দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দেশের আমদানি বাণিজ্য আবার সচল হওয়ার পথে। ২০২০ সাল থেকে করোনার সংক্রমণ, বৈশ্বিক মন্দা, দেশে ডলার সংকট, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমদানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
টানা পাঁচ বছর আমদানি ব্যাহত হওয়ার পর এখন এ বাণিজ্য সচল হওয়ার পথ খুলেছে। আড়াই বছর ধরে চলা ডলার সংকট ক্রমেই কেটে যাচ্ছে, বকেয়া বৈদেশিক ঋণের স্থিতিও কমতে শুরু করেছে। ফলে ঋণ পরিশোধে চাপও কমছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারেও পণ্যের দাম বেশ খানিকটা কমেছে। আগামী বছরে তা আরও কমে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন চলে যেতে পারে। জ্বালানি তেলের দামও কমেছে। আগামীতে আরও কমে প্রতি ব্যারেল ৭৩ ডলারে নেমে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এসব মিলে আমদানি বাণিজ্য আগামীতে বেড়ে যাবে।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের শুরু থেকে করোনার সংক্রমণের কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউন শুরু হলে আমদানিও ব্যাহত হয়। এই ধারাবাহিকতা চলে ২০২১ সালের শেষ সময় পর্যন্ত। ২০২১ সালের শেষদিক থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম হুহু করে বেড়ে যায়। এতে দেশে আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়।
ওই বছরের এপ্রিল থেকে দেশে শুরু হয় ডলার সংকট। জুলাইয়ে গিয়ে তা প্রকট আকার ধারণ করে। যা গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলমান ছিল। ওই সময়ে ডলার সাশ্রয় করতে ও রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্যে ২৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করে। এরপর তা বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে। পরে আরও বাড়িয়ে শতভাগ মার্জিন আরোপ করে। একই সঙ্গে বিলাসী পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে।
এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এতে আমদানিনির্ভর কাঁচামালের শিল্পের উৎপাদন কমে যায়। আমদানিনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমদানি পণ্যের সরবরাহ সংকটের কারণে দাম বেড়ে যায়। যে কারণে আমদানি পণ্যের মূল্যস্ফীতির হারও বেড়ে যাবে। ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে বিভিন্ন সময়ে আমদানি পণ্য মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ ভ‚মিকা রেখেছে।
দেশ ২০১৮ সাল থেকে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে। পরবর্তী সময়ে তা প্রকট হয়েছে। করোনা ও মন্দার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় আমদানি কমে যায় ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ওই বছরে আমদানি হয়েছিল ৫ হাজার ৬৯ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় কিছুটা বেড়ে ৬ হাজার ৬৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। আগের বছরের চেয়ে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয় ১৯ দশমিক ৭১ শতাংশ।
মূলত করোনার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। যে কারণে দামও বাড়তে থাকে। এ কারণে ওই বছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে। ওই বছরে আমদানি ব্যয় ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ২৪৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। বৈদেশিক ঋণসহ আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ৪৮ শতাংশ। ওই বছরের এপ্রিলে সর্বোচ্চ ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায়। এর প্রভাবে আমদানি খরচও বৃদ্ধি পায়।
ওই বছরের এপ্রিল থেকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এতে পণ্য আমদানি কমার পাশাপাশি এ খাতে ব্যয়ও কমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমে ৭ হাজার ৭৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
ওই বছর থেকে এখনো আমদানি ব্যয় কমছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় আরও ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ কমে ৬ হাজার ৩২৪ কোটি ডলারে নেমে যায়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসে আমদানি হয়েছে ৯৯১ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি কমেছে ১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
সূত্র জানায়, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে আগের আরোপিত এলসি মার্জিন প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে কেবল ১৪টি বিলাসী পণ্য আমদানিতে শতভাগ মার্জিন আরোপিত রয়েছে। এছাড়া অর্থ পাচার বহুলাংশে কমে যাওয়ায় এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়তে থাকায় বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ছে। আগে প্রতি মাসে রিজার্ভ কমত। এখন রিজার্ভ না কমে বরং বাড়ছে। রিজার্ভে হাত না দিয়েই আমদানি ব্যয়সহ নিয়মিত দেনা শোধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ শোধ করা হয়েছে। ফলে রিজার্ভে চাপ কিছুটা কমেছে।
এসব কারণে আমদানি বাড়ার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলার প্রবণতা বেড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম হওয়ার কারণে আগের তুলনায় কম দামে এখন বেশি পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে। এতে আমদানিনির্ভর শিল্প মন্দা কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।