বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, কৃষি ও শিল্পের বিষয়ে একটা বিশেষ মহলের পরামর্শে চলে সরকার। সরকার এদের পকেটে ঢুকে গেছে। এই পকেট থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, ওই মহল তাদের সুবিধামতো পরামর্শ দেয় সরকারকে। এ কারণে ধান ও চামড়া নিয়ে একটা অরাজক পরিস্থিতি দেখতে হয়েছে জাতিকে। চাল ও কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ রাখলে এ রকম পরিস্থিতি এড়ানো যেত। একটা লেজেগোবরে অবস্থা দাঁড়ানোর পরও কাঁচা চামড়া রফতানি করতে দেওয়া হয়নি। আবার শিল্প মালিকরাও কিনছেন না। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিটা তো দেশেরই হলো। চাল রফতানির সুযোগ থাকলে ধান নিয়ে কৃষক ও সরকারকে ওই নাজুক অবস্থায় পড়তে হতো না। একই অবস্থা পাটের ক্ষেত্রেও। কাঁচা পাট রফতানির ব্যবস্থা অবারিত রাখলে পাট নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। প্রায়ই কাঁচা পাট রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘রফতানিও করতে দিলেন না, বিক্রির ব্যবস্থাও করা হলো না, তাহলে অর্থ ব্যয়ে উৎপাদিত কষ্টের ফসল নিয়ে কৃষক যাবে কোথায়?’ এ অবস্থা কৃষককে মাঠে মারার শামিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, পাটের মূল্য সংযোজন করে বেশি দামে রফতানি করার কথা বলা হয়। অথচ রফতানি তো কমছেই। ভারত যদি বাংলাদেশ থেকে পাট কিনে পণ্য বানিয়ে মুনাফা করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ নিজেদের পাট দিয়ে পণ্য বানিয়ে কেন মুনাফা করতে পারছে না- এ বিষয়গুলো সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
একই অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন বিজেএমসির চেয়ারম্যান শাহ মো?হাম্মদ নাসিম।
এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, যেসব এজেন্সি গত বছর ভালো পারফর্ম করতে পারেনি তাদের এবার বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, একেকটা এজেন্সি চালাতে সরকারের ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ হয়। অকারণে আর্থিক লোকসান কমাতেই এই সিদ্ধান্ত। কোনো রকম অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এজেন্সি নিয়োগের অভিযোগ সত্য নয় বলে তিনি দাবি করেন। গত বছর ভালো পারফর্ম করতে না পারার কারণে বাদপড়া এজেন্সি এ ধরনের অভিযোগ তুলছে বলে মনে করেন তিনি।
খুলনা খালিশপুর জুট মিলে গত বছর পাট সরবরাহ করেছে সোনার বাংলা ট্রেডার্স। এবার এজেন্সিটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক হীরক জানান, গত বছর পাট দিয়েছেন তিনি। এবারও প্রাথমিক তালিকায় থাকায় গুদাম ভাড়াসহ আরও কিছু অর্থ ব্যয় করেছেন এরই মধ্যে। এখন বাদ পড়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি। পাট সংগ্রহে অনিয়মের অভিযোগ করে তিনি বলেন, মিল গেট থেকে পাট সংগ্রহের সুযোগ রাখায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা খারাপ মানের পাট কিনতে মিল কর্মকর্তাদের বাধ্য করেন। বেশিরভাগ সময় এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ে অর্থের অবৈধ লেনদেন হয়। যার খেসারত দিতে হয় সরকারকে।
গত বছর চট্টগ্রামের হাফিজ জুট মিলসে পাট সরবরাহ করে বিজেএমসির অনুমোদিত আইডিয়া বিজনেস নামের একটি এজেন্সি। কার্যক্রম মূল্যায়নে গত বছরের ৯৮ এজেন্সির মধ্যে তৃতীয় হয় এজেন্সিটি। এজেন্সি অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রতিবেদন অগ্রাধিকার দেওয়ার শর্ত থাকলেও এ বছর আইডিয়া বিজনেসকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যারিস্টার জুয়েল বলেন, পাট খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে অনেক পাট অবিক্রীত থাকবে। দর কমে যাবে। কৃষকও দর না পেয়ে পাটের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। অর্থাৎ মৌসুমে ধান ও কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে যে অরাজকতা হয়েছে, পাট নিয়েও একই অরাজক অবস্থা হতে যাচ্ছে। এজেন্সি নিয়োগে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগও তোলেন তিনি। এ বিষয়ে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার কথাও জানান তিনি।
