জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি হতে লবিং-তদবির ও দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে বিএনপিতে। শীর্ষনেতাদের কাছে সাংগঠনিক যোগ্যতা ও রাজনৈতিক ভূমিকা তুলে ধরে মনোনয়ন চাইছেন তারা। রাজনৈতিক দক্ষতা ও যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করা হলে মনোনয়ন পাবেন, এমন প্রত্যাশাও করছেন বেশ কয়েকজন নারী নেত্রী। দলের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে গত সোমবার ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শরিক নেতাদের জানান, সংরক্ষিত নারী আসনে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। তবে নির্দিষ্ট কারও নাম জানাননি তিনি। ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়। নারী এমপি মনোনয়নের বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের কোনো নেতা মন্তব্য করতে রাজি হননি। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, সংরক্ষিত আসনের নারী এমপি নিয়ে দলীয় ফোরামে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না।
তবে গত শনিবার জাতীয় সংসদে বিএনপির এমপিদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি মনোনয়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তাদের কাছে দলের হাইকমান্ডের দেওয়া সর্বশেষ তালিকার শীর্ষে রয়েছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ও নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী। দলের যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ এমপির স্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সাবেক এমপি সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়াও রয়েছেন আলোচনায়। একজন এমপি জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পছন্দের তালিকায় চারজন প্রার্থী রয়েছেন। যাদের মধ্যে আফরোজা আব্বাসও রয়েছেন। তবে আশিফা আশরাফী পাপিয়ার নাম এই তালিকায় নেই।
গত বুধবার নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বিএনপির একটি নারী আসনের জন্য তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল অনুযায়ী, ২০ মের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ২১ মে, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৮ মে এবং ভোট ১৬ জুন।
এদিকে সংসদে যোগ দেওয়া হারুনুর রশীদ চাইছেন তার স্ত্রী পাপিয়াকে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি করতে। এ ব্যাপারে তিনি দলের অন্য চারজন এমপিকেও অনুরোধ করেছেন। আশিফা আশরাফী পাপিয়া আগেও সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়ে সংসদে দলের পক্ষে ভালো ভূমিকা রেখেছেন। তবে রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে পাপিয়ার সম্ভাবনা শীর্ষ নেতারা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন।
আবার জিয়াউর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথির অনুসারীরা চাইছেন এ আসনে তার মনোনয়ন নিশ্চিত করতে। সিঁথিকে সরাসরি রাজনীতিতে আনার লক্ষ্যে তারা পরিকল্পিতভাবে বেশ কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। তাদের এ পরিকল্পনার কথা এরই মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও জানানো হয়েছে। তবে দলের হাইকমান্ড স্পষ্ট জানিয়েছে, সংরক্ষিত আসনে জিয়া পরিবারের কাউকে নেওয়া হবে না।
তবে সিঁথির অনুসারীদের মধ্যে জাতীয় সংসদে শপথ নেওয়া একজন প্রভাবশালী বিএনপি এমপিও রয়েছেন। তাই দলের হাইকমান্ডের পক্ষে তার অনুসারীদের মতামতকে উপেক্ষাও করাও সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে সিঁথির বদলে তাদের পছন্দেরই অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করা হতে পারে।
এরকম বাস্তবতায় বিএনপির ভেতর চলছে নানা সমীকরণ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কোনো কারণে বিএনপিতে দলীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে পাঁচ এমপির মতবিরোধ হলে সংরক্ষিত একটি নারী আসনের বিপরীতে বিএনপিতে একাধিক প্রার্থী হতে পারে। অর্থাৎ ভোটের প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির এমপিরা যাকে চাইবেন তিনিই দলীয় সংরক্ষিত আসনের এমপি হবেন। অন্যদিকে দল সিদ্ধান্ত নিয়ে একক প্রার্থী দিতে পারলে ভোটাভুটির প্রয়োজন হবে না। তবে সিনিয়র নেতারা এ-ও মনে করছেন, এক্ষেত্রে তারেক রহমান যাকে মনোনয়ন দেবেন তিনিই সংরক্ষিত আসনের এমপি হবেন।
দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানান, বিএনপি অনেকটা বাধ্য হয়ে সংসদে শপথ নিয়েছে। নারী আসন নিয়েও তাদের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। তবে দলীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ও নিপুণ রায় চৌধুরী। কারণ আইনজ্ঞ রুমিনের রয়েছে যেমন বাকপটুতা, তেমনি নিপুণের রয়েছে রাজপথের আন্দোলনের সক্ষমতা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা রুমিন ফারহানা বিএনপির কূটনৈতিক উইং শাখায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। টিভি টক শোসহ দলের বিভিন্ন সেলেও কাজ করছেন।
অন্যদিকে নিপুণ রায় চৌধুরীও এসেছেন রাজনৈতিক ঐতিহ্যসম্পন্ন পরিবার থেকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ নিপুণ রায় চৌধুরীর বাবা একই দলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী।
পারিবারিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাসও সংরক্ষিত আসনের জন্য আলোচিত হচ্ছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। গত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মির্জা আব্বাসের প্রচারাভিযানে ভূমিকা রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আস্থাভাজনও হয়েছেন তিনি।
সংরক্ষিত এমপি হিসেবে আরও আলোচনায় রয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও নির্বাহী কমিটির সদস্য জেবা খান।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা জানান, সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে দলের কোনো সিদ্ধান্ত জানা নেই তার। অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী বলেন, দলের স্বার্থে এবং সিদ্ধান্তে যে কোনো জায়গায় তিনি কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
সংবিধান অনুসারে, ৩০০ আসনের বিপরীতে ৫০টি সংরক্ষিত আসন বণ্টন করা হয়। এ ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন সংসদ সদস্যের বিপরীতে একজন নারী সদস্য নির্বাচিত করা হন। স্বতন্ত্র সদস্যদের ক্ষেত্রেও একই অনুপাত অনুসরণ করা হয়। একটি দল যতটি নারী আসন পাবে, নির্বাচনে ততজনই প্রার্থী দিলে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। একাধিক প্রার্থী থাকলে তফসিল অনুসারে ভোটের মাধ্যমে এমপি নির্বাচন করা হয়। নিয়মানুসারে বিএনপির পাঁচজন নির্বাচিত এমপির বিপরীতে একটি আসন খালি রয়েছে। এ ছাড়া সংরক্ষিত নারী আসনের ৫০ জন এমপির মধ্যে ৪৯ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এরই মধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন।