রূপকথার জগৎ থেকে উঠে এল বর্ণিল রাজত্ব, কখনো দেখা দিল প্রকাণ্ড দৈত্য দানো; কখনও আবার দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিল দুরন্ত কৈশোর। রঙিন প্রচ্ছদের সব বইয়ে কল্পনার রাজত্ব চলে এল হাতের নাগালে।
রূপকথার গল্প, দৈত্য-দানো ছেড়ে কেউ আবার ব্যাগে পুরে নিল অঙ্ক শেখার মজার কৌশল, ইতিহাস ও সাধারণ জ্ঞানের বই।
শুক্রবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রথম দুটি ঘণ্টা ছিল শিশু প্রহর। বেলা ১১টায় গ্রন্থমেলার দুয়ার খুলতেই পুরো প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে ওঠে খুদে পাঠকের পদভারে।
ছুটির সকালে মায়ের হাত ধরে, বাবার কোলে চড়ে নগরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এল খুদেদের দল। মেলা প্রাঙ্গণ দাপিয়ে বেড়িয়ে ঝোলা ভর্তি বই নিয়ে তবেই তারা ফিরেছে বাড়ি।
শিশুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে এদিন সিসিমপুরের স্টলে আসেন বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার ও তার স্ত্রী মিশেল অ্যাডেলম্যান।
ইউএসএইডের আমন্ত্রণে মেলায় এসে মিলার বলেন, “ভাবা যায়, জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল সিসিমপুর এখন তিন মিলিয়ন শিশুর কাছে পৌঁছেছে! আমি আর মিশেল ছোটবেলায় খুব কার্টুন দেখতাম। ”
তিনি বলেন, সিসিমপুর শুধু একটি টিভি সিরিয়াল নয়; এটা এখন ভাষা শিক্ষা, সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব শেখারও বড় মাধ্যম। এ সিরিয়ালে শেখাচ্ছে, কীভাবে সবাই মিলেমিশে একসাথে কাজ করা যায়।
শিশুদের উদ্দেশে এই কূটনীতিক বলেন, “তোমরা বেঁচে থাকবে আরও একশ বছর, তোমরা বেঁচে থেকো আরও দয়ালু হয়ে।”
রাজধানীর মতিঝিল থেকে তিন বছর বয়সী মুনতাসির মাহবুব মেলায় এসেছিল বাবা মাহবুব আলমের সঙ্গে।
মাহবুব আলম বলেন, “ওকে বর্ণমালা চেনাতে ছবির বই কিনে দিয়েছি। তাছাড়া বাংলার ষড়ঋতু, গ্রাম, নদী- চেনা যায় এমন সব ছবির বই কিনে নিয়েছি।”
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী আদিবা খাতুন জানাল, বাবা-মা সঙ্গে এলেও বই কেনা হয়েছে তার পছন্দ মত।
মা শাম্মি আক্তার বললেন, “কমিক বইয়ের দিকে শিশুদের ঝোঁক একটু বেশিই থাকে। তবে আমি পছন্দ করেছি বিজ্ঞানভিত্তিক বই। মজার ছলে বিজ্ঞান শেখার বইগুলো ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছি। এই বইগুলো মানের দিক থেকে মোটামোটি ভালোই লেগেছে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. তানভীর ইসলাম বলেন, “বাচ্চার বয়সটা যেমন, তাতে আসলে সায়েন্স ফিকশন বইগুলোই ওদের জন্য বেশি মানানসই। সেরকমই কিনেছি। আর বাচ্চারা তো একটু ভূতের গল্প বেশি পছন্দ করে।”
এই চিকিৎসক জানালেন নিজের ছোটবেলায় পড়া কয়েকটা কিশোর ক্লাসিক তিনি নিজের পছন্দে কিনে দিয়েছেন। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে বাচ্চাদের পছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
গ্রন্থমেলার অধিকাংশ শিশুতোষ বই বিদেশি গল্পনির্ভর হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করলেন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ তিতাস নামের এক অভিভাবক।
তিনি বললেন, “দেশি গল্প পেলাম খুব কম বইয়ে। এসব গল্প পড়ে আমাদের শিশুরা শিখবেটা কী? তাছাড়া শিশুদের বইয়ের দামও বেশ চড়া।”
বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, এবার বইমেলার প্রথম সাত দিনে শিশুসাহিত্যের বই প্রকাশ পেয়েছে মোট ৩০টি। শিশুদের মনের মতো বই প্রকাশের পাশাপাশি নান্দনিকতা এবং মানের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন কয়েকজন প্রকাশক।
আদিগন্ত প্রকাশনীর প্রকাশক মোস্তাক রায়হান বলেন, “শিশুদের বইয়ের ক্ষেত্রে সহজ বানান রীতি ও বাক্যের দিকে নজর থাকে আমাদের। আমরা বুঝি, বইয়ের প্রচ্ছদে শুধু রঙ দিলে তো হবে না, রঙের সাথে ভালো কিছুও তাদের দিতে হবে। সে বিষয়ে আমাদের নিজেদের এবং অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে আরও বেশি।”
পাতাবাহার প্রকাশনীর প্রকাশক মোস্তফা মান্না বলেন, “সবাই জ্ঞানের বই করে, আমরা করি আনন্দের জন্য। শিশু পড়ে যেন একটু হলেও আনন্দ পায়, ছবি দেখে আনন্দ পায়। কিছু বিজ্ঞানসম্মত দিকও যেন থাকে। বয়স অনুযায়ী বইটা যেন ধরতে পারে, নাড়াচাড়া করতে পারে। আকার, আয়তন, ওজন- সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়।”
শিশুদের জন্য বই লিখতে গেলে লেখকদের আরও বেশি গবেষণা করা দরকার বলে মত দেন এই প্রকাশক।
এবার একুশ পদকজয়ী কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক মনে করেন, শিশুদের জন্য সঠিক বই বাছতে গিয়ে অভিভাবকরা প্রায় সময়ই ব্যর্থ হচ্ছেন।
তিনি বলেন, “যে কোনো সাহিত্য একটি বাচ্চাকে গড়ে তুলবে। কিন্তু আমরা কি বাচ্চাদেরকে সেরকম ভালো সাহিত্য পড়াই? আমরা কি সত্যজিৎ পড়াই? আমরা কি সুকুমার পড়াই? আমরা কি এমন কোনো বই পড়িয়েছি যেটা পড়ে একটা বাচ্চার মনের ভেতরে তার পরিবার, তার পরিবেশ, তার দেশ, তার মানুষ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়বে?
“অনেক রকমের বই আছে আমাদের বাচ্চাদের জন্য। কিন্তু আমরা তো সেভাবে সচেতন নই। আমরা শুধু শিশুদের জন্য রঙিন বই খুঁজি।”
শিশুদের জন্য বই কিনতে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, “আমাদের বাচ্চাদের ভালো মানের বই কিনে দিতে হবে। যা ইচ্ছে তাই, বা সুন্দর রঙিন মলাট দেখে কিনে দিলাম, ভেতরে দেখা গেল কিছুই নেই, একটি শিশুর শিক্ষণীয় কিছুই নেই, তাহলে তো হবে না।”
বাচ্চাদের বই কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, “এমন নয় যে বইটি উপদেশমূলকই হতে হবে। বইয়ে একটি গল্পের মাধ্যমে শিশুকে তার পরিবেশ, পরিবার, সমাজ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এমনভাবে, যেন সে টেরও না পায় সে সচেতন হচ্ছে। আর এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা।”
শুক্রবার ছিল গ্রন্থমেলার অষ্টম দিন। এ দিন মেলায় এসেছে ২৬৩টি নতুন বই।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণে ছিল শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন চিত্রশিল্পী আবুল বারক আলভী। অংশ নেয় ৯১০ জন প্রতিযোগী।
বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে হয় ‘চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেন: জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আবুল মনসুর। আলোচনায় অংশ নেন মতলুব আলী এবং সৈয়দ আবুল মকসুদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রফিকুন নবী।