লাভের গুড় অন্যের পেটে

Untitled-15-5d409ea740e9a

বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নদী ও বন্দরের ঘাট ইজারা নিয়ে সরকারি তিনটি সংস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে চিঠি চালাচালি হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এই সুযোগে একটি গোষ্ঠী স্থানীয় সাংসদদের ব্যবহার করে ঘাটগুলো নিজেদের আয়ত্তে রেখেছে। এ নিয়ে চলছে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য। তবে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

ঘাটের ইজারা নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যে শীতলযুদ্ধ চলছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকায় প্রায় চব্বিশটি ঘাটের ইজারা নিয়ে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসনও অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন সরকারের উচ্চ পর্যায়ে চিঠি দিয়েছে। সম্প্রতি পাঁচ দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, সারাদেশের নদী ও বন্দরের ঘাটগুলোর ইজারা প্রদান নিয়ে সরকারের কয়েকটি সংস্থার মধ্যে কিছুটা সমন্বয়হীনতা চলছে। এ কারণে প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। তবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এর সুষ্ঠু ও যৌক্তিক সমাধানে আসার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে চিলমারী নদীবন্দরের লঞ্চঘাটটি নিয়ে বিরোধ মীমাংসা শেষে যৌথ জরিপ শুরু হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর তথ্যমতে, কয়েক বছর ধরে কয়েকটি ল্যান্ডিং স্টেশনের ইজারা ও শুল্ক্ক আদায় নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বিরোধ চলছে। বিআইডব্লিউটিএর লঞ্চঘাট এবং স্থানীয় সরকার ও অন্যান্য সংস্থা খেয়াঘাট ইজারা প্রদান নিয়ে দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে মাঠ পর্যায়ে বিরোধপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। এ কারণে কয়েকটি এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা দেখা দেয়। এসব ঘাটে বিআইডব্লিউটিএ ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি। তবুও অন্যরা সেগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, পোর্ট অ্যাক্ট-১৯০৮ অনুসারে সরকার ১৯৬০ সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএকে ঢাকা নদীবন্দরের সীমানা নির্ধারণসহ এর সংরক্ষক নিযুক্ত করে। পরে ২০০৪ সালে নদীবন্দরের সীমানা বর্ধিতকরণ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাগলা-পানগাঁও ফেরিঘাটটি আগে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ থেকে ইজারা দেওয়া হতো। তবে ২০০৪ সালে ঢাকা নদীবন্দরের সীমানা বর্ধিতকরণ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন অনুসারে সেটি বিআইডব্লিউএর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন থেকে সংস্থাটি ঘাট ইজারা দেওয়া শুরু করে। পাশাপাশি জেলা পরিষদও ইজারা দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। এ নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা ও মামলা-পাল্টা মামলা চলেছে। মামলার রায় বিআইডব্লিউটিএর পক্ষে এসেছে। সেই থেকে বছরে ৪৮ লাখ টাকায় ঘাটটি এককভাবে ইজারা দিয়ে আসছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিআইডব্লিউটিএ ইজারা প্রদানের দরপত্র আহ্বান করলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ তা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করে। এতে পুরনো বিরোধ নতুন করে ফিরে আসে। এখনও তা চলছে। একই ঘটনা চলছে খোলামোড়া কামরাঙ্গীরচর খেয়াঘাট নিয়ে। এটি ঢাকা নদীবন্দরের বর্ধিত সীমানাভুক্ত হলেও জেলা পরিষদ এই ঘাটটি ইজারা দিয়ে আসছে। বিআইডব্লিউটিএ তা বাতিলে একাধিকবার তাগিদ দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে সংস্থাটি এ ঘাটটিও ইজারা দিতে পারছে না। এমনকি ঘাটটি সংস্কারেরও উদ্যোগও নিতে পারছে না। একই চিত্র ঝাউচর-কামরাঙ্গীরচর খেয়াঘাট, বসিলা-ওয়াসপুর ও শ্যামলাসী-কলাতিয়াপাড়া ফেরিঘাটের। ঢাকা নদীবন্দরের সীমানার অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও জেলা পরিষদ সেগুলো ইজারা দিচ্ছে।