এজেন্সির কাজ হচ্ছে কৃষকের কাছ থেকে পাট কিনে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে বেল আকারে নির্দিষ্ট জুট মিলে পাট সরবরাহ করা। এর আগে গুদাম ভাড়া করে পাট মজুদ এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পাট ভাগ করা।
গত বছর বিজেএমসির মিলগুলোতে পাট সরবরাহকারী এজেন্সির সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এ বছর আরও ৭টি বাড়িয়ে ১০৫টির প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে মাত্র ৪৮টি এজেন্সির অনুমোদন দেয়। শর্ত হিসেবে বলা হয়, উপযুক্ত গুদাম নিশ্চিত করে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মৌসুমের শুরুতেই পাট ক্রয় করতে হবে। আগামী ১ অক্টোবরের মধ্যে যেসব পাট ক্রয়কেন্দ্র নূ্যনতম সাত হাজার ৫০০ মণ পাট কিনতে ব্যর্থ হবে সেগুলো তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দেওয়া হবে।
প্রান্তিক কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্টায়ত্ত সংস্থা বিজেএমসির। এই সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কাঁচা পাট ক্রয় করা। প্রান্তিক কৃষক যাতে পাটের ন্যায্য দর পায় এ উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রীয় পাটকল চালাচ্ছে সরকার। পাটনীতিতে বলা হয়েছে, অন্তত ৩০ শতাংশ পাট বিজেএমএসির মাধ্যমে কিনতে হবে। যাতে কৃষক সরকারের কাছে পাট বিক্রি করতে পারে।
বেসরকারি পাটকলের ক্রয় পরিস্থিতি জানতে চাইলে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) মহাসচিব আবুদল বারেক খান জানান, দেশে এবং দেশের বাইরে চাহিদা কমে যাওয়ায় তারাও এ বছর গত মৌসুমের তুলনায় পাট কম কেনার পরিকল্পনা নিয়েছেন। তিনি বলেন, স্কুলব্যাগ হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করাসহ পাটের চাহিদা সৃষ্টিতে সরকারের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। তাদের অন্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে আইন অনুযায়ী ১৯ পণ্যে পাটের মোড়ক বাধ্যতামূলক ব্যবহারের আইন কঠোর হাতে বাস্তবায়ন করা। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা না হলে বেশি পাট তাদের প্রয়োজন হবে না। গত মৌসুমে দেশে মোট ৬২ লাখ ১৩ হাজার বেল পাট কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ লাখ ৯ হাজার বেল কিনেছে বেসরকারি খাত। বাদবাকি ১২ লাখ ২২ হাজার বেল কিনেছে সরকারি খাত অর্থাৎ বিজেএমসি। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ মৌসুমে ৬ লাখ ৯৯ হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আবাদ হয়েছে ৬ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে। গত বছর ৮৫ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। এবারও একই পরিমাণ উৎপাদনের আশা করছে মন্ত্রণালয়।
পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) কৃষি উইংয়ের পরিচালক ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, সরকার পাট কম সংগ্রহ করলে বাজারে দর পড়তে বাধ্য। কারণ, বেসরকারি খাতও সেই সুযোগ নেবে। এছাড়া ভালো উৎপাদনের পর চাহিদা কমলে দর এমনিতেই কমে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। চলতি মৌসুমে পাট ক্রয়ের জন্য কম এজেন্সি দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে তিনি আরও বলেন, এবার পাট সংগ্রহ কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে ভারতে পাটপণ্যে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক্কারোপ এবং বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পাট রফতানি কমে যাওয়ার কারণটিও মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, যে কারণেই হোক কৃষক ন্যায্য দর না পেলে সেটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক হবে। এতে আবাদে আগ্রহ হারাবে চাষিরা। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
