অনলাইনে জুয়ার কারবার আর মুদ্রাপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার সেলিম প্রধান বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’। আর জুয়ার কারবারের টাকা সেলিম লন্ডনেও পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছে র্যাব।
সেলিম প্রধান ‘প্রধান গ্রুপ’ নামে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের চেয়ারম্যান। এই গ্রুপের অধীনে পি২৪ গেইমিং নামের একটি কোম্পানি আছে, যারা রীতিমত ওয়েবসাইটে ঘোষণা দিয়ে ক্যাসিনো ও অনলাইন ক্যাসিনোর কারবার চালিয়ে আসছিল।
র্যাব-১ অধিনায়ক সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, উত্তর কোরিয়ার এক ব্যক্তির মাধ্যমে বছর খানেক আগে অনলাইন গেইমিংয়ের কারবারে জড়ানোর কথা ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন’ সেলিম।
আর তদন্তে নেমে র্যাব একটি ‘গেইটওয়ের’ মাধ্যমে এক মাসে সেলিমের ব্যবসার নয় কোটি টাকা একটি ব্যাংকে জমা হওয়ার কথা জানতে পেরেছে বলে সারোয়ার বিন কাশেম জানান।
তিনি বলেন, “গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেলিম প্রধান। অবার বিএনপি নেতা তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হচ্ছে গিয়াসউদ্দিন আল মামুন।”
জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই কারাগারে আছেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। ঘুষ হিসেবে আদায়ের পর ২০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে এক মামলায় তার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
মুদ্রা পাচারের ওই মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানেরও একই সাজা হয়েছে। এছাড়া একটি দুর্নীতি মামলায় ১০ বছর এবং ২১ অগাস্ট গ্রেনেড মামলায় যাবজ্জীবন সাজার রায় নিয়ে তিনি বসবাস করছেন যুক্তরাজ্যে।
র্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘বন্ধু হিসাবে’ গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি ‘উপহার’ দেওয়ার কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন সেলিম প্রধান। তবে কবে সেই গাড়ি দিয়েছেন, সেটা বলেননি।
“সেলিম প্রধান লন্ডনে টাকা পাঠাত বলেও জানিয়েছে। এ বিষয়ে আরও জানার চেষ্টা চলছে।”
সোমবার বিকালে থাইল্যান্ড যাওয়ার পথে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে সেলিমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তাকে নিয়ে রাতে শুরু হয় র্যাবের অভিযান। র্যাবের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও তাতে অংশ নেন।
গুলশান ২ নম্বর সেকশনে সেলিম প্রধানের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রধান গ্রুপের অফিস ও বাসা এবং বনানীর একটি অফিসে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এই অভিযানে প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা, বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৯ লাখ টাকা ও মদ উদ্ধার করে র্যাব।
সেখান থেকে সাতটি ল্যাপটপ ও দুটি হরিণের চামড়া জব্দ করার পাশাপাশি সেলিমের কর্মচারী আক্তারুজ্জামান ও রোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের জ্যেষ্ঠ সরকারী পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, হরিণের চামড়া উদ্ধারের ঘটনায় সেলিম প্রধানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বন্য প্রানী সংরক্ষণ আইনে ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া সেলিম ও তার দুই কর্মীর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করার প্রস্তুতি চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে র্যাবের অনুরোধে সেলিম প্রধানের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বলে মিজানুর রহমান জানান।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, বিমান থেকে নামিয়ে আনার পর সেলিম প্রধানকে ‘ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ’ করেন তারা। এরপর তাকে নিয়ে প্রথমে তার গুলশানের বাসা এবং পরে অফিসে অভিযান চালানো হয়।