মিরকাদিম নদীবন্দরের কাঠপট্টি-কদমতলী-চরসন্তোষপুর আন্তঃজেলা খেয়াঘাটের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এই খেয়া ঘাটটির উত্তরপাড় মুন্সীগঞ্জ জেলায় এবং দক্ষিণপাড় নারায়ণগঞ্জ জেলা সীমানায় অবস্থিত। প্রতিদিন ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাধ্যমে খেয়াঘাটটি দিয়ে উভয়পাড়ে কয়েক হাজার যাত্রী পারাপার হয়ে থাকে। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তর থেকে এ ঘাটটির ইজারা দেওয়া হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ এখানে দর্শকের ভূমিকায়। একই চিত্র চরকুমারী রিকাব বাজার ইউপি সংলগ্ন আন্তঃজেলা খেয়াঘাটের।

কিশোরগঞ্জের চামড়া (চামটা) লঞ্চঘাটটি ১৯৮৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ছিল বিআইডব্লিউটিএর নিয়ন্ত্রণে। এ ঘাটে বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের জন্য একতরফা বিআইডব্লিউটিএর ইজারা বাতিল করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। পুনরায় ঘাটটি ফেরত পেতে দেনদরবার চালাতে থাকে বিআইডব্লিউটিএ। এ নিয়ে ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিলেও চার বছরেও তার জবাব পায়নি বিআইডব্লিটিএ। ফলে অনিষ্পন্ন রয়েছে এ ঘাটের বিরোধ।

খুলনা নদীবন্দরের ডাবঘাট ফেরিঘাট (নড়াইল কাছারীঘাট) বিআইডব্লিউটিএর পরিচালিত। ২০০৯ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ইজারা দিয়ে আসে সংস্থাটি। হঠাৎ করেই ২০১০ সালে খুলনা সিটি করপোরেশন এ ঘাটের ইজারা দেওয়া শুরু করলে বিরোধ চরমে পৌঁছে। দুই সংস্থার দ্বন্দ্বের কারণে বর্তমানে এ ঘাটটির ইজারা বন্ধ রয়েছে।

সূত্র জানায়, নদীবন্দর সীমানায় সিটি করপোরেশনের এরূপ ইজারা কার্যক্রম পরিচালনা এখতিয়ারবহির্ভূত। এটা বন্ধ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া রূপসা ফেরিঘাট, কাস্টমসঘাট, জেলখানা, কালিবাড়ী ও মহেশ্বরপাশা- দৌলতপুর ফেরিঘাট ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএর অধীনে ছিল। ১৯৯১ সালে খুলনা জেলা পরিষদ এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে এগুলোর ইজারা প্রদানে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে।

সাতক্ষীরার জেলার আশাশুনি উপজেলা প্রশাসন একসরা লঞ্চঘাটটি ইজারা দিত। বিআইডব্লিউটিএ ২০১৪ সালে এখানে এক কোটি টাকা ব্যয়ে একটি টার্মিনাল পস্টুনসহ জেটি স্থাপন করে ইজারা দেওয়া শুরু করে। পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনও তাদের ইজারা কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে সরকারের দুই সংস্থার মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। এখনো এর সুরাহা হয়নি। ফলে সরকার প্রতি বছর বিপুল রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

জানা গেছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, চাঁদপুর, খুলনাসহ সারাদেশের নদীর ঘাটগুলোর চিত্র একই। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ইলিশা লঞ্চঘাট, চাঁদপুর পৌরসভার নতুন বাজার গুদারাঘাট, ৫নং ফেরিঘাট, কয়লাঘাট ও চৌধুরীঘাট, শরীয়তপুরের মঙ্গলমাঝি-মাঝিকান্দি-পূর্বনাওডোবা লঞ্চঘাট এবং গাইবান্ধার বালাসী ঘাট নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে বিরোধ চলছে।

Pin It