লক্ষ্য মানেই দ্রুত গতিতে ছোটা নয় : নিল আর্মস্ট্রং

78effd145fb4dc83c067d3c5c2466d27-5d33ee3215803
চাঁদের হাজার বছরের নিঃসঙ্গতা প্রথমবারের মতো ঘুচিয়েছিলেন নিল আর্মস্ট্রং। যে চাঁদ ছিল মানুষের রাতের আকাশে, গান, কবিতা আর গল্পে, সে চাঁদকে প্রথমবারের মতো ছুঁয়ে দিয়েছিলেন এই মার্কিন নভোচারী। ‘অ্যাপোলো–১১’ অভিযানের কমান্ডার আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রেখেছিলেন ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। গতকাল চন্দ্রজয়ের ৫০ বছর পূর্তি হলো। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ৫০ বছর পূর্তি হয় ২০০৮ সালে। সে উপলক্ষে একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত স্মিথসোনিয়ান এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বক্তব্য দেন নিল আর্মস্ট্রং

ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মে জাতীয় মহাকাশ আইন প্রতিষ্ঠা করে। কংগ্রেস আইনটি প্রণয়ন করে, সেটিতে সই করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ৫০ বছর আগের ওই সপ্তাহটির কথা পরিষ্কার মনে আছে। আমি সে সময় ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমির অনেক ওপরে উড়োজাহাজ নিয়ে উড়ছি।

১৯৫৮ সালের পয়লা অক্টোবর নাসা পরিণত হলো অপারেটিং এজেন্সিতে। তবে বুধবার সকালে আমি একই চাকরি করতে গেলাম পুরোনো ওই অফিসেই। কাজও করলাম একই, যেমনটা করেছিলাম তার আগের দিনেও। তুলনামূলকভাবে রূপান্তরটি ছিল বেশ সহজ। আমরা একইভাবে রকেট আর রিসার্চ এয়ারক্রাফটে চড়ে বসলাম। আমরা জানি, কী করে উল্টো দিক থেকে গুনতে হয়, ‘৮, ৭, ৬, ৫…’।

আমাদের উড়োজাহাজ, ট্রাক আর ভ্যানগুলোর গায়ে লেখা ছিল NACA। তার মধ্যে ‘C’ অক্ষরটির জায়গায় ‘S’ বসাতে সামান্যই রং চড়াতে হয়েছিল [নাসার (NASA) আগের নাম ছিল NACA (ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর অ্যারোনটিকস)]। নতুন এজেন্সি হিসেবে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রের ওপরেও একই কাজ করতে হয়েছিল—রং চড়াতে হয়েছিল সামান্যই।

আমার ধারণা, আজ এখানে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা নাসার শুরুর সঙ্গী এবং সে দিনগুলোর কথা দিব্যি মনে করতে পারবেন। তাই নাসার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের, যাঁরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ১৯৫৮ সালে নাসায় যোগ দিয়েছিলেন, অনুরোধ করছি হাত উঁচিয়ে আওয়াজ তুলুন। অভিনন্দন! আপনারা ‘বুড়ো’ হিসেবে স্বীকৃত। আমরা, এই বুড়োরা আসলে দারুণ গর্বিত।

অর্ধশত বছর পর, আজকের এই রাতে আমরা পেছন ফিরে তাকাতে পারি—কী কাজ করেছি। এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হাজার হাজার গুণ বেড়েছে। আমরা জেনেছি, মানুষ পৃথিবীর মহাকর্ষীয় শক্তিতে আজীবনের জন্য আটকে থাকে না। আকাশযানের কর্মক্ষমতা, দক্ষতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং নিরাপত্তার দারুণ উন্নতি হয়েছে। আমরা সৌরজগৎ এবং তারও বাইরে অনেক কিছুই পাঠিয়েছি। মহাবিশ্বকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারছি আমরা। এবং মহাবিশ্বের প্রায় শুরুর দিকটাও আমাদের কাছে পরিষ্কার।

যুক্তরাষ্ট্র বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ প্রতিযোগিতা—আমরা সম্ভবত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তিকালীন প্রতিযোগিতার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম। যুদ্ধের মতোই ব্যয়বহুল ছিল সে প্রতিযোগিতা। যুদ্ধের মতোই উভয় পক্ষ চেয়েছিল বিপক্ষের প্রয়োগ করা বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে। আমি দাবি করছি না যে ওই মহাকাশ প্রতিযোগিতা যুদ্ধ প্রতিহত করার একটি উপায় ছিল। তারপরও ওই প্রতিযোগিতা আসলে যুদ্ধ প্রতিহতই করেছিল। প্রতিযোগিতাটি ছিল ভীষণ তীব্র, যা কিনা দুই পক্ষকে বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং অন্বেষণের মহাসড়কে নামিয়ে দিয়েছিল।

এমনকি ওই প্রতিযোগিতা প্রতিপক্ষের মধ্যে সৃষ্টিশীল সহযোগিতার এক পদ্ধতিও গড়ে তুলেছিল। প্রতিযোগিতাটি দুই পক্ষের জন্য ছিল ব্যতিক্রমী এক জাতীয় বিনিয়োগ। একটি কথা জোর দিয়ে বলি—নাগরিককে, বিশেষ করে তরুণ নাগরিককে ভালোবাসতে, শিখতে এবং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে উৎসাহিত করা সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সে মাপকাঠিতে সরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে নাসা নিঃসন্দেহে ওপরের দিকেই থাকবে।

