সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ বৃহস্পতিবার থেকেই বহুল আলোচিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেছেন, আজ থেকে প্রত্যাবাসন শুরু করতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম দলে কতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংখ্যা নয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করাই এখন বড় কথা। তবে স্থানীয় সূত্র বলছে, কোনো রোহিঙ্গাই প্রত্যাবাসনে রাজি নন। ফলে এ নিয়ে শেষ মুহূর্তেও রয়েছে সংশয়ের দোলাচল।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ে ৩ হাজার ৫৪০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার জন্য তালিকা চূড়ান্ত করে পাঠিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এই তালিকা ধরেই প্রথম পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হবে। এরপর মিয়ানমার নতুন চূড়ান্ত তালিকা পাঠালে সে অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এর আগে মিয়ানমারের কাছে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠায় বাংলাদেশ। সেই তালিকা থেকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এই সংখ্যা চূড়ান্ত করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল বুধবার বলেন, ‘আশা করছি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কার্যক্রম ২২ আগস্ট থেকেই শুরু হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। তবে কোনো কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফিরতে নিষেধ করা হচ্ছে। কিছু দুষ্ট লোক আছে, যারা রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করতে ক্যাম্পে লিফলেটও বিতরণ করছে। এ কারণে কিছু চিন্তা আছে। তবে একটা কথা স্পষ্ট করেই বলতে চাই, রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার কথা সব সময়ই বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে তারা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ বসবাস এবং চলাফেরা নিশ্চিত করবে। এ ব্যাপারে তারা ব্যবস্থাও নিয়েছে। বিষয়টি তারা আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থাকেও জানিয়েছে। ফলে নিরাপত্তার বিষয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি নিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ১৯৮২ সালের আইন অনুযায়ী মিয়ানমারে তিন ধরনের নাগরিকত্ব চালু আছে। ওই আইন অনুযায়ীই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। তবে এখন কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ফেরত যাওয়ার পর তাদের নাগরিকত্বের প্রাথমিক স্বীকৃতিস্বরূপ একটি কার্ড দেওয়া হবে। এরপর বাকি ধাপগুলো সম্পন্ন করে আইন অনুযায়ী তিনটি ক্যাটাগরির মধ্যে যে ধরনের নাগরিকত্ব রোহিঙ্গাদের পাওয়ার কথা তা চূড়ান্ত করা হবে। অতএব নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টিও স্পষ্ট করেই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফিরতে অসম্মতি জানানোর কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
ড. মোমেন বলেন, রোহিঙ্গাদের বোঝা উচিত, নিজের দেশে ফিরে না গেলে কোনো অধিকারই তারা পাবে না। তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ, ভূমির অধিকার এবং নাগরিক অধিকার সবকিছুই নির্ভর করছে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার ওপর। নিজের মাতৃভূমিতে ফিরলেই তাদের সব ধরনের অধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে। একইভাবে বাংলাদেশের পক্ষেও দীর্ঘদিন এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ছোট এবং জনবহুল দেশ। এত বেশি জনগোষ্ঠীর চাপ নিতে গিয়ে এরই মধ্যে আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যেসব সংস্থা রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে নিষেধ করছে তাদের এ বিষয়গুলো বুঝতে হবে। চাইলে তারা বড় আয়তনের এবং কম জনসংখ্যার দেশে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখা হলে সেটা এ অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার ওপর হুমকির সৃষ্টি করবে।
প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজারে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আজ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ। প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা ২৩৫ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। প্রত্যাবাসনের কাজে ঘুমধুম ট্রানজিট পয়েন্ট প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি ৫টি বাস ও ২টি ট্রাক সকাল থেকে টেকনাফের শালবন ক্যাম্পে থাকবে। মিয়ানমারগামী রোহিঙ্গাদের মালপত্র বহনে এসব পরিবহন ব্যবহার করা হবে। প্রত্যাবাসনের জন্য ক্যাম্প ও সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
তিনি গতকাল সন্ধ্যায় জানান, বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। তবে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে জোর করে পাঠানো হবে না, এ ব্যাপারেও নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় নিজের দেশে ফিরে যেতে রাজি করার জন্য ক্যাম্পে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ২২ আগস্টকে লক্ষ্য ধরে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে এ তারিখ থেকেই ফেরত পাঠানো শুরু করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।
উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের অবস্থান এখন বেশ শক্ত। তারা খাবার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাটসহ যে নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে তেমনটা স্থানীয়রাও পাচ্ছে না। অর্থনৈতিকভাবেও রোহিঙ্গারা এখন এগিয়ে। প্রতিটি ক্যাম্পে বড় বড় বাজার গড়ে উঠেছে। এখানে তারা নিজস্ব সমাজব্যবস্থাও চালু করেছে। ফলে এমন জীবন ছেড়ে কেউ অনিশ্চিত জীবনে যেতে চাচ্ছে না। মূলত এ কারণেই রোহিঙ্গাদের ফেরানো যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।
অন্য একটি সূত্র জানায়, গত দুই দিনে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার দেওয়া রোহিঙ্গাদের কেউই নিজ দেশে ফেরত যেতে রাজি হয়নি। সব রোহিঙ্গাই নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ ৫ দফা না মানলে মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে জানিয়েছে।
গতকাল সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করে সাক্ষাৎকার দিতে আসা অন্তত ৩০ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে ggn24-প্রতিনিধির কথা হয়। তাদের শঙ্কা, রাখাইন রাজ্যে যেভাবে ছয় বছর ধরে ১ লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গাকে এক জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে, প্রত্যাবাসনের আওতায় ফেরত গেলে তাদেরও সেভাবেই রাখা হবে। তাছাড়া আবারও সেনা নির্যাতনের শিকার হতে হবে কি-না, সেই আশঙ্কাও আছে। এ রকম একটি অনিশ্চিত অবস্থায় রোহিঙ্গারা সে দেশে ফিরতে চায় না।
এদিকে গতকাল হিউম্যান রাইট ওয়াচের এক বিবৃতিতে এখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না করার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা সৃষ্টি এবং নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার পরই প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হওয়া উচিত।