হতে পারে মূত্রনালীর সংক্রমণ কিংবা বৃক্কের ক্যান্সার।
মাঝে মধ্যে চেপে রাখা যেতে পারে। তবে নিয়মিত প্রস্রাব চেপে রাখার অভ্যাস থাকলে দেখা দিতে পারে নানান স্বাস্থ্য সমস্যা।
তারমধ্যে একটি হল মূত্রনালীতে সংক্রমণ।
এই সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্ক’য়ের লং আইল্যান্ড’য়ের ‘স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটি’র ‘রেনেসাঁ স্কুল অফ মেডিসিন’য়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জেসন কিম বলেন, “প্রস্রাব কার্যকলাপটি পরিচালিত হয় জটিল স্নায়ুবিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।”
যুক্তরাষ্ট্রের ‘উইমেন’স পেলভিক হেল্থ অ্যান্ড কন্টিনেন্স সেন্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরিচালক ব্যাখ্যা করেন, “কিডনি অর্থাৎ বৃক্ক প্রস্রাব তৈরি করে যা মূত্রনালীর মাধ্যমে মূত্রথলিতে যায়। আর মূত্রথলির সাধারণ ধারণ ক্ষমতা ৪০০ থেকে ৬০০ কিউবিক সেন্টিমিটার্স।”
যখন মূত্রথলি পূর্ণ হয়ে যায় তখন স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রস্রাব করার সংকেত যায়। আর মস্তিষ্ক মূত্রথলিকে জানান দেয় সমাজবান্ধব পরিস্থিতি না পাওয়া পর্যন্ত চেপে রাখতে। আর সঠিক পরিবেশ পেলে মস্তিষ্ক মূত্রনালীর ‘স্ফিংক্টার’ পেশিকে শিথিল হতে এবং মূত্রথলি সংকুচিত হয়ে প্রস্রাব বের হয়ে যাওয়ার সংকেত প্রদান করে।
নিউ ইয়র্ক সিটি’র ‘এনওয়াই ইউরোলজি’র ইউরোলজিস্ট ডা. ডেভিড শাস্টারম্যান একই প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন, “আমরা আসলে এভাবেই তৈরি হয়েছি যাতে যত্রতত্র প্রস্রাব না করে ফেলি। এই তরল আসলে ঘনীভূত দুষিত পদার্থ, যে কারণে শরীর সেটা বের করে দিতে চায়।”
তবে দুষিত পদার্থ সময় মতো বের করে না দিলেই ঘটবে বিপত্তি।
সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি
“প্রস্রাব চেপে রাখার ফলে ‘ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন’ মূত্রনালীর সংক্রমণ হওয়া ঝুঁকি বাড়ে”- বলেন ‘অর্লান্ডো হেল্থ’য়ের ইউরোলজিস্ট ডা. জামিন ব্রাক্ষ্মভাট।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “প্রস্রাব বের করে দিলে যেমন বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায়, তেমনি চেপে রাখলে ব্যাক্টেরিয়া জন্মানোর পরিবেশ তৈরি হয়।”
এই কারণে যৌনকার্যের পর সবাইকে বিশেষ করে নারীদের প্রস্রাবের পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে কোনো প্রকার সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায় মূতনালী।
“মূত্রনালীর সংক্রমণে ঠিক মতো চিকিৎসা না নিলে হতে পারে বৃক্কের নানান রোগ। রোগের মাত্রা বাড়লে প্রস্রাবের সাথে রক্তও পড়তে পারে” – বলেন ডা. কিম।
এছাড়া প্রস্রাব চেপে রাখার অভ্যাস থেকে মূত্রথলির পেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যে কারণে মূত্রথলি পুরোপুরি খালি হতে পারে না। এরফলে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়ে।
আর সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায় হিসেবে হতে পারে বৃক্কে ক্যান্সার।
যা করা উচিত
প্রকৃতির ডাক যত দ্রুত সাড়া দেওয়া যাবে ততই মঙ্গল- মতামত দেন এই বিশেষজ্ঞারা।
সাধারণ সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ সপ্তাহে কয়েকবার অল্প কয়েক ঘণ্টা প্রস্রাব চেপে রাখতে পারে, পরিস্থিতি বিবেচনায়। তবে সপ্তাহে নিয়মিত করে মূত্রথলি ও বৃক্কে অযাচিত চাপ ফেলার কোনো মানে হয় না।
