এরশাদের দাফন কোথায় ?

ershad-janaja-5d2ca33d2b05a

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর দু’দিন পরও তাকে কোথায় দাফন করা হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। রোববার এরশাদের মৃত্যুর পর সাবেক এই সেনা প্রধানকে বনানীর সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

জাতীয় পার্টি (জাপা) সূত্র জানায়, রওশন এরশাদ চান তার স্বামীকে ঢাকায় দাফন করা হোক। দলের নেতাকর্মীদের দাবি, এরশাদকে দাফন করা হোক উন্মুক্ত কোনো স্থানে; যেখানে তারা অবাধে যেতে পারবেন।

এদিকে এরশাদকে তার নিজ জেলা রংপুরে সমাহিত করার দাবিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তবে শেষপর্যন্ত এরশাদকে সামরিক কবরস্থানেই দাফন করা হবে বলে জানিয়েছে সূত্র।

দাফন নিয়ে এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেই সোমবার জাতীয় সংসদ ভবন এবং বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে এরশাদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুপুরে তার মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয়ে। সেখানে দলের প্রয়াত চেয়ারম্যানের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান দলের নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ।

মঙ্গলবার সকালে এরশাদের মরদেহ রংপুরে নেওয়ার কথা। সেখানে জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে মরদেহ ঢাকায় ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু রংপুরের নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, এরশাদের লাশ তারা ঢাকায় আনতে দেবেন না। রংপুরে এরশাদের বাসভবন ‘পল্লীনিবাস’-এর পাশে তাকে দাফন করার প্রস্তুতি নিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে সেখানে কবরও খোঁড়া হয়েছে।

জাপার একাধিক নেতা জানান, তারা রওশন এরশাদের কাছ থেকে জেনেছেন, এরশাদের ইচ্ছা ছিল তাকে যেন তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল সেনানিবাসে দাফন করা হয়। কিন্তু এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে দাবি করেছেন, এরশাদের ইচ্ছা ছিল তাকে যেন রংপুরে দাফন করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে সোমবার রাত আটটা পর্যন্ত এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি জাপা নেতারা।

এ প্রসঙ্গে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ এমপি বলেন, ‘দেখা যাক ম্যাডাম (রওশন এরশাদ) কী সিদ্ধান্ত নেন।’

জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ জানান, সবার সঙ্গে আলোচনা করে মঙ্গলবার দাফনের স্থান নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে জিএম কাদেরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জাপার দু’জন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা চান এরশাদকে ঢাকায় দাফন করা হোক। এতে সমর্থন রয়েছে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ আরো কয়েকজন জেষ্ঠ্য নেতার। তাদের মতে, সাবেক সেনাপ্রধান হিসেবে এরশাদকে সেনানিবাসে দাফন করা উচিত। তবে অপর একটি অংশের দাবি, রংপুরেই এরশাদকে সমাহিত করা হোক। কারণ এই অঞ্চলের মানুষের সমর্থনের কারণেই ক্ষমতা ছাড়ার ২৯ বছর পরও রাজনীতিতে টিকে ছিলেন এরশাদ।

রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির বলেছেন, এরশাদকে রংপুরেই দাফন করতে হবে। রংপুর থেকে তার লাশ কোনোভাবেই ঢাকায় নিতে দেওয়া হবে না।

জানাজা ও শেষ শ্রদ্ধা: বিরোধী দলীয় নেতা এরশাদকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে সোমবার সকালে জাতীয় সংসদ থেকে শেষ বিদায় জানানো হয়। দক্ষিণ প্লাজায় তার জানাজা হওয়ার কথা থাকলেও দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সংসদের টানেলের মধ্যে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে পাঁচবারের এমপি এরশাদকে জাতীয় পতাকা ও সেনাবাহিনীর পতাকা মোড়ানো কফিনে করে সংসদ প্রাঙ্গণে আনা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব এবং স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া এরশাদকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। জানাজার আগে এরশাদের জীবনী পাঠ করেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ। এরশাদের কর্মময় জীবন নিয়ে কথা বলেন বিরোধী দলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ। পুত্র সাদ এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়াত স্বামীর জন্য সবার দোয়াও কামনা করেন তিনি। পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন এরশাদের ছোটভাই জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

এরশাদকে নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বর্ষীয়াণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, এরশাদের যেমন ভালো গুণ আছে, তেমনি ব্যর্থতাও আছে। এরশাদ ব্যক্তিগত জীবনে বিনয়ী ও মার্জিত ছিলেন। সংসদে তিনি মার্জিত ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। সবসময় তিনি গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন।

সংসদ প্রাঙ্গণে এরশাদের জানাজায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের এমপি মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, শামসুল হক টুকু, এ বি তাজুল ইসলাম, সাবের হোসেন চৌধুরী, ফজলে নূর তাপস, এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, সুবিদ আলী ভূঁইয়া, আব্দুস সোবহান গোলাপ, সাবেক এমপি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মুজিবুল হক চুন্নু, সাবেক এমপি এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যরিস্টার মওদুদ আহমদ ও জি এম সিরাজ এমপি প্রমুখ।

সংসদ থেকে সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের মরদেহ নেওয়া হয় কাকরাইলে জাপা কার্যালয়ে। সেখানে দলীয় চেয়ারম্যানকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেছিলেন সারাদেশ থেকে আসা নেতাকর্মীরা। তাদের ভিড়ে কাকরাইল ও আশেপাশের এলাকায় যানজট সৃষ্টি হয়। এ সময় তাদের কান্নায় হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কাকরাইলে এরশাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

সেখান থেকে এরশাদের মরদেহ বায়তুল মোকারমে নেওয়া হয়। বাদ জোহর জানাজায় জাপার নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নেন। জানাজার কাতার মসজিদ প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে ভাসানী হকি স্টেডিয়াম পর্যন্ত পৌছায়। জাতীয় মসজিদে জানাজার আগে এরশাদের জীবনী পাঠ করা হয়। এরপর বড়ভাইয়ের পক্ষে সবার কাছে ক্ষমা চান জিএম কাদের। বায়তুল মোকারমে জানাজায় অংশ নেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।

Pin It