প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে রোহিঙ্গা সংকট। বাণিজ্য ও অর্থনীতিবিষয়ক দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোও পাবে বিশেষ গুরুত্ব। সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে স্বাক্ষর হতে পারে ১৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক। আগামী ১ থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করবেন।
সম্ভাব্য চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে- সড়ক অবকাঠামো, বন্দর নির্মাণ, বিনিয়োগ ও ঋণ-সহায়তা এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত-সংক্রান্ত বিষয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর সম্পর্কে একাধিকবার বলেছেন, এ সফরে এক নম্বর এজেন্ডা রোহিঙ্গা সংকট। পাশাপাশি আলোচনা হবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অন্যান্য বিষয়েও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও চীন কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে, তার ওপর নির্ভর করবে এ সম্পর্কিত আলোচনার সফলতা। তবে চীনের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ও বিনিয়োগ অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবশ্যই নতুন কিছু অর্জন করবে বলে দৃঢ় প্রত্যাশা করা যায়। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে একজন চীনা শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা চীন গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় তুলে আনতে পারে।
সূত্র জানায়, এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আলোচ্যসূচি তৈরির কাজ চলছে। একাধিক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সমন্বয়ে এ আলোচ্যসূচি তৈরি করা হচ্ছে। আলোচ্যসূচি তৈরির জন্য গতকাল বুধবার পর্যন্ত একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। প্রাথমিকভাবে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করার জন্য ১৭টি বিষয় বাছাই করা হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরকালে এবং পরবর্তী সময়ে ঋণচুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা বিষয়গুলোই চুক্তি-সংক্রান্ত আলোচ্যসূচিতে রাখার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে আরও দু-একটি বিষয়েও নতুন সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
এরই মধ্যে বিদ্যুৎ খাত-সংক্রান্ত দুটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ খাতের দুটি প্রকল্পের জন্য ২৩৭ কোটি ২৯ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি হবে। অন্যান্য চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিষয় নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। এসবের মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭৮৩ একর জমিতে চীনের জন্য বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, মোংলা বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, সীতাকুণ্ড-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তর, জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল লাইন ও ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ, রাজশাহী ওয়াসার জন্য পানি শোধনাগার নির্মাণ, গজারিয়ায় ৩৫০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং সরকারি পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক একটি চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে।
রোহিঙ্গা সংকটের দিকগুলো বিশদভাবে চীনের কাছে তুলে ধরবে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য পৃথক একটি কার্যপত্র তৈরি করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সম্পর্কে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, সব দিক থেকেই প্রধানমন্ত্রীর এ সফর এ সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সফরে রোহিঙ্গা সংকট নিশ্চিতভাবেই প্রাধান্য পাবে। কেননা, তা বাংলাদেশের জন্য খুব বড় একটি সমস্যা। চীন বাংলাদেশের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই চীনের সঙ্গে আলোচনায় বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ও গুরুত্ব পাবে। এ-সংক্রান্ত একাধিক নতুন চুক্তি ও সমঝোতা সই হবে- এটাই প্রত্যাশিত। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) সম্পর্কে তিনি বলেন, এ সফরে আলোচনার জন্য এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, চীন এ উদ্যোগ নিয়ে দৃশ্যত সফলভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে বাংলাদেশের মুখ্য কোনো ভূমিকা রাখারও সুযোগ নেই। তিনি বলেন, সফরের আগে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে একজন চীনা শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। এ প্রসঙ্গটি চীন আলোচনায় নিয়ে আসতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতি বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যখন কোনো সফর হয় এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়, তখন সব সময়ই বড় ও উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জনের প্রত্যাশা থাকে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরেও সেই প্রত্যাশা রয়েছে। চীন রোহিঙ্গা সংকটকে এ আলোচনায় কতটা গুরুত্ব দেবে, তা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও চীনের জন্য নয়। চীনকে এ সংকট সম্পর্কে আরও সংবেদনশীল করে এর সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করা গেলে সেটা হবে এ সফরের গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক অর্জন।
কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যৌথ স্বার্থ রয়েছে বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। এ কারণে দু’দেশই বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে এবং কার্যকর ফলও পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিআরআইর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিসিআইএম। এ ক্ষেত্রে চীন ও ভারত উভয়েরই স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয় রয়েছে। যে কোনো আলোচনায় এ বিষয়টিও বিবেচিত হবে।
এর আগে ২০১৪ সালের জুন মাসে চীন সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সফরে পাঁচটি চুক্তি সই হয়েছিল। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এ সফরে ২৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়।