ওই দুই জায়গায় রাতভর চলে র্যাবের তৎপরতা। মঙ্গলবার সকালে বনানীর ২ নম্বর সড়কে সেলিমের আরও একটি অফিসের তথ্য পেয়ে সেখানেও তল্লাশি চালানো হয়।
গুলশানের একটি ঠিকানায় ‘প্রধান ফ্যাশন’, ‘প্রধান বিউটি কেয়ার অ্যান্ড স্পা’ নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেলিম প্রধানের। সেখানে গিয়ে ওই দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ পাওয়া গেছে বলে র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
যা পাওয়া গেছে সেলিমের কাছে গুলশানের বাসা ও অফিসে পাওয়া গেছে ৪৮ বোতল বিদেশি মদ, ২৩ দেশের বিদেশি মুদ্রা, যার মূল্যমান ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, মেয়াদসহ ও মেয়াদ ছাড়া মোট ১২টি পাসপোর্ট, ১৩টি ব্যাংকের ৩২টি চেকবই, একটি সার্ভার, নয়টি ল্যাপটপ, দুটি হরিণের চামড়া এবং নগদ ২৯ লাখ ৫হাজার ৫০০ টাকা। আর বনানীর অফিসে পাওয়া গেছে ২১ লাখ ২০ হাজার টাকা। |
অভিযান শেষে মঙ্গলবার বিকালে সেলিম প্রধানের বাসার নিচে সংবাদ সম্মেলনে আসেন র্যাব-১ অধিনায়ক সারোয়ার বিন কাশেম।
তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়ার নাগরিক ‘মি. দ্যু’র মাধ্যমে বছরখানেক আগে অনলাইন গেইমিংয়ে যুক্ত হন সেলিম। তাদের মধ্যে আধা-আধি শেয়ারের চুক্তিনামাও র্যাব পেয়েছে।
গুলশান ২ নম্বর সেকশনে ‘মমতাজ ভিশন’ নামে একটি ছয় তলা ভবনের চতুর্থ তলায় সেলিম প্রধানের অফিস, আর পঞ্চম তলায় বাসা।
ওই বাড়ির কেয়ারটেকার তাজুল ইসলাম জানান, দুটি ফ্ল্যাটের মালিক দুইজন। তাদের কাছ থেকে সেলিম ভাড়া নিয়েছেন প্রায় এক বছর আগে।
র্যাব বলছে, সেলিম ব্যাংক থেকে টাকা তোলা ও জমা দেওয়ার কাজটি করাতেন দুই কর্মচারী আকতারুজ্জামান ও রোকনকে দিয়ে।
সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, “অনলাইন গেইমের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে অন্তত তিনটি গেটওয়ের সন্ধান মিলেছে, যেসব গেইটওয়ের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকে টাকা জমা হয়। এর মধ্যে কর্মাশিয়াল ব্যাংক অব সিলনও রয়েছে।
“আমরা একটি গেটওয়েতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, একমাসে সেখানে নয় কোটি টাকা জমা হয়েছে। তিনটির বাইরে তার (সেলিম) আরও কোনো ব্যাংক বা গেইটওয়ে আছে কিনা- সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।”
১৯৭৩ সালে ঢাকায় জন্ম নেওয়া সেলিম তার ভাইয়ের হাত ধরে ১৯৮৮ সালে জাপানে চলে যান। পরে সেখানে শুরু করেন গাড়ির ব্যবসা।
পরে কয়েকজন জাপানির সঙ্গে থাইল্যান্ডে চলে যান সেলিম। সেখানে জাহাজ ভাঙ্গার ব্যবসা শুরু করেন।
জাপানিদের সঙ্গে ব্যবসা করার সময়ই ‘দ্যু’ নামে সেই উত্তর কোরীয়র সঙ্গে সেলিমের পরিচয় হয় জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, “মি. দ্যু প্রথমে বাংলাদেশে একসঙ্গে কনস্ট্রাকশন ব্যবসা শুরুর প্রলোভন দেখান সেলিমকে। পরে অনলাইন ক্যাসিনো খোলার পরামর্শ দেন।
তারপর তারা পি২৪ গেইমিং এবং টি২১ গেইম নামে দুটি সাইট খুলে অনলাইন ক্যাসিনো ও অনলাইন বেটিংয়ের ব্যবসা শুরু করে বলে র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
সেখানে বলা হয়, মোবাইলে বা কম্পিউটারে ওই সাইট থেকে অ্যাপ ইনস্টল করে জুয়া খেলতে হয়। সেজন্য ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একাউন্টের নম্বর দিতে হয়। খেলতে হলে কার্ডে বা অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম একটি অংকের টাকাও থাকতে হয়।
সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, “এই ব্যবসা থেকে আয়ের টাকা কখনো হুন্ডির মাধ্যমে, কখনো সঙ্গে বহন করে দেশের বাইরে পাচার করা হত, যা মানি লন্ডারিং আইনে পড়ে।”
পরে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, দেশে প্রধানের অনলাইন জুয়ার বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সন্ধানও র্যাব পেয়েছে।