পাট উৎপাদন বেশি হয় এমন জেলার মধ্যে জামালপুর একটি। জানতে চাইলে আমাদের জামালপুর প্রতিনিধি মোহাম্মদ সোলায়মান এই প্রতিবেদককে জানান, বৃহস্পতিবার জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার কয়েকটি বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, তোষা পাট বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা মণ। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মৌসুমের এ সময়ে একই মানের পাটের দর ছিল দুই হাজার টাকা মণ। এখন দেশি জাতের পাট বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার টাকা মণ। গত বছর এই মানের পাটের দর ছিল এক হাজার ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে দর কিছুটা ভালো ছিল। তবে যত দিন গড়াচ্ছে ততই কমছে দাম। যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়াসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রতিনিধিরাও অভিন্ন চিত্রের খবর দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ধান ও চামড়া নিয়ে যা হয়েছে, পাট নিয়ে সেরকম কিছু হবে না। পাট নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আরও বলেন, সরকার মাত্র ১৫ শতাংশ পাট সংগ্রহ করে। বাকি ৮৫ শতাংশই করে বেসরকারি খাত। এই ১৫ শতাংশের কারণে পাট নিয়ে কোনো অস্থিরতার আশঙ্কা নেই।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত মৌসুমে প্রকৃত কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম পায়নি। ধান সংগ্রহ নিয়ে একপ্রকার অরাজকতা দেখা দিয়েছিল। প্রত্যাশিত দাম না পেয়ে মনের দুঃখে পাকা ধানের ক্ষেতে কেউ কেউ আগুন দিয়েছিল। এ নিয়ে সরকারকে বেশ সমালোচনায় পড়তে হয়। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়েও অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। মাঠ পর্যায়ে প্রান্তিক চামড়া ব্যবসায়ীরা পানির দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অনেকে মনের কষ্টে প্রকৃত মূল্য না পেয়ে কাঁচা চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলে প্রতিবাদ জানায়। পাটের ক্ষেত্রেও কৃষকদের সেই একই অবস্থা হতে যাচ্ছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এসব ঘটনায় সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ বারবার বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। মাঝখানে ফড়িয়া দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী ও পুঁজিপতিরা অন্যায্য মুনাফা লুটছে। বঞ্চিতরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না।
এসব কারণে ভালো আবাদ সত্ত্বেও এবার পাট সংগ্রহ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে বাজারে সেই প্রভাব পড়েছে। গত মৌসুমের তুলনায় মণপ্রতি পাটের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কমে গেছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পাটের দর আরও কমতে পারে। এতে কৃষক পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়া তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচ তোলা নিয়েই তারা সংকটে পড়তে পারে। এছাড়া এজেন্সি কম নিয়োগ দেওয়ার কারণে পাট বিক্রি করতেও সমস্যায় পড়বে চাষিরা।
পাটেরও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না চাষিরা। ধান, চামড়ার পর এবার পাট সংগ্রহ নিয়েও লেজেগোবরে অবস্থার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, চাষিদের কাছ থেকে পাট সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্রয়কেন্দ্র অর্থাৎ এজেন্সি নিয়োগ দেয়নি বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। সরকারি ২২ পাটকলের জন্য সারাদেশে মাত্র ৪৮টি এজেন্সিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই এজেন্সির সংখ্যা গত মৌসুমে ছিল ৯৮টি। এবার অর্ধেকেরও কম। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এজেন্সি নিয়োগে এবার অনিয়ম হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবার মিল গেট থেকে পাট সংগ্রহের সুযোগও রাখা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা মিল কর্তৃপক্ষকে খারাপ মানের পাট কিনতে বাধ্য করছেন। এ ধরনের ক্রয়ে ঘুষ লেনদেনেরও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।