রোমাঞ্চের কত রঙ থাকে? উত্তেজনার কত রূপ! ক্রিকেট তার অনিশ্চয়তা আর সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরল লর্ডসের ফাইনালে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্য বদল হলো অসংখ্যবার। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ টাই হয়ে গড়াল সুপার ওভারে। সেখানেও রোমাঞ্চের তীব্র দুলুনি শেষে আবার টাই! শেষ পর্যন্ত দুই দলকে আলাদা করল বাউন্ডারি সংখ্যা। অবিশ্বাস্য নাটকীয়তার পর বিশ্বকাপ জয়ের অনির্বচনীয় স্বাদ পেল ইংল্যান্ড।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের রোমাঞ্চকর ফাইনালে রোববার দুই দলকে আলাদা করল কেবল বাউন্ডারির হিসাব। বেশি বাউন্ডারি মেরে প্রথমবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতল ইংল্যান্ড। ক্রিকেটের জন্মভূমি, ওয়ানডের জন্ম যেখানে, সেই দেশ অবশেষে বিশ্বকাপ জিতল নিজেদের আঙিনায়।
এমন ম্যাচে কাউকে পরাজিত বলা কঠিন। তবু কেবল নিয়মের খাতিরেই ট্রফি অধরা রইল নিউ জিল্যান্ডের।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা নিউ জিল্যান্ড তুলেছিল ২৪১ রান। শেষ বলে রান আউটে অলআউট হয়ে ইংল্যান্ডও থামে ২৪১ রানে। সুপার ওভারে ইংলান্ড গড়েছিল ১৫ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর। এবার ওভারের শেষ বলে রান আউটে নিউ জিল্যান্ড থামে ১৫ রানেই। সুপার ওভারসহ ম্যাচে ইংলিশদের চার ও ছক্কা ছিল মোট ২৬টি, নিউ জিল্যান্ডের ১৭টি। ট্রফির ভাগ্য লেখা হয়েছে এখানেই।
তিন বছর আগে কলকাতায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষ ওভারে বেন স্টোকস চার ছক্কা হজম করায় হেরেছিল ইংল্যান্ড। এবার সেই স্টোকসের বীরত্বেই ইংল্যান্ড ঘুচিয়েছে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ট্রফি খরা।
মূল ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের আশা জিইয়ে রেখেছিলেন স্টোকসই। শেষ ওভারে তার একটি ছক্কা ও তার ডাইভে ভাগ্যের ছোঁয়ায় পাওয়া ৬ রানই ইংল্যান্ডকে এগিয়ে নেয় টাই করার পথে। অপরাজিত থাকেন তিনি ৮৪ রানে। এরপর সুপার ওভারেও দলের ১৫ রানের ৮ রান করেছেন স্টোকস।
মূল ম্যাচের শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ১৫ রান। ট্রেন্ট বোল্টের করা প্রথম দুই বলেই রান নিতে পারেননি স্টোকস। তৃতীয় বলে বল পাঠান বাউন্ডারিতে। পরের বলে সেই ডাইভ, হয়তো ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডাইভ!
