুদিন পূর্বে এসব ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস রাত-দিন সরগম থাকত।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাস জানান, অফিস ভাঙচুর ও ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। এখন ভাড়া অফিস নিয়ে কার্যক্রম চালু করার চেষ্টা করছি। এখন অনলাইন সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে।

ডেমরা প্রতিনিধি জানান, ৫ আগস্টের পর ডিএসসিসির ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৪ এবং ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে ওইসব ওয়ার্ডে প্রথম দিকে নাগরিক সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গাঢাকা দেন অধিকাংশ কাউন্সিলরসহ নারী কাউন্সিলররাও। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকাবাসী।

বিশেষজ্ঞের অভিমত : পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সিটি করপোরেশনের বিদ্যমান পর্ষদ বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল। সে কারণে মেয়রদের সরিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হয়েছে। এখন কাউন্সিলরদেরও সরিয়ে দেওয়া উচিত। এরপর কাউন্সিলর অফিসের সেবা আঞ্চলিক কার্যালয়ে স্থানান্তর করা যেতে পারে। তবে এরপর দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। কোনো কারণে সেটা সম্ভব না হলে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মেয়র ও কাউন্সিলরদের সরকারি আদেশের মাধ্যমে দায়িত্ব দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। তাহলে জনসেবা ও স্থানীয় সরকারের মূলনীতি ঠিক রাখা সম্ভব হবে।

দুই প্রশাসকের বক্তব্য : সোমবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। মঙ্গলবার তারা দু’জন দায়িত্ব গ্রহণ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

ডিএনসিসির নবনিযুক্ত প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান বলেছেন, সব সেবা নিরবচ্ছিন্নভাবে রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে।

ডিএসসিসির নবনিযুক্ত প্রশাসক ড. মহ. শের আলী বলেছেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সব ধরনের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে।

Pin It