দীর্ঘ ২৮ বছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে নানা দায়িত্ব পালন করে আসছেন সরকারি কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। বর্তমানে তিনি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব। কয়েক বছর আগে আবাসন পরিদপ্তরে সরকারি বাসা বরাদ্দ পেতে আবেদন করেন তিনি। একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবের সঙ্গে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শিগগির বাসা পাওয়ার আশ্বাসও পেয়েছেন। এভাবেই পেরিয়ে গেছে তার প্রায় চারটি বছর।
এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, এখনও সরকারি বাসা বরাদ্দ পাইনি। লিখিতভাবে আবেদন করেছি। হয়তো পাওয়া যাবে। তবে কবে, তা নিশ্চিত নয়।
শুধু মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার নন, একইভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের পরিচালক (যুগ্মসচিব) মো. হাফিজুর রহমান এবং বিসিএস (কর) একাডেমির যুগ্ম পরিচালক আয়েশা সিদ্দিকা শেলী গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিনের চেষ্টায়ও কোনো বাসা বরাদ্দ পাননি। কয়েক লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজধানীতে চাকরি করলেও তাদের বাসস্থান সুবিধা নেই। আবেদন করেও বাসা পাননি এমন কর্মকর্তা অর্ধলাখ।
অথচ এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছেন, যারা একাধিক সরকারি বাসা ব্যবহার করছেন। তুলনামূলক ভালো কোনো বাসার সন্ধান পেলেই বাসা পাল্টাচ্ছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. আহসান কবীর ও অর্থ বিভাগের স্ট্রেনদেনিং পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট ফর সোশ্যাল প্রটেকশন (এসপিএফএমএসপি) প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক (যুগ্মসচিব) ড. মো. ফেরদৌস হোসেন ইস্কাটন গার্ডেন সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারে বসবাস করছেন। এরপরও ইস্কাটন গার্ডেনের রজনিগন্ধা/অপরাজিতা ভবনে সুপিরিয়র টাইপ বাসা চেয়ে আবেদন করেছেন।
আবার সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব শরীফ মো. ফরহাদ হোসেন ২০১৭ সালের ৫ জুন ধানমণ্ডির শিমুল-৯ (এফ টাইপ) বাসা বরাদ্দ পেয়েও উঠতে পারেননি। কারণ বরাদ্দ পাওয়ার প্রায় দুই বছর পরও বাসাটি খালি হয়নি। উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে ভাড়া বাসায় থেকে তিনি অফিসে আসা-যাওয়া করছেন। নতুন করে বাসার জন্য আবেদন করলেও বরাদ্দ পাননি তিনি।
গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত সরকারি বাড়ি ভেঙে নতুন বহুতল ভবনও নির্মাণ করা হচ্ছে। সচিব ও গ্রেড-১ কর্মকর্তাদের জন্য ইস্কাটন গার্ডেনে নতুন ১১৪টি সুপিরিয়র টাইপ বাসার কাজ শেষ হয়েছে। নতুন প্রকল্পগুলো শেষ হলে অনেক কর্মকর্তার আবাসন সমস্যা কেটে যাবে। তিনি বলেন, বাসা বরাদ্দে স্বচ্ছতা আনতে আবাসন পরিদপ্তরের কার্যক্রমে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি বাসা পাওয়ার প্রলোভনে এক পর্যায়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের টাকাও দিয়েছেন। অথচ বরাদ্দ পাননি। আবার এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন, রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকায় তারা আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে বাসা পেয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে কেউ অবসরে গেলেও বাসা ছাড়ছেন না। মারা গেলেও বাসা ব্যবহার করছেন তাদের আত্মীয়স্বজন বা ছেলেমেয়েরা। সংশ্নিষ্ট দপ্তর জানার পরও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চাহিদার তুলনায় সরকারি বাসা খুবই কম। ফলে যিনি যত শক্ত লবিং করতে পারেন, তিনি তত দ্রুত বাসা বরাদ্দ পান।
এর ফলে সরকারি আবাসন পরিদপ্তরকে প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। মন্ত্রী-এমপি বা সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে বাসা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করছেন। তারপরও আবাসন পরিদপ্তর তাদের বাসা দিতে পারছে না। কোনো বাসা খালি হওয়া মাত্র মন্ত্রী বা প্রভাবশালী কর্মকর্তার সুপারিশ নিয়ে সেটির জন্য আবেদন করছেন অনেকে। এমনও দেখা গেছে, একই বাসার জন্য একজন মন্ত্রী তিন-চারজনের আবেদনপত্রে সুপারিশ করেছেন!
