শাশুড়ির সেবায় জুবাইদা রাজনীতিরও কেন্দ্রে

December 9, 2025
j1-9

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চলতি বছরের ৫ মে দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরেছিলেন ডা. জুবাইদা রহমান। এক মাস পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ৫ জুন তিনি ফের লন্ডনে ফিরে যান। গত ৫ ডিসেম্বর আবারও তিনি বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছেন।

ডা. জুবাইদা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিণী এবং দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় পুত্রবধূ। তবে এই মুহূর্তে তার পরিচয় কেবল পারিবারিক গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নেই। দেশের রাজনীতির মাঠে তিনি এখন অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি। যদিও তিনি এবার দেশে এসেছেন শারীরিকভাবে অত্যন্ত সংকটাপন্ন শাশুড়ি খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তবু তার এই আগমনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাধারণ মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই।

গত ৫ ডিসেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর থেকেই গণমাধ্যমের ক্যামেরা আর সাধারণ মানুষের দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে। বিমানবন্দর থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতাল, এভারকেয়ার থেকে ধানমন্ডিতে পৈতৃক নিবাস ‘মাহবুব ভবন’- সর্বত্রই যেন এক অদৃশ্য জুবাইদা-বন্দনা। দেশে আসার পর তিনি একবারও গণমাধ্যমের সামনে আসেননি, দেননি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যও, এমনকি দলীয় নেতাকর্মীদের ভিড়ও এড়িয়ে চলছেন সচেতনভাবে। তবুও তার এই ‘নীরব’ উপস্থিতিই যেন রাজনীতির মাঠে এক বড় বার্তা।

২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন দেশের রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া চলছিল, তখন স্বামী তারেক রহমানের সঙ্গে তিনিও পাড়ি জমিয়েছিলেন লন্ডনে। সেই যাত্রার প্রেক্ষাপট ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। দল এবং পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে, কারাগারে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙা অবস্থায় দেশ ছেড়েছিলেন তারেক রহমান। সেই সময় জুবাইদা রহমান কেবল একজন স্ত্রী হিসেবে নয়, বরং একজন চিকিৎসক হিসেবেও স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

লন্ডনে দীর্ঘ প্রবাস জীবনে জুবাইদা নিজেকে এবং তার পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়। রাজনীতি থেকে নিজেকে দৃশ্যত দূরে রেখে তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন স্বামী ও একমাত্র কন্যা জাইমা রহমানের দেখভালে এবং নিজের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের আজকের যে রাজনৈতিক পুনরুত্থান এবং দলের ওপর তার যে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ, তার পেছনে জুবাইদা রহমানের মানসিক সমর্থন ও পারিবারিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ডা. জুবাইদা রহমানের এবারের সফরের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন খালেদা জিয়া। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে লিভারসিরোসিস, হৃদরোগ, কিডনি ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছেন। ডা. জুবাইদা রহমান দেশে ফিরেই এভারকেয়ার হাসপাতালে ছুটে গেছেন শাশুড়ির চিকিৎসার তদারকি করতে। তিনি বর্তমানে খালেদা জিয়ার জন্য গঠিত দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছেন।

৫ ডিসেম্বরই খালেদা জিয়াকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল সহ্য করার মতো শারীরিক সক্ষমতা এই মুহূর্তে তার নেই বলে মেডিকেল বোর্ড মত দেওয়ায় সেই যাত্রা স্থগিত করা হয়েছে। একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডা. জুবাইদা রহমানের নিজস্ব জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। শাশুড়ির প্রতি তার এই মমতা এবং দায়িত্ববোধ তাকে সাধারণ মানুষের কাছে আরও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করেছে বলে মনে করছেন দলের নেতা-কর্মীরা।

ডা. জুবাইদা রহমান শুধু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত তারেক রহমানের স্ত্রী-ই নন। তার রয়েছে এক বর্ণাঢ্য পারিবারিক ঐতিহ্য। তিনি এমন এক পরিবারের সন্তান এবং এমন এক পরিবারের পুত্রবধূ, যারা দেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডা. জুবাইদা রহমানের বাবা ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান। তিনি কেবল একজন সামরিক কর্মকর্তাই ছিলেন না, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। তার সময়েই সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল বলে মন্তব্য করে থাকেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।

রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের বাবা আহমেদ আলী খান ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজ্ঞ। তিনি ১৯০১ সালে সিলেটের প্রথম মুসলিম হিসেবে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। অবিভক্ত আসাম আইনসভার সদস্য (এমএলএ) এবং আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন। জুবাইদার দাদী জুবাইদা খাতুন ছিলেন অবিভক্ত বিহার, আসাম ও উড়িষ্যার জমিদার পরিবারের সন্তান খান বাহাদুর ওয়াসিউদ্দিন আহমেদের কন্যা। দাদী জুবাইদা খাতুনের নামানুসারেই ডা. জুবাইদা রহমানের নামকরণ করা হয়েছে।

ডা. জুবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু দেশের একজন প্রখ্যাত সমাজসেবক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (স্বাধীনতা পদক) লাভ করেন। ইকবাল মান্দ বানু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ‘সুরভি’ নামক একটি বিখ্যাত স্কুল ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। ডা. জুবাইদার নানাবাড়িও অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত। তার মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু ফরিদপুরের বিখ্যাত ও অভিজাত সৈয়দ পরিবারের সন্তান। এই পরিবারটি ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে তৎকালীন সময় বেশ প্রভাবশালী ছিল।

