ছাড়পত্র (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট বা টিসি) নিয়ে রমরমা বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলো। বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের ছাড়পত্র ইস্যুর নামে বোর্ডগুলো কোটি কোটি টাকা আয় করছে। অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষা বোর্ড তো কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়; তবু কেন সেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা হবে?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ভর্তি অনলাইনে সম্পন্ন হতে শুরু হওয়ার পর এ স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে টিসি নেওয়ার প্রবণতা দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়েছে। পছন্দসই কলেজে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় তারা দফায় দফায় কলেজ পাল্টায়। এ সুযোগে শিক্ষা বোর্ডