বনানীর ২৩ তলাবিশিষ্ট এফ আর টাওয়ারের ২১ তলার ফ্লোরে প্রায় অক্ষত একটি চেয়ার। সেই চেয়ারের ওপর নিথর বসে ছিলেন এক ব্যক্তি। চেয়ারের সঙ্গে তার ক্রাচটি দাঁড় করানো ছিল। শারীরিক প্রতিবন্ধী ওই ব্যক্তির চলাফেরায় ভরসা ছিল ওই ক্রাচ। এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর তিনি হয়ত চেয়ারে বসেই অপেক্ষা করছিলেন কখন কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসবে। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল এফ আর টাওয়ার থেকে উদ্ধার করে তার নিথর দেহ। পরে জানা গেছে তার নাম মঞ্জুর হাসান, বাড়ি নওগাঁয়।
বৃহস্পতিবারের ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিয়েছে মঞ্জুরসহ ২৫ জনের প্রাণ। স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়েছে ২৫টি পরিবারের। সবার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল দুপুরে ফায়ার সার্ভিস তাদের উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে পুলিশের কাছে ভবনটি হস্তান্তর করে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের যেসব সদস্য ওই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর ঘুরে দেখেছেন তারা বলছেন, ভবনটির সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশতলা পুরো ছাই হয়ে গেছে। এগারো ও বারো তলায়ও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অন্য সব ফ্লোরেও। সব মিলিয়ে আকাশচুম্বী এফ আর টাওয়ার এখন এক ধ্বংসস্তূপ। গতকাল ঘটনাস্থলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উৎসুক জনতা সেখানে ভিড় করেছেন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। আশপাশের প্রায় সব বহুতল ভবন ও দোকানপাট বন্ধ ছিল। এফ আর টাওয়ারে কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। দুর্ঘটনাস্থলে সিআইডির ক্রাইম সিনের রশি টানিয়ে রাখা হয়েছে। এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বলছেন, বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ-সংক্রান্ত সুপারিশ যারা বাস্তবায়ন করেনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। মনে হয়েছে এটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, তা তিনি যত প্রভাবশালীই হোন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ভবনটিতে যেসব অফিস ছিল তা দ্রুত মালিকদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। অগ্নিকাণ্ডে অনেক এসি পুড়েছে। সেগুলো নেটিং করা হবে যাতে সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, ভবনটি ১৮ তলা হওয়ার কথা অথচ হয়েছে ২৩ তলা। সেটাও ১৪ বছর আগে। তাহলে রাজউক এত দিন কী করেছে। এ ঘটনায় মামলা হবে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত আগুনের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটি কাজ করছে। সেটা সম্পন্ন হলে উৎস সম্পর্কে বলা যাবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তদন্ত শেষে নিরূপণ করা সম্ভব হবে।
আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি আরও বলেন, আধুনিক যে কোনো অফিসে এখন ভিনাইল বোর্ড ও জুট কার্পেট থাকে। ডেকরেটর ও ফলসও রয়েছে। শত শত কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী আছে। আগুনের সংস্পর্শে আসার পর এসব বস্তু থেকে তা দ্রুত ছড়াতে পারে। এফআর টাওয়ারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
মামলা হয়নি :এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। ভবন মালিক ও ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে পুলিশ জানায়, মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। এদিকে ভবনটিতে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দু’জন করে প্রতিনিধিকে গতকাল বিকেলে ক্ষয়ক্ষতি দেখার সুযোগ করে দেন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দু’জন করে প্রতিনিধিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের এসআই ও এএসআই পদমর্যাদার ২২ কর্মকর্তা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে যান। দুর্ঘটনার ঘটনায় মামলা হবে।
