মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়া ৪৫ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল করেছে সরকার। ভুয়া সনদ নেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুসারে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী এসব সনদ ও গেজেট বাতিল করা হয়। এখন সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংশ্নিষ্টদের নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা ফিরিয়ে নিতেই এই মামলা করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদানকারী সরকারি সংস্থা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৬২তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্প্রতি জামুকার সভার ওই সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাতিল হওয়া এই ৪৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিল্পসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। অনেকে বর্তমানে অবসরোত্তর সুবিধা ভোগ করছেন। আবার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এখনও চাকরি করছেন। অবশ্য এদের অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ প্রাপ্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। অথচ মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্তি-সংক্রান্ত কোনো
দালিলিক প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। ২০১৫ সালে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নজরে এলে একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সরেজমিন অনুসন্ধানের পর চলতি বছরের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে ওই গোয়েন্দা সংস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিধি অনুসরণ করে দুই দফায় জামুকার বৈঠকে প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এরপর জামুকার সবশেষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ৪৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, বাতিল হওয়া এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। পরে জামুকা ও মন্ত্রণালয় থেকে সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের গেজেট বাতিল করা হয়েছে। এখন তাদের মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, এর মধ্যে যা ফেরত আনা সম্ভব তার জন্য মামলা করা হবে। স্থানীয় জেলা প্রশাসন এসব মামলা করবে বলেও জানান তিনি।
জামুকার মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জামুকার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্নিষ্টদের সুপারিশ ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে। শিগগির মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হওয়া এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
৪৫ ব্যক্তি হলেন- দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মো. আবু তাহের শাহ, ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার আব্দুল মালেক, আলফাডাঙ্গার আবজাল হোসেন, নগরকান্দা উপজেলার আ. ওহাব সরদার, একেএম আছাদুজ্জামান, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সমর কান্তি বড়ূয়া, মিরসরাইয়ে প্রিয়নাথ বড়ূয়া, টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার চক্রবর্তী প্রভাত কুমার, ঘাটাইলের কাজী গোলাম সারওয়ার, মাদারীপুর সদরের মো. বাহাউদ্দিন হাওলাদার, খুলনার দৌলতপুর উপজেলার এমএ বাশার, ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার এবিএম তমিজ উদ্দিন, ত্রিশালের মো. আতিকুল ইসলাম, গোপালগঞ্জ সদরের এমডি বাদশা মিয়া, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার এটিএম কামরুজ্জামান, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মো. আব্দুস সালাম, বিমল চন্দ্র শীল, চিত্ত রঞ্জন মণ্ডল, ঢাকার ধামরাই উপজেলার আবদুস সামাদ, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার এসএম কামাল হোসেন, পাবনা সদরের ডা. কেএম আশরাফ উজ্জামান, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার মো. আবদুল বারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মো. আবদুল গফুর, ভোলার দৌলতখান উপজেলার মো. নজরুল ইসলাম, বরিশাল সদরের মো. রফিকুল ইসলাম খান, নড়াইলের কালিয়া উপজেলার আবুল বাসার মোল্যা, গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার গণেশ চন্দ্র সাহা, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মো. মছলেম উদ্দিন, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার মো. আব্দুল মান্নান, ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মো. মজনু, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মো. শহিদুর রহমান, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার মো. বজলুর রহমান, বগুড়ার ধুনট উপজেলার মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ভোলার লালমোহন উপজেলার মো. আবদুল গণি, চাঁদপুরের মতলব উপজেলার মো. আব্দুল মান্নান চৌধুরী, গাইবান্ধা সদরের মো. সামছুল হক মিয়া, দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মো. আজিজুল হক, বরগুনা সদরের মো. মাহতাব উদ্দিন, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পঞ্চানন চৌধুরী, গাজীপুর সদরের মো. মাজহারুল হক, ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মো. সুলতান আহম্মেদ মৃধা, ঝিনাইদহ সদরের মো. জাফর জমাদার, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার মো. ফকির আ. মান্নান, ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মো. আব্দুল হাকিম ও বরিশালের অগৈলঝাড়া উপজেলার ইউএসএম মো. এমএ ছাত্তার।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, দেশে এখন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৮ জন। ভাতা পাচ্ছেন এক লাখ ৮৭ হাজার ৯৮২ জন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ পর্যন্ত নতুন করে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়েছেন ৩৫ হাজার ৪৮৯ জন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে এ পর্যন্ত ছয়বার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এর পরও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি সারাদেশে ৪৭০টি উপজেলা ও মহানগর কমিটি গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেব গেজেটভুক্তির জন্য প্রায় দেড় লাখ ব্যক্তির আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম শুরু করে সরকার। কিন্তু দুই বছরেও মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। ফলে উপজেলা থেকে যাচাই-বাছাই কমিটির পাঠানো তালিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় চলতি বছরের ২১ মার্চ আবেদনগুলো ফের যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর প্রাথমিক তালিকা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।