ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি, সব জমি দখলমুক্ত না হওয়া, স্থানীয় সন্ত্রাসীদের উপদ্রবসহ বেশ কিছু কারণে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সম্প্রতি বহুল আলোচিত এ প্রকল্পে সরেজমিন পরিদর্শন করে পূর্বাচল নতুন শহর বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করে। ২০০৪ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এত দেরি হওয়ার কারণে প্রশ্ন উঠছে, বহুল প্রত্যাশিত পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আর কতদূর?
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে এ পর্যন্ত ১০ পরিচালক কাজ করেছেন। তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবেই এ পদে বসানো হয়। ঘন ঘন বদলি এবং অনিয়মিতভাবে দায়িত্ব পালন গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটির বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করেছে। পরিকল্পনা বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পে নিয়মিত প্রকল্প পরিচালক পদায়ন করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এ প্রকল্পে তা মানা হয়নি। ১০ জনের মধ্যে ১০ জনই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের কাজ করছেন। কখনও গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) আবার কখনও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে এ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আইএমইডির কর্মকর্তারা জানান, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন এমন কর্মকর্তাদের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দিতে গত ১০ বছর ধরে পরিকল্পনা কমিশন ও আইএমইডি থেকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ প্রকল্পে তা মানা হয়নি। নতুন পরিচালক এসে দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগে যায়, যা বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি করে।
প্রকল্পটির মূল প্রস্তাবে ১৯৯৫ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের জুন নাগাদ বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন হয় ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। শুরুতেই ১০ বছর পর দেরিতে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রথমে ব্যয় ধরা হয় তিন হাজার ৩১২ কোটি টাকা। পরে চারবার প্রকল্প সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধনে ব্যয় ধরা হয়েছে সাত হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। গত জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ব্যয়ের পরিমাণ তিন হাজার ২৩১ কোটি টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৪২ শতাংশ। প্রকল্পের মোট ২৫ হাজার ১৬টি প্লটের মধ্যে ১৫ হাজার প্লট গ্রাহকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখনও ১০ হাজার ১৬টি প্লট হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।
আইএমইডি বলেছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে ছয় হাজার ২২৭ কোটি একর ভূমি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ করা ভূমি রাজউকের কাছে সরেজমিন দখল হস্তান্তর করবে। তবে এখনও পর্যন্ত গাজীপুর জেলা অংশে প্রায় এক হাজার ৫০০ একর ভূমি বুঝে পায়নি রাজউক। এদিকে প্রকল্পের অনুমোদনকালে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অবস্থানগত ছাড়পত্র পাওয়া গেলেও পরিবেশগত ছাড়পত্র এখনও পাওয়া যায়নি। এ সংক্রান্ত মামলা চলমান থাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এ ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পে ঠিকাদারদের কাজে বাধা দিচ্ছে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। প্রকল্প এলাকায় কোনো পুলিশ না থাকায় প্রকল্পে নিয়োজিত জনবল ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে নিরাপত্তা পাচ্ছে না। এ কারণে প্রকল্পে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে ঠিকাদাররা জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রকল্পের রূপগঞ্জ এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা ২০০ থেকে ২৫০টি প্লটের আবেদন করে। কিন্তু রাজউক তাদের প্লটের আবেদন বিবেচনায় নেয়নি। এতে স্থানীয় আদিবাসী এবং জনপ্রতিনিধিদের বাধার মুখে পড়েছে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ। এ সমস্যার সমাধানে রাজউক ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। কিন্তু এখনও এর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী মো. আমির হোসেন সমকালকে বলেন, স্থানীয়দের বাধার মুখে বাস্তবায়ন কাজ বিলম্বিত হয়েছে। তবে জমি হুকুম দখলের দায়িত্ব নৌবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে নৌবাহিনী কাজও শুরু করেছে। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঠিকাদাররা বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অভিযোগ করেন। সন্ত্রাসীদের কারণে কখনও কখনও কাজ বন্ধ থাকত। তবে সন্ত্রাসীদের সমস্যা এখন অনেক কমে এসেেেছ।
ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন প্রসঙ্গে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, বড় প্রকল্প হওয়ার কারণে সিনিয়র প্রকৌশলীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অনেকে অবসরে গেছেন। এ সমস্যার কারণে ঘন ঘন পরিচালক নিয়োগ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া প্রকৌশলীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণে একেকজনকে একাধিক প্রকল্পে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এ কারণে স্থায়ীভাবে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া যায়নি।
প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক সমকালকে জানান, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৪১ শতাংশ হলেও বাস্তব কাজের অগ্রগতি অর্ধেকেরও বেশি। এখন ভূমি দখল পাওয়া গেলে বাস্তবায়ন কাজ ২০২০ সালের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে। তিনি আরও জানান, প্রতিদিনই প্লট হস্তান্তরের কাজ চলছে। ভূমি উন্নয়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ড্যাপ এলাকাভুক্ত ঢাকা জেলার খিলক্ষেত থানার ১৫০ একর, গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার এক হাজার ৫০০ একর এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার চার হাজার ৫৭৭ একর অর্থাৎ ছয় হাজার ২২৭ একর জমি নিয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প গড়ে উঠছে। প্রকল্পের পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী, পশ্চিমে বালু এবং উত্তরে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর সংযোগ খাল। এতে আবাসিক প্লট হিসেবে ৩৮ দশমিক ৬০ শতাংশ, সড়ক ও ফুটপাতের জন্য ২৬ শতাংশ, ইউটিলিটি ও অন্যান্য ১৬ শতাংশ, ক্রীড়া ও পার্ক বনায়নের জন্য ১১ শতাংশ এবং লেক ও খালের জন্য ৮ শতাংশ ভূমি নির্ধারণ করা হয়েছে।