জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে সংস্কারের অভাবই ধারাবাহিক লোকসানের কারণ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ২০২৪–২৫ অর্থবছরে লোকসানের নতুন রেকর্ড গড়েছে, আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে লোকসান পৌঁছেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থার প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা ছিল। অর্থাৎ এক বছরে লোকসান বেড়েছে ৮ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, বা প্রায় ৯৪ শতাংশ।
পিডিবির অডিটর প্রতিবেদনে লোকসানের এই চিত্র উঠে এসেছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের ভর্তুকি ব্যয়ের ওপরও বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকায়, আগের বছর যা ৩৮ হাজার ২৯০ কোটি টাকা ছিল।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই আর্থিক সংকটে ভুগছে। অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা, অদক্ষ বিদ্যুৎ ব্যবহার, উচ্চ উৎপাদন ব্যয় এবং আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা—এই সবকিছু মিলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব সমস্যার মূলে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা, যা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এই লোকসান সামাল দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, “বিদ্যুৎ খাত ঠিক করতে যে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার, বর্তমান সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।”
তার ভাষ্য, লোকসান কমানোর দুটি পথ রয়েছে। উৎপাদন ব্যয় কমানো অথবা খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো; কিংবা দুটোই একসঙ্গে করা। কিন্তু ক্ষমতায় এসে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, যা অর্থনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আবার উৎপাদন ব্যয়ও আগের মত উচ্চ পর্যায়ে রয়ে গেছে।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে একাধিকবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হলেও লোকসান কমেনি। বরং বিশেষজ্ঞরা ওভাবে মূল্যবৃদ্ধিকে ‘লুটপাটের হাতিয়ার’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এ খাতের গভীর কাঠামোগত সমস্যাগুলো উপেক্ষিতই থেকে গেছে।
এই ‘কাঠামোগত’ সমস্যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিদ্যুৎ চুক্তি, যার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি কিছু কোম্পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক বা না করুক, নিশ্চিত মুনাফা পেয়ে এসেছে। এই মুনাফার মূল ভিত্তি হল ক্যাপাসিটি চার্জ, যার আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী ও বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ১৫ শতাংশ পর্যন্ত নিশ্চিত মুনাফা পান, এমনকি কেন্দ্রটি বসে থাকলেও।
বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃত চাহিদা ও প্রবৃদ্ধির অসামঞ্জস্যের কারণে বহু কেন্দ্র দীর্ঘ সময় অলস পড়ে থাকে। তখনও সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইকোলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, আগের আওয়ামী লীগ সরকার যে পথে যাচ্ছিল, এখনো অনেকটা সে পথেই সব চলছে।
“জুলাই অভ্যুত্থানের পর নেওয়া কিছু পদক্ষেপে মনে হয়েছিল সরকার অতীতের ভুল থেকে সরে আসতে চায়, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখা গেছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ব্যবহার বৃদ্ধির পথ থেকে সরে আসা, পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল, জ্বালানি দক্ষতা নিশ্চিত করা কিংবা মেয়াদ শেষে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন না করার মত সুপারিশগুলোও সরকার আমলে নেয়নি।
পাশাপাশি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বাড়ানোর মত ঘোষিত সংস্কার পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই যে দায়মুক্তি আইন করেছিল, তার আওতায় দরপত্র ছাড়াই ইচ্ছামত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চুক্তি করে। সেই পুরো প্রক্রিয়া তদারক করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে, যিনি একইসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমার পেছনেও বিদ্যুৎ খাতের এ ‘লুটপাটের’ বড় ভূমিকা রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে, যা ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা আরও বাড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের প্রতি মেগাওয়াটের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ৩ টাকা, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের জন্য ৩ টাকা ৩০ পয়সা এবং তেলভিত্তিক কেন্দ্রের জন্য ২ টাকা ৫০ পয়সা।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, গত অর্থবছরে পিডিবির মোট রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি।
“এই ঘাটতির মানে হল, বিদ্যুৎ বিক্রির আয়ের পরও পিডিবি চালাতে অতিরিক্ত ওই অর্থ প্রয়োজন।”
২০২৩–২৪ অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে গৃহস্থালি গ্রাহকরা ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। মোট বিদ্যুৎতের প্রায় ৫৫ শতাংশই ব্যবহার হয় গৃহস্থালি খাতে। শিল্প খাতে বিদ্যুতের দাম উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বেশি হলেও অনেক শিল্প কারখানা গ্যাসচালিত নিজস্ব ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল।
দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভরতা কমানোর পরিকল্পনা নেয়। তবে শফিকুল আলমের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
এ বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর সময়ে মোট বিদ্যুতের ১১ দশমিক ৫ শতাংশ তেল থেকে উৎপাদিত হত। আগের বছরের একই সময়ে যা ১২ শতাংশ ছিল।
একই ধরনের সংকটে পাকিস্তান আগের চুক্তি পর্যালোচনার মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম কমিয়েছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়াতে ব্যাটারি এনার্জি স্টোরেজ ব্যবস্থায় বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার মত সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিকল্পনা আরও ব্যয়বহুল জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর প্রকল্পের দিকেই ঝুঁকছে। এমনকি হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া কো-ফায়ারিং ও কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির মত উচ্চ ব্যয়ের সমাধানও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
২০০৯ সালের আগে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশই ছিল সরকারি মালিকানার কেন্দ্রভিত্তিক। তখন বিদ্যুৎ সংকট তীব্র হলেও পিডিবির আনুষ্ঠানিক লোকসান ছিল কম।
আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর ভর করে উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ গুণের বেশি বাড়ানোর পর লোকসান দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০১০–১১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো পিডিবির লোকসান ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। গত ১৭ বছর ধরে পিডিবি টানা লোকসানের মধ্যেই আছে।
পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ এবং আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকার কোনো ভর্তুকি না দেওয়ায় প্রায় ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। নতুন কেন্দ্র যুক্ত হওয়াও লোকসান বৃদ্ধির আরেকটি কারণ।
তিনি বলছেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যেসব পদক্ষেপে নেওয়া হয়েছে, তাতে পিডিবির প্রায় ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।