“যারা বৃদ্ধ তাদের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বয়স বাড়লে পুরুষদের ‘প্রোস্টেট’ বড় হয়ে যায়, নারীদের মূত্রনালী আঁটসাঁট হতে থাকে। তাই বয়স বাড়লে এমনিতেই প্রস্রাবের বেগের পরিমাণ কমে”- বলেন ডা. শাস্টারম্যান।
গর্ভবতীদের এই বিষয়ে আরও সাবধান হতে হবে। প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে দেরি করা যাবে না।
যারা একবার হলেও মূত্রনালীর সংক্রমণে ভুগেছেন তাদের অবশ্যই আরও সাবধান হতে হবে।
ডা. শাস্টারম্যান আরও পরামর্শ দেন, “ধূমপানের অভ্যাস বা দুষিত পরিবেশে কাজ করলে বৃক্কের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমন মানুষদের নিয়মিত প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।”
যদি বারবার প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে যাওয়ার বিরক্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে প্রস্রাব চেপে রাখতে হয়, তবে এই লক্ষণ হতে পারে ‘ওভারঅ্যাক্টিভ ব্লাডার সিন্ড্রম’ বা মূত্রথলির অতিসক্রিয়তার রোগ, ডায়াবেটিস বা মূত্রনালীর সংক্রমণ।
এই ক্ষেত্রে অবশ্যই দ্রুত ‘ইউরোলস্টি’য়ের পরামর্শ নিয়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
শীতকালে যে কারণে মূত্রনালীর সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে
মূত্রনালীর সংক্রমণে ভোগার কারণ হতে পারে ভিটামিন ডি’র স্বল্পতা।
শীত ঋতু মানেই যেন আরামদায়ক গরম কাপড়, বেড়াতে যাওয়া, গরম কফি বা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। আর মাঝে মধ্যে ঠাণ্ডা-কাশিতে ভোগা।
তবে ঠাণ্ডা মাসগুলোতে আরেকটি রোগে ভোগার সম্ভাবনা বাড়ে, সেটা হল ‘ইরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনস (ইউটিআই)’ বা মূত্রনালীর সংক্রমণ। যা মূত্রনালির এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়াঘটিত সংক্রমণ।
এজন্য শুধু ঠাণ্ডা আবহাওয়া নয় বরং ভিটামিন ডি’র স্বল্পতাও দায়ী। কারণ শীতকালে গায়ে রোদ লাগে কম। ফলে দেহে এই ভিটামিনের অভাব দেখা দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থওয়েল স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটি হসপিটাল’য়ের পুরুষ বন্ধ্যাত্ব-বিষয়ক বিভাগের পরিচালক ডা. জোনাথান ডাভিলা ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “খারাপ ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রয়োজন হয় ভিটামিন ডি। এর অভাবে নানান শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, এর মধ্যে মূত্রনালীর সংক্রমণও আছে।”
ভিটামিন ডি ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইডস’য়ের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে। পেপটাইডস হল এক ধরনের অণু যাতে এক বা একাধিন অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, এগুলো মিলিত হয়ে প্রোটিন তৈরি করে।
এই ব্যাখ্যা দিয়ে ডা. ডাভিলা বলেন, “ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করার জন্য ‘পেপটাইডস’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”
তাই ভিটামিন ডি’র স্বল্পতার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে মূত্রনালীতে সংক্রমণ ঘটায় এমন জীবাণু, যেমন- ই.কোলি’তে সহজেই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
বিভিন্ন গবেষণাতেও দেখা গেছে যে, যারা মূত্রনালীর সংক্রমণে ভোগেন, তাদের উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভিটামিন ডি’র স্বল্পতা রয়েছে।
মূত্রনালীর সংক্রমণ রোধ করতে কি পারে ভিটামিন ডি?