নিহতদের পরিচয় :এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ২৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। নিহতের মধ্যে ছয়জন নারী। আহত ৭০ জনের মধ্যে ২১ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মর্মান্তিক এই অগ্নিকাণ্ডে নিহতরা হলেন-মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের সৈয়দা আমিনা ইয়াসমিন (৪৮), বরিশালের উত্তর কড়াপুরের মনির হোসেন সর্দার (৫২), রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার বাসিন্দা মাকসুদুর রহমান (৩২), দিনাজপুরের কোতোয়ালির আবদুল্লাহ আল মামুন (৪০), রংপুরেরর পীরগঞ্জের মোস্তাফিজুর রহমান (৩৬), খুলনার তেরখাদার মিজানুর রহমান, রাজধানীর রূপনগর হাউজিংয়ের বাসিন্দা ফ্লোরিডা খানম পলি (৪৫), মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসিন্দা আতাউর রহমান (৬২), চাঁদপুরের দক্ষিণ নাগদার রেজাউল করিম রাজু (৪০), নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের আহাম্মদ জাফর (৫৯), নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের জেবুন্নেছা (৩০), মগবাজারের মধুবাগের সালাউদ্দিন মিঠু (২৫), টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের নাহিদুল ইসলাম তুষার (৩৫), বগুড়ার আদমদীঘির তানজিলা মৌলি (২৫), গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর পারভেজ সাজ্জাদ (৪৬), শ্রীলংকান নাগরিক নিরস ভিগনরাজা (৩৫), কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ইফতিয়ার হোসেন মিঠু (৩৭), যশোরের বেজপাড়ার শেখ জারিন তাসনিম বৃষ্টি (২৫), নারায়ণগঞ্জের ভুইগড়ের ফজলে রাব্বি (৩০), শরীয়তপুরের শোলপাড়ার আতিকুর রহমান (৪২), লালমনিরহাটের পাটগ্রামের আনজির সিদ্দিক আবির (২৭), রাজধানীর ডেমরার আব্দুল্লাহ আল ফরুক (৬২), নীলফামারীর জলঢাকার রুমকি আক্তার (৩০), নওগাঁর বোয়ালিয়ার মঞ্জুর হাসান (৪৯) এবং পাবনার আতাইকুলার আমির হোসেন রাব্বি (২৯)। নিহতদের মধ্যে শুধু জাফর আহমেদের লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। বাদবাকি লাশ পরিবারের সিদ্ধান্তে ময়নাতদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করা হয়।
তালাবদ্ধ ছিল এস্কেপ সিঁড়ি :এফ আর টাওয়ারের একাধিক ব্যবসায়ী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ব্যাপক ঘাটতি ছিল। ফায়ার এস্কেপ হিসেবে একটি লোহার সিঁড়ি থাকলেও, বিভিন্ন ফ্লোরে সেটি তালাবদ্ধ ছিল। ভবন থেকে বের হওয়ার সিঁড়ি অত্যন্ত সরু। ফায়ার সার্ভিসের ডিএডি খন্দকার আবদুল জলিল জানান, ভবনটিতে পাওয়া অধিকাংশ লাশ সিঁড়ি ও লিফটের সামনে ছিল। ১১ তলায় ৫টি লাশ পাওয়া যায়। ৭-২১ তলা পর্যন্ত লাশ ছিল। সংশ্নিষ্ট এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ১৯টি লাশ ভবন থেকে পাওয়া যায়। বাকিরা হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা গেছেন। ভবনটি পরিদর্শন করেছেন পুলিশের এমন একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ভবনের ভেতরে বিভিন্ন কার্যালয়ে পোড়া সব জিনিসপত্র এলোমেলো পড়ে ছিল। খোলা ল্যাপটপ, মানিব্যাগ, ডলার বা টাকা ও গুরুত্বপূর্ণ নথি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ওই ফ্লোরের চারদিকে শুধু রক্তের দাগ। চারদিকে মানুষের জুতা ও আসবাবপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। দেখলেই বোঝা যায় মানুষ বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল, শেষ পর্যন্ত তাদের অনেকেই