আর কত তাজা প্রাণ ঝরবে

Untitled-1-5c4ad33e0d8c5

সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়েন তারা। সকালেও ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই, সেই ঘুম আর ভাঙেনি। জীবিকার তাগিদে উত্তরের জনপদ নীলফামারী থেকে ছুটে আসা মানুষগুলো সব স্বপ্ন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। শনিবার সকাল ৬টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি কয়লাবাহী ট্রাক উল্টে ইটভাটার শ্রমিকদের থাকার ঘরের ওপর পড়ে। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণ হারান ১৩ শ্রমিক। এভাবে বেপরোয়া যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে শত প্রাণ; সেইসঙ্গে ভেঙে যাচ্ছে অনেক স্বপ্নও। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়কে ঘটছে এমন প্রাণহানির ঘটনা। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের মিছিল। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুর পাশাপাশি অনেকে হচ্ছেন পঙ্গুও। ২০১৮ সালে ৭ হাজার ২২১ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। আহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৪৬৬ জন।

সড়ক দুর্ঘটনা তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের বিভিন্ন সময় কেবল হুটহাট অভিযান পরিচালনা করেই দায়িত্ব শেষ করছে। একে অপরের ওপর দায়িত্ব দিয়ে সারছে দায়ও। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পরও দায়ী চালক থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় চালকরা নিজেদের শোধরাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৭ হাজার ২২১ জন নিহত হন। আহত ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। সংঘটিত দুর্ঘটনার ৪১.৫৩ শতাংশ গাড়িচাপা, ২৯.৭২ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬.৮৮ শতাংশ খাদে পড়ে, ০.৫৫ শতাংশ চাকায় ওড়না পেচিয়ে এবং ০.৮৯ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের কারণে হয়েছে। সংঘটিত দুর্ঘটনায় সর্বমোট ৭ হাজার ৩৫০টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ বাস, ২৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান, ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ কার মাইক্রোবাস, ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ অটোরিকশা, ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ৩.৫ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ৫.৮ শতাংশ নসিমন-করিমন ও হিউম্যান হলার সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।

সমিতির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপদজনক ওভারটেকিং, সড়ক-মহাসড়ক ও রাস্তা-ঘাটের নির্মাণ ক্রটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন উঠে পরা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, যানবাহনে অতি পণ্য বা যাত্রী বহন এবং সড়কে ছোট যানবাহনের সংখ্যা বাড়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরেছে সংগঠনটি। সেখানে বলা হয়েছে- ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন ও সড়ক ব্যবহার বিধিবিধান সম্পর্কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। একইসঙ্গে টিভি-অনলাইন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক সচেতনতামূলক বা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রাক্রসিং দেওয়া, চালকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যাত্রীবান্ধব সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতিগত উন্নয়ন-আধুনিকায়ন, জাতীয় মহাসড়কে কমগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা এবং লাইসেন্স নবায়নের সময় চালকদের জন্য ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করার কথা এসেছে তাদের সুপারিশে। সংসদে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানানোর পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সড়ক নিরাপত্তা তহবিল গঠনের সুপারিশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পরিবহন খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত না করতে পারায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া যথেষ্ট নয়। এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। বেপরোয়া চলাচলের মনোভাব কেন কমানো যাচ্ছে না, চাপ কেন কমানো যাচ্ছে না ও অসতর্কতা কেন থেকে যাচ্ছে এই তিনটি বিষয় আমাদের আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে জবাবদিহিতা বাস্তবতা তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘আমাদের সড়কে কখনোই শৃঙ্খলা ফিরবে না। কারণ, এখানে একটি দুষ্টচক্র কাজ করে। সড়কের ঠিকাদারদের যারা সুপারভাইস করে সেই ইঞ্জিনিয়ার, সড়কে শৃঙ্খলা যারা বজায় রাখে সেই পুলিশ, সড়কে যারা যানবাহন চালান সেই মালিক এবং শ্রমিক মিলে বিশাল দুর্নীতির দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের আগে দুটি আইন খুব তাড়াহুড়ো করে সংসদে পাস হয়। একটি ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, আর অন্যটি সড়ক পরিবহন আইন। দুটি আইন একই দিনে পাশ হয়েছিল সংসদে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন খুব দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করা হয়। কিন্তু সড়কের আইনটি কার্যকর করা হয়নি। কারণ, সড়কে যারা এ আইনের বিরোধিতা করে তাদের শক্তির কাছে মাথা নোয়ানো হয়েছে।’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও এ সমস্যা রোধে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। লোকদেখানো কিছু মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা ছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলো আর কিছুই করছে না। বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সভা-সেমিনারের আয়োজন করা হলেও সেখানে অধিকাংশ সময়জুড়ে থাকে নেতাদের বক্তৃতা। দপ্তরগুলোর মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়ও। অপরাধ করা চালকরাও থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকার নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রতিফল ঘটিয়ে সড়ক নিরাপত্তায় যথাযথ পদক্ষেপ নিলে আগামীতে সড়ক দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।’

Pin It