ভিটামিন ডি’র মাত্রার সাথে মূত্রনালীর সংক্রমণ হওয়ার সংযোগ থাকলেও, পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকলে কি এই রোগ থেকে পরিত্রাণ মিলবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. ডাভিলা বলেন, “কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার মাধ্যমে মূত্রনালীর সংক্রমণ থেকে বাঁচা যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করার মাধ্যমে।”
‘দি জার্নাল অফ ইউরোলজি’তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে, এমন তথ্যই প্রকাশ করা হয়েছে ২০২১ সালে। তবে কী পরিমাণে ভিটামিন ডি’র মাত্রা বাড়ালে এই উপকার মিলবে সে বিষয়টা এখনও পরিষ্কার নয়।
মূত্রনালীর সংক্রমণ রোধে অন্যান্য উপায়
“যদিও ২০২২ সালের নির্দেশনা অনুসারে ‘আমেরিকান ইউরোলজি অ্যাসোসিয়েশন’ ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট মূত্রনালীর সংক্রমণ রোধের ক্ষেত্রে সুপারিশ করে না। তারমানে এই নয় ভিটামিন ডি কার্যকর নয়। এই বিষয়ে গবেষণা এখনও চলছে”- মন্তব্য করেন ডা. ডাভিলা।
তাই এই রোগ প্রতিহত করতে আরও কিছু বিষয়ে সাবধাণ থাকার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
যৌন সঙ্গমের পর মূত্র ত্যাগ: শারীরিক মিলনের কারণে মূত্রনালীতে ব্যাক্টেরিয়া বৃদ্ধি পেতে পারে। আর মূত্রত্যাগের মাধ্যমে এই ব্যাক্টেরিয়া বের করে দেওয়া যায়।
অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ কমানো: অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করলে দেহে স্বাস্থ্যকর অনজীবের ভারসাম্য হারায়। ফলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
ডি-ম্যানোজ গ্রহণ: এই ‘মনোস্যাকারাইড’ (এক ধরনের কার্বোহাইড্রেইট) যা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে ফলে পাওয়া যায়। এর সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে মূত্রথলির দেয়ালে ব্যাক্টেরিয়া আটকে থাকা রোধ করতে পারে।
যখনই চাপ আসবে তখনই বাথরুমে যাওয়া: নিয়মিত প্রস্রাবের মাধ্যমে দেহের বর্জ্য বের হয়ে যায়। যা মূত্রনালীর সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি কমায়। তাই প্রস্রাবের বেগ পেলে চেপে না রেখে দ্রুত কাজ সারতে হবে।
হাত ও লিঙ্গ সঙ্গমের আগে পরিষ্কার করা: ভালো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার মাধ্যমে মূত্রনালীতে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায়।
নারী দের ‘ডুশ’ দেওয়া ও সুগন্ধিযুক্ত প্রসাধনী ব্যবহার কমানো: এগুলো গোপনাঙ্গে ব্যাক্টেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট করে।
সবসময় সামনে থেকে পেছনে ভালো মতো পরিষ্কার করা: এর ফলে অযাচিত ব্যাক্টেরিয়া পায়ুপথ থেকে যোনিপথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রোধ করা যায়।
সুতির অন্তর্বাস ব্যবহার করতে হবে: বাতাস চলাচল করতে পারে এরকম কাপড় ভেজা থাকে না। নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস সবসময় শুকনা রাখার অভ্যাস গড়তে হবে। কারণ ভেজা আর্দ্র অবস্থায় ব্যাক্টেরিয়া গজানোর পরিবেশ পায়।