বাঁচতে পারেননি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেঁচে ফেরা আসিফুর হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে গতকাল এফ আর টাওয়ারের সামনে যান। তিনি বলেন, নিচতলার একটি মোবাইলের দোকানের বিক্রয়কর্মী তিনি। আগুন লাগার পরপরই দোকানের তিন কর্মী বেরিয়ে আসেন। ভবনের বাইরে এসে দেখেন একজন ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ছেন। তাকে বাঁচাতে গিয়ে হাতে আঘাত পান তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত লাফিয়ে পড়া ওই ব্যক্তিকে বাঁচাতে পারেননি।
তদন্ত শুরু :দুর্ঘটনার ঘটনায় একাধিক সংস্থা পৃথকভাবে তদন্ত শুরু করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৯ সদস্যের কমিটি করেছে। পৃথক কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুলিশও তদন্ত করছে। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের বক্তব্য নিয়েছেন তদন্ত দলের সদস্যরা। এ ছাড়া ওই ভবনের ব্যবসায়ীদের বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে তদন্তে উঠে এসেছে, ১৮ তলা তৈরির অনুমোদন থাকলেও ভবনটি ২৩ তলা করা হয়েছে। ওপরের পাঁচ তলাই অবৈধভাবে নির্মাণ করা। অবৈধ ফ্লোরগুলোর মালিক কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাসভির উল ইসলাম। পাশাপাশি তিনি কাশেম ড্রাইসেল কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নির্বাহী কর্মকর্তা। জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে ভবনটির ভূমি মালিক ইঞ্জিনিয়ার এস এম এইচ আই ফারুক হোসেন ও রূপায়ণ গ্রুপ যৌথভাবে নকশা অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। তখন রাজউক কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১৮ তলা ভবন নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদন দেয়। যৌথ মালিকানা হওয়ায় ভবনটির নাম তখন দেওয়া হয় ফারুক-রূপায়ণ টাওয়ার; সংক্ষেপে এফ আর টাওয়ার। রূপায়ণ পরে তাদের মালিকানায় থাকা বিভিন্ন ইউনিট বিক্রি করে দেয়। সব মিলিয়ে ২৩ তলা ওই ভবনের সব ইউনিটের মালিক এখন ফারুকসহ মোট ২৪ জন। বিভিন্ন ফ্লোর তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। গতকাল সরকারের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও বলেছেন, অবৈধভাবে ভবনটিতে বাড়তি পাঁচতলা তৈরি করা হয়েছিল। এসব যাদের দেখভালের কথা তারা এতদিন কোথায় ছিলেন? ভবনটি নিয়ে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ ও জমির মালিক ফারুকের মধ্যে ঝামেলা চলছিল বলে তথ্য পুলিশ পেয়েছে।
এফ আর টাওয়ারে যেসব প্রতিষ্ঠান :খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এফ আর টাওয়ারে অন্তত ২৯ প্রতিষ্ঠান ছিল। সেখানে ছিল কয়েকটি রেস্টুরেন্টও। ১১ তলায় ফ্রুগাল লগ লিমিটেড, ইসিইউ লাইন বিডি, এআই ফ্রেইট সার্ভিস, আসিফ ইন্টারন্যাশনাল, লিয়ায়েন্স গ্লোবাল লজিস্টিকস, ফনিক্স ইন্সুরেন্স কোম্পানি, ১৬ তলায় মাইকা ট্রাভেলস, জনতা অয়েল মিলস লিমিটেড, অষ্টম তলায় এম্পায়ার গ্রুপ, ২১, ২২ ও ২৩ তলায় কাসেম ফুড প্রোডাক্টস ও কাসেম ড্রাইসেল, ২০ তলায় ভার্চুয়াল রুম সার্ভিসের প্রতিষ্ঠান দ্য ওয়েভ। পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ডার্ড গ্রুপের কার্যালয় রয়েছে ৩, ১৩, ১৭ ও ২০ তলায়। নিচ তলায় শাওমির ডিলারশপ ও গেজেট জোন নামে একটি মোবাইলের সামগ্রীর শো রুম, মানি এক্সচেঞ্জ, দ্বিতীয় তলায় ট্রাভেল এজেন্সি ভিভিড হলিডে লিমিটেড, কিন্ডারড ক্যাফে অ্যান্ড বেকারি, প্রীতম বার্গার শপ, ফ্রাইওয়ে রেস্টুরেন্ট, বাটার বেকারি এবং আমেরিকান ডেইরি। তৃতীয় তলায় রোজডেল ব্যাঙ্কোয়েট হল ও বারবেল জিম। পঞ্চম তলায় ডেন্টাল ক্লিনিক ডেনটোটাল, আট তলায় বায়িং হাউজ স্পেকট্রা লিমিটেডের কার্যালয়। ৫, ৯, ১৭ ও ১৮ তলায় রয়েছে আমরা টেকনোলজিস।।