মিড উইকেটে বল পাঠিয়ে দ্বিতীয় রানের জন্য ছুটছিলেন স্টোকস। সীমানা থেকে মার্টিন গাপটিলের থ্রো সরাসরি যাচ্ছিল স্টাম্পের দিকে। নিজেকে বাঁচাতে ডাইভ দেন স্টোকস। বল তার ব্যাটে লেগে ফাঁকা জায়গা দিয়ে চলে যায় বাউন্ডারিতে। দৌড়ে ২ রানের সঙ্গে ওই চারে আসে মোট ৬ রান।
২ বলে তখন প্রয়োজন ৩। পঞ্চম বলে ২ রানের চেষ্টায় রান আউট আদিল রশিদ, শেষ বলে ২ রানের চেষ্টায় রান আউট মার্ক উড। একটি করে রান হওয়ায় ম্যাচ টাই।
ম্যাচে খুব ভালো বোলিং করতে না পারা ট্রেন্ট বোল্ট ভালো করতে পারেননি সুপার ওভারেও। স্টোকস ও বাটলারের একটি করে বাউন্ডারিসহ আসে ১৫ রান।
সুপার ওভারে খুব ভালো করতে পারেননি ইংল্যান্ডের বোলার জফরা আর্চারও। প্রথম বলে দেন ওয়াইড। দারুণ শটে দ্বিতীয় বল জিমি নিশাম ফেলেন গ্যালারিতে। শেষ পর্যন্ত নায়ক হতে পারেননি নিশাম বা মার্টিন গাপটিল। শেষ বলে প্রয়োজন ছিল দুই। দ্বিতীয় রানের চেষ্টায় রান আউট হন গাপটিল।
সুপার ওভারের মতো মূল ম্যাচেও ইংল্যান্ডকে টেনেছে স্টোকস ও বাটলারের জুটি। ইংল্যান্ডের শক্তিশালী টপ অর্ডারকে দারুণভাবে ভুগিয়েছে নিউ জিল্যান্ডের পেস আক্রমণ। ৮৪ রানে ইংল্যান্ড যখন ৪ উইকেট হারায়, ওভার পেরিয়ে গেছে প্রায় অর্ধেক।
সেখান থেকেই স্টোকস ও বাটলার জুটির শুরু। বাটলার রান করেছেন অনায়াসে, স্টোকস আগলে রেখেছেন উইকেট। একটু একটু করে ইংল্যান্ড এগিয়ে যায় লক্ষ্যের দিকে। ব্যর্থ হতে থাকে নিউ জিল্যান্ডের সব প্রচেষ্টা।
তখনও পর্যন্ত বোঝা যায়নি, অপেক্ষায় কত নাটকীয়তা। লকি ফার্গুসনকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে বাটলার আউট হন ৫৯ রানে। ভাঙে ১১০ রানের জুটি।
এরপর আর কোনো ব্যাটসম্যান সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। ইংল্যান্ডের স্বপ্ন বয়ে নেন বলতে গেলে কেবল স্টোকসই। শেষ পর্যন্ত তিনিই ইংল্যান্ডের নায়ক।
ম্যাচের প্রথম ভাগে নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটিং ছিল গোটা টুর্নামেন্টেই তাদের ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি। কখনোই খুব একটা গতি পায়নি ইনিংস। ফিফটি ছিল কেবল একটি। এরপরও অনেকের একটু একটু অবদানে তারা যেতে পারে আড়াইশর কাছে।
ম্যাচের সকালের বৃষ্টিতে মাঠ ভেজা থাকায় খেলা শুরু হয় ১৫ মিনিট দেরিতে। টসের সময় দুই অধিনায়কই ছিলেন এক পৃষ্ঠায়। উইকেট ব্যাটিং সহায়ক, কন্ডিশন বোলিং। দুজনের মতেই ৫০-৫০ সিদ্ধান্ত। একটি নিতেই হতো, উইলিয়ামসন নেন ব্যাটিং।
মেঘলা আকাশের নিচে পেসারদের সুইং সামলে কিউইদের শুরুটা খারাপ ছিল না। নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে থাকা মার্টিন গাপটিল ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান করছিলেন।
তবে ১৮ বলে ১৯ করে গাপটিলই বিদায় নেন আগে। ক্রিস ওকসের সিমে পড়ে ভেতরে ঢোকা বলে এলবিডব্লিউ হওয়ার পাশাপাশি নষ্ট করে আসেন একমাত্র রিভিউটি।
দ্বিতীয় জুটিতে নিকোলস ও উইলিয়ামসনের মনোযোগ ছিল শুরুর চ্যালেঞ্জিং সময়টুকু কাটিয়ে দেওয়া। ১০ ওভার শেষে রান ছিল ৩৩, গাপটিলের ২ চার ও ১ ছক্কা ছাড়া ছিল না আর কোনো বাউন্ডারি। নিজের প্রথম বাউন্ডারির আগে উইলিয়ামসনের রান ছিল ২৮ বলে ৫।
থিতু হওয়ার পর দুজন এগোতে থাকেন সাবলীল গতিতে। পরের ১০ ওভারে ৫৮ রান আসে কোনো ঝুঁকি ছাড়াই।
৭৪ রানের জুটি ভেঙে ইংল্যান্ডকে খেলায় ফেরান প্লাঙ্কেট। ৫৩ বলে ৩০ করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন উইলিয়ামসন। আম্পায়ার আউট না দিলেও রিভিউয়ে সফল হয় ইংল্যান্ড।
একটু পর নিউ জিল্যান্ডকে আরেকটি বড় ধাক্কা দেন প্লাঙ্কেট। একটা প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন নিকোলস। ৭১ বলে স্পর্শ করেছিলেন প্রথম বিশ্বকাপ ফিফটি। কিন্তু বোল্ড হয়ে যান শরীর থেকে দূরে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে।
মিডল অর্ডারে কিউইদের বড় ভরসা টেইলর ১৫ রানে বিদায় নেন মার্ক উডের বলে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে। দারুণ শুরু করা জিমি নিশামকে ১৯ রানে থামিয়ে প্লাঙ্কেট ধরেন তৃতীয় শিকার। শেষ দিকে ঝড় তোলার সামর্থ্য ছিল যার, সেই কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম ১৬ রান করতে খেলেছেন ২৮ বল।
পাঁচে নেমে দলকে টেনে নিচ্ছিলেন ল্যাথাম। উইকেট ধরে রাখার পাশাপাশি খেলেছেন দারুণ কয়েকটি শট। কিন্তু তিনিও পারেননি শেষ পর্যন্ত থাকতে বা ঝড় তুলতে। ৫৬ বলে করেছেন ৪৭। শেষ ১০ ওভারে নিউ জিল্যান্ড করতে পারে কেবল ৬২ রান।
তিনটি করে উইকেট নেন ক্রিস ওকস ও লিয়াম ফ্লাঙ্কেট।
নিউ জিল্যান্ডের মূল শক্তি বোলিং, ইংল্যান্ডের ব্যাটিং, মাঝবিরতিতে তাই জমজমাট একটি ম্যাচের ক্ষেত্র ছিল প্রস্তুত। কিন্তু সেটি দুই দল আর গ্যালারি ভরা দর্শক থেকে শুরু করে টিভিপর্দার সামনে কোটি দর্শকের স্নায়ুর এত বড় পরীক্ষা নেবে, কে জানত!
নাটকীয়তার অবিশ্বাস্য সব অঙ্ক পেরিয়ে হয়তো ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ম্যাচই হয়ে গেল এই ফাইনাল। তাতে একটি ক্রিকেট জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। এত কাছেও গিয়েও না পাওয়ার বেদনায় পুড়তে হলো আরেকটিকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউ জিল্যান্ড: ৫০ ওভারে ২৪১/৮ (গাপটিল ১৯, নিকোলস ৫৫, উইলিয়ামসন ৩০, টেইলর ১৫, ল্যাথাম ৪৭, নিশাম ১৯, ডি গ্র্যান্ডহোম ১৬, স্যান্টনার ৫*, হেনরি ৪, বোল্ট ১*; ওকস ৯-০-৩৭-৩, আর্চার ১০-০-৪২-১, প্লাঙ্কেট ১০-০-৪২-৩, উড ১০-১-৪৯-১, রশিদ ৮-০-৩৯-০, স্টোকস ৩-০-২০-০)।
ইংল্যান্ড: ৫০ ওভারে ২৪১ (রয় ১৭, বেয়ারস্টো ৩৬, রুট ৭, মর্গ্যান ৯, স্টোকস ৮৪*, বাটলার ৫৯, ওকস ২, প্লাঙ্কেট , আর্চার ০, রশিদ ০, উড ০; বোল্ট ১০-০-৬৭-০, হেনরি ১০-২-৪০-১, ডি গ্র্যান্ডহোম ১০-২-২৫-১, ফার্গুসন ১০-০-৫০-৩, নিশাম ৭-০-৪৩-৩, স্যান্টনার ৩-০-১১-০)।
ফল: ম্যাচ ও সুপার ওভার টাই; বাউন্ডারিতে এগিয়ে থেকে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড।
ম্যান অব দা ম্যাচ: বেন স্টোকস
ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট: কেন উইলিয়ামসন