‘লক্ষ্য’ বিষয়টি দ্রুতগতিতে ছুটে চলা, উচ্চতর অবস্থানে আরোহণ কিংবা বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করার চেয়েও বেশি কিছু। আমাদের লক্ষ্য, যেটি আমাদের দায়িত্বও বটে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা। সুযোগ আছে বিশ্বসংসারের বাইরে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করাতে, অন্বেষণে এবং নতুন জনবসতি স্থাপনে। আমাদের সর্বোচ্চ এবং গুরুত্বপূর্ণ কামনা হলো, মানুষের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বুদ্ধিমত্তা, চরিত্র এবং প্রজ্ঞার উন্নতি সাধন হবে। তা হলে পরে আমরা ওই সুযোগগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করে বেছে নিতে পারব। আমি চেয়ে আছি নাসার ১০০ বছর পূর্তির দিকে। যেদিন আমরা সবাই আবার একত্র হব। এবং সেখানে দেখব অগ্রযাত্রা ও রোমাঞ্চকর উন্নয়নের চমৎকার প্রতিবেদন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদমাহফুজ রহমান, সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

নিল আর্মস্ট্রংনিল আর্মস্ট্রংটুকরো টুকরো নিল আর্মস্ট্রং
* আর্মস্ট্রংয়ের জন্ম ১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে। উড়োজাহাজ চালানোর লাইসেন্স পান মাত্র ১৬ বছর বয়সে, তখন তাঁর গাড়ি চালানোর লাইসেন্সও ছিল না! ১৯৪৭ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন পারডু ইউনিভার্সিটিতে, বিষয় ছিল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯৪৯ সালে পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। দুই বছর পর যোগ দেন কোরিয়ার যুদ্ধে। ১৯৫২ সালে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে আসেন বিদ্যাপীঠে। কয়েক বছরের মধ্যে যোগ দেন ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর অ্যারোনটিকসে, ১৯৫৮ সালে যেটি রূপান্তরিত হয় নাসায়।
* ১৯৫৬ সালের ২৮ জানুয়ারি জ্যানেটকে বিয়ে করেন আর্মস্ট্রং। ১৯৫৭ সালে তাঁদের কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান রিক। ১৯৫৯ সালে আসে প্রথম কন্যা ক্যারেন। মাত্র আড়াই বছর বয়সে মস্তিষ্কে টিউমারের কারণে ক্যারেন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। পরের বছরই তৃতীয় সন্তান মার্কের জন্ম হয়। কিন্তু মেয়ের মৃত্যুতে ভীষণ ভেঙে পড়েন আর্মস্ট্রং। অ্যাস্ট্রোনট প্রোগ্রামে যোগ দেন ১৯৬৩ সালে। পৃথিবীর কক্ষপথে পাড়ি দেন ১৯৬৬ সালে।
* ১৯৬৯ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—চন্দ্রজয়ের মিশন হাতে নেন আর্মস্ট্রং। ২০ জুলাই চাঁদের মাটিতে পা রাখেন আর্মস্ট্রং, আর বলেন, ‘একজনের জন্য ছোট্ট পদক্ষেপ হলেও মানবজাতির জন্য বিশাল এক অগ্রযাত্রা।’ চাঁদ জয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের ‘হিরো’ হিসেবে মর্যাদা পান আর্মস্ট্রং। কিন্তু তিনি নিজেকে কখনো ‘আমেরিকান হিরো’ ভাবতে পছন্দ করতেন না। তাঁর কাছে চন্দ্রজয় ছিল গোটা মানবজাতির অর্জন।
* ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নাসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আর্মস্ট্রং। তারপর অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হয়ে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব সিনসিনাটিতে। আট বছর শিক্ষকতা করেছেন। তারও পরে, ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কম্পিউটিং টেকনোলজিস ফর এভিয়েশন ইনকরপোরেটেডে।
* আর্মস্ট্রং জীবন কাটিয়েছেন ভীষণ নিভৃতে। ২০০৫ সালে ৬০ মিনিটের এক সাক্ষাৎকারে চাঁদ নিয়ে বলেছিলেন, ‘সূর্যালোকে চাঁদের পৃষ্ঠটি অসাধারণ। জায়গাটি দারুণ। আমি তো সবাইকে সেখান থেকে ঘুরে আসতে বলব।’ একই বছর প্রকাশিত হয় আর্মস্ট্রংয়ের একমাত্র অনুমোদিত জীবনী ফার্স্ট ম্যান: দ্য লাইফ অব নিল এ. আর্মস্ট্রং।
* ২০১২ সালের আগস্টে আর্মস্ট্রংয়ের বাইপাস সার্জারি হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই—২৫ আগস্ট ৮২ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন আর্মস্ট্রং। মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ক্যারোল এবং দুই সন্তান। মহান এই নভোচারীর মৃত্যুর পর তাঁরা একটি বিবৃতি দেন, ‘যাঁরা জানতে চাইছেন, নিলকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য কী করা যায়, তাঁদের কাছে সামান্য অনুরোধ। এরপর বাইরে ঘুরতে বেরোলে রাতের ঝকঝকে আকাশে আপনার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকা চাঁদটিকে দেখলে নিল আর্মস্ট্রংয়ের কথা স্মরণ করবেন।’
Pin It