অন্যদিকে, জুবাইদা রহমানের শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক বিশাল অধ্যায়। তার শ্বশুর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। শাশুড়ি বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। স্বামী তারেক রহমান বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

জুবাইদা রহমান কেবল পারিবারিক পরিচয়েই পরিচিত নন, তার নিজেরও রয়েছে ঈর্ষণীয় পেশাগত সাফল্য। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যান। লন্ডনের বিখ্যাত ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে তিনি কার্ডিওলজিতে মাস্টার্স অব সায়েন্স (এমএসসি) ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি ডিস্টিংশন বা বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন এবং স্বর্ণপদকও লাভ করেন।

রাজনীতির উত্তপ্ত ময়দান থেকে নিজেকে দূরে রেখে জুবাইদা রহমান চিকিৎসাবিদ্যায় মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তার এই পেশাগত সাফল্য তাকে কেবল একজন রাজনীতিকের স্ত্রী হিসেবে নয়, বরং একজন স্বাবলম্বী এবং মেধাবী নারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাধারণত পরিবারের সদস্যদের যোগ্যতার চেয়ে বংশপরিচয়কে বড় করে দেখা হয়। কিন্তু জুবাইদা রহমানের ক্ষেত্রে তার নিজের যোগ্যতাও সমানভাবে উজ্জ্বল। তার এই ‘মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত’ ইমেজটি তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।

এবারের সফরে জুবাইদা রহমানের মধ্যে অনেকেই খালেদা জিয়ার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা উঠেছে। তার পোশাক-পরিচ্ছদ এবং শান্ত-সমাহিত ভঙ্গি মানুষকে মুগ্ধ করছে। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে যদি বিএনপি সরকার গঠন করে এবং তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হন, তবে ডা. জুবাইদা রহমান হবেন বাংলাদেশের ‘ফার্স্ট লেডি’। যদিও সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকে ফার্স্ট লেডি বলা হয় না, তবুও আন্তর্জাতিক রীতি ও সম্মানের দিক থেকে তিনি সেই মর্যাদাই পাবেন। তাকে নিয়ে এখন থেকেই সেই আলোচনা শুরু হয়েছে বলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তারা বলছেন, ডা. জুবাইদা রহমান যদি ভবিষ্যতে ‘ফার্স্ট লেডি’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তবে তিনি হবেন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম মার্জিত ও শিক্ষিত ‘ফার্স্ট লেডি’।

সরাসরি রাজনীতিতে না জড়ালেও জুবাইদা রহমানের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বিএনপির জন্য এক বিশাল সম্পদ বলে মনে করেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মতে, জুবাইদা রহমানের ‘ক্লিন ইমেজ’ দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়ক হবে। অতীতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ ধোপে টেকেনি এবং তিনি সবসময় নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখেছেন। এই বিষয়টিই তাকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে বলে মনে করেন তারা।

বিশ্বের খুব কম দেশেই সম্ভাব্য ‘ফার্স্ট লেডি’ বা প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকে নিয়ে নির্বাচনের আগে বা সরকার গঠনের আগে এতটা আলোচনা বা প্রচার-প্রচারণা দেখা গিয়েছে। সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফার্স্ট লেডিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাই নির্বাচনের আগে তাদের নিয়ে আলোচনাও চলে। হিলারি ক্লিনটন বা মিশেল ওবামাকে নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই সে দেশের মানুষের আগ্রহ ছিল। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়, নেতাদের স্ত্রীদের নিয়ে এমন ইতিবাচক উন্মাদনা বিরল, যদি না তারা নিজেরা সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন।

ডা. জুবাইদা রহমানের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রম। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় নন, কোনো জনসভায় ভাষণ দেন না, তবুও তিনি আলোচনার কেন্দ্রে। তিনি গণমাধ্যমের সামনে কথা বলেন না বলেই হয়তো তাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল আরও বেশি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে সম্ভাব্য সরকারপ্রধানের স্ত্রীকে নিয়ে, যিনি রাজনীতির বাইরে, এতটা স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ দেখা গেছে কি না, তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রিন্সেস ডায়ানা বা কেট মিডলটনের মতো রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যে ধরনের পাবলিক ইন্টারেস্ট দেখা যায়, জুবাইদা রহমানের ক্ষেত্রেও এবার অনেকটা তেমনই ঘটছে।

ডা. জুবাইদা রহমানের বর্তমান অবস্থানকে কেবল ‘শাশুড়ির সেবা’ বা ‘পারিবারিক দায়িত্ব’-এর ফ্রেমে বেঁধে রাখার সুযোগ নেই বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। তিনি এমন এক সময়ে দেশে এসেছেন, যখন বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে নতুন এক ভোরের অপেক্ষায়। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের করিডোর থেকে ধানমন্ডির মাহবুব ভবন—জুবাইদা রহমানের প্রতিটি পদক্ষেপ এখন জাতীয় রাজনীতির মাঠে খুব মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেখানে উচ্চকিত স্লোগান আর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ঝড় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সেখানে ডা. জুবাইদার এই ‘নিঃশব্দ উপস্থিতি’ বিরল-ব্যতিক্রম নজির। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক মঞ্চে মাইক হাতে না নিয়েও কেবল ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা এবং পারিবারিক আভিজাত্য দিয়ে জনমানসে কতটা গভীরে পৌঁছানো যায়, জুবাইদা হয়তো সেটাই প্রমাণ করছেন।


Powered By vQsolution