বর্তমানে দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৬২ হাজার ২৯৮ জন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন মাত্র ১০ শতাংশ। ৯০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীই এই সুবিধার বাইরে। যারা সরকারি বাসা পাননি তারা প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া ভাতা পাচ্ছেন। তবে সরকারি বাড়ি ভাড়া ভাতা নিয়ে সন্তুষ্ট নন তারা।
একাধিকবার আবেদন করে বাসা না পাওয়া এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সরকারি বাসা যেন সোনার হরিণ। বারবার আবেদন করেও কোনো বাসা পাওয়া যায় না। ঢাকায় চাকরি করে আবাসন সুবিধা না পেলে চলাফেরাই অসাধ্য। কারণ বেতন যা পাওয়া যায় তার অর্ধেকের বেশিই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। এ অবস্থায় ঢাকায় চাকরি করে আবাসন সুবিধা না পাওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংসার চালানোর জন্য আয়-উপার্জনের অন্য উপায় বেছে নেন।
এ প্রসঙ্গে সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের পরিচালক শেখ আতাহার হোসেন সমকালকে বলেন, গত ৪০ বছরে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ঢাকায় নতুন কোনো ভবন নির্মাণ হয়নি। প্রতিদিন বাসার জন্য তার দপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভিড় জমান। কিন্তু তার করার কিছু নেই। তিনি বলেন, আবাসন পরিদপ্তর বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। কারণ, রাজধানীতে মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ কর্মকর্তার আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ৭০০ বাসা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় চার লাখ সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন। অথচ বাসা আছে মাত্র প্রায় ১৫ হাজার। এসবের মধ্যে আট হাজার এ, বি ও সি টাইপের বাসা। এগুলো তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত। প্রথম শ্রেণির ক্যাডার, নন-ক্যাডার ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য রয়েছে ছয় হাজার ৯৮৮টি বাসা। এসবের মধ্যে ৪৯টি বাংলো, ২০টি মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট ও ২১২টি সুপিরিয়র শ্রেণির। এগুলো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কর্মকর্তা) বরাদ্দ দেওয়া হয়। এগুলো বাদ দিলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য ডি, ই ও এফ টাইপের বাসা থাকে ছয় হাজার ৭২৭টি। অথচ এই দুই শ্রেণির কর্মকর্তা রাজধানীতে রয়েছেন প্রায় অর্ধলাখ। ফলে তাদের বাসা পেতে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ ছাড়া কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব প্রায় দুই হাজার বাসা রয়েছে।
এর মধ্যে ডি-১, ডি-২, ই, এফ ও সুপিরিয়র টাইপ এবং বাংলো ও মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্টের বাসা বরাদ্দ দেয় পরিদপ্তর। এ, বি এবং সি টাইপ বাসাগুলো বরাদ্দ দেয় সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়। ডি-১ ও ডি-২ টাইপের বাসায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা বসবাস করেন। ডি-১-এর অনেক বাসায় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা বসবাস করছেন। এছাড়া ই, এফ ও সুপিরিয়র টাইপের বাসায় সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা বসবাস করছেন। এ ক্ষেত্রেও যার যত লবিং সুবিধা, তিনি তত ভালো বাসা বরাদ্দ পাচ্ছেন। এফ টাইপের ২০১টি, ই ৭৬০টি, ডি-১ এক হাজার ১৮২টি, ডি-২ তিন হাজার ৬০০টি বাসা রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে অস্থায়ী পূর্ণ ভাড়া ২৬৬টি, অস্থায়ী নির্ধারিত ৪৫০টি এবং সংরক্ষিত পরিত্যক্ত ২৪৮টি বাসা।
বাসা বরাদ্দ না পাওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, বাসার স্বল্পতা রয়েছে। আবার এক ব্যক্তি একাধিক বাসা ব্যবহার করছেন, এ কথাও সত্য। কারা একাধিক বাসা ব্যবহার করছেন জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, যাদের মাঠ প্রশাসনে পোস্টিং হচ্ছে, ঢাকায় সরকারি বাসা থাকলে তাদের বেশিরভাগই ওই কর্মস্থলে যাওয়ার আগে বাসা ছাড়ছেন না। তারা পরিবার নিয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিলেও সরকারি বাসায় আত্মীয়স্বজন বা স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের সরকারি বাসায় রেখে যান। আবার নতুন কর্মস্থলে গিয়ে নতুন সরকারি বাসা পান। অথচ নিয়ম রয়েছে, মাঠ প্রশাসনে পোস্টিং হলে ঢাকায় সরকারি বাসা থাকলে তা ছেড়ে যেতে হবে।
আবাসন পরিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি বাসায় থাকার ব্যাপারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগ্রহ কম। কারণ বেতন থেকে যে অর্থ বাসা বাবদ কেটে নেওয়া হয়, ওই অর্থে সরকারি বাসার চেয়ে ভালো বাসায় থাকা সম্ভব। মফস্বল পর্যায়ে অনেক সরকারি বাসা খালি পড়ে থাকে। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের চিত্র ভিন্ন।
পরিদপ্তরে বাসা বরাদ্দের তদবির করতে এসে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একটি বাসার জন্য একজনকে এক লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে দেড় বছর ধরে ঘুরছি। অথচ বাইরে বাসা ভাড়া করে থাকতে গিয়ে প্রায় পুরোটাই চলে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, সরকারি সব কার্যক্রম এখন ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে সরকারকে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। এরপর কর্মকর্তাদের আবাসন ব্যবস্থার পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে বর্তমানে সরকারি কলোনিগুলোতে কোনোভাবেই আট থেকে ১০ তলার বেশি ভবন নির্মাণ করা ঠিক হবে না। কারণ তাতে সরকারি কলোনি মানসম্মত হবে না। তিনি বলেন, মফস্বলের অনেক সরকারি বাসা খালি থাকে। বেশি বেতন কাটা পড়ায় অনেক কর্মকর্তাই সেসব বাসায় থাকছেন না। এসব দিকও সঠিকভাবে বিবেচনা করা দরকার।