বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ ও আমানতের সুদের হার এক অংকে নামিয়ে না আনলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
নতুন অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সমালোচনাকে ‘ভালো না লাগা পার্টির অসুস্থতা’ হিসেবে বর্ণনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
সংবাদমাধ্যমের মালিকদের কার কত খেলাপি ঋণ আছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
কালো টাকা সাদা করা, কৃষি খাতের প্রণোদনা, কর্মসংস্থানের পরিকল্পানাসহ বাজেটের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন সরকারপ্রধান।
‘সমৃদ্ধ আগামীর’ প্রত্যাশা সামনে রেখে নতুন অর্থবছরের জন্য সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তিনি অসুস্থ থাকায় শুক্রবার বিকেলে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুরুতে তিনি এবারের বাজেটের বিভিন্ন দিক এবং সরকারের পরিকল্পনার কথা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। পরে শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব।
ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ ও আমানতে ৬ শতাংশ করার বিষয়ে ব্যাংক মালিকরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনেন এক সাংবাদিক।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “ব্যাংকের যে সমস্যাটা, আমরা সবসময় চেষ্টা করেছি যেন সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। আর এই সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার জন্য আমরা কতকগুলি সুবিধাও দিলাম। কিন্তু অনেক বেসরকারি ব্যাংক সেটা মানেনি।
“এবারের বাজেটে সেটা বলাই আছে, নির্দেশনাও আছে। এ ব্যাপারে আমাদের একটা কঠোরা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের এই নিয়মটা মেনে চলতে হবে যেন ঋণটা সিঙ্গেল ডিজিটে হয়। কোনোমতেই যেন ডাবল ডিজিটে না যায়।”
ঋণের সুদের হার কেন কমছে না তা নিয়ে গত মার্চে এক অনুষ্ঠানে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বেশ কিছু সুযোগ সুবিধাও করে দিলাম। যেমন আগে আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগ অর্থ সরকারি ব্যাংকে আর ৩০ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হত। ব্যাংকের মালিকরা বললেন ‘এটা যদি ফিফটি ফিফটি করে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা (সুদের হার) সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনব ‘।”
ঋণের সুদের হার এক অংকের ঘরে এলে বিনিয়োগ বাড়বে বলে সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় নিয়েও নিজের ভাবনার কথা বলেন।
“এত বেশি চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ হতে থাকলে মানুষ ব্যবসা করতে পারে না। সেদিকটা আমরা বিশেষভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এ বিষয়টি বাস্তবায়নে আইনও সংশোধন করা হবে।”
খেলাপি ঋণ নিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর বেকায়দায় থাকার প্রসঙ্গ টেনে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “হ্যাঁ, সেটা আমি জানি। এমন খুব বেশি চাপে আমরা নাই। এটা নিয়ে প্রায়ই আমরা মিটিং করি। সরকারি ব্যাংক নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।”
এবারের বাজেট কেমন হয়েছে জানতে চাওয়া হলে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি একটা কথাই বলতে পারি, এটা জণকল্যাণমূলক বাজেট।
আর সবার শেষে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় বাজেটের উপর খুব বেশি কিছু বলার আপনাদের নাই। কারণ বাজেট এমনভাবে করে দিয়েছি যা সব মানুষেরই কাজে লাগবে। এই বাজেট যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, সে ব্যাপারে সবাই আন্তরিকতার সাথে কাজ করবেন।”
এ সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত; যিনি এর আগে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারে টানা ১০টি বাজেট দিয়েছেন।
এছাড়া শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূইয়া ছিলেন মঞ্চে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার।
অর্থপাচার ও কালো টাকা
অর্থপাচার যেন না হয় সেজন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছেন- এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ বাংকের আলাদা কমিটি করা আছে।
“বাংলাদেশ ব্যাংক, আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, দুর্নীতি দমন কমিশন- সবাই মিলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাও আছে। কাজেই যেখানেই এ ধরনের অর্থ পাচার হচ্ছে, সেটা ধরা পড়ছে এবং সেটা ধরতে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।”
ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা এবং ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের মত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার (কালো টাকা সাদা) যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
“কালো টাকা মানে আপনারা জানেন, মাঝে মাঝে কিছু অপরাধের সূত্রে টাকা থেকে যায়, হয়ত কোনো কারণে টাকা হাতে এসে যায়। কিন্তু কোনো কাজে লাগাতে পারে না। তখন সে টাকাটা নানাভাবে পাচার করতে চায়। অন্যভাবে ব্যবহার হয়। সেটা যাতে আর না হয়, সেটা বন্ধ করার জন্য এটাকে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
এ ধরনের সুযোগ যে সব সরকারের আমলেই দেওয়া হয়েছে- সে প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, “কালো টাকার স্তূপ যেন না জমে, তার জন্য আমরা এটাকে অন্ততপক্ষে তার টাকাটা যে আছে, এটা যেন প্রদর্শিত হয় এবং এটা বিনিয়োগের খাতে বা কাজে আসতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছি সেখানে আমাদের আইটি পার্ক… সেখানে যদি কেউ বিনিয়োগ করে, তাকে কিন্তু সুনির্দিষ্ট হারে মানে একটা নির্দিষ্ট হারে (১০ শতাংশ) কর দিতে হবে।”
কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগের ফলে সৎ মানুষ নিরুৎসাহিত হবে কি না- সেই প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর সামনে রাখেন একজন সাংবাদিক।
উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, “দেখুন, যারা কালো টাকা করে ফেলেছে, তাদের টাকাটা তো আগে স্ট্রিম লাইনে আনতে হবে। কোথায় গুজে গাজে রেখে দিয়েছে তার ঠিক নাই…। আবার ইঁদুরে কেটে না ফেলে। সেটাকে আনার একটা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
“আর যারা সৎ পথে উপার্জন করেন, তাদের এই চিন্তাও নাই, ভয়ও নাই। আল্লাহর রহমতে তাদের কোনো অসুবিধাও হবে না। সততার অনেক অগ্নিপরীক্ষা আমাকে দিতে হয়েছে। আমি কখনো হতাশ হইনি। যারা সৎ থাকে তাদের ভেতর একটা দৃঢতা থাকে। আত্মবিশ্বাস থাকে। যে কোনো অবস্থা মোকাবেলা করার মত একটা শক্তি থাকে।”
শিক্ষা খাত নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো এমপিওভূক্ত হবে। সেজন্য বাজেটে টাকাও বরাদ্দ রাখা আছে।
একটি অনলাইন সংবাদপত্রের পরিচয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে জানতে চান, ওই পোর্টালের নিবন্ধন আছে কি না।
উত্তর শুনে তিনি বলেন, “এদের তো আগে রেজিস্ট্রেশন করা উচিত। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এভাবে যত্রতত্র অনলাইন খোলা উচিত না। রেজিস্ট্রেশন হবে। এরপর প্রশ্ন করলে উত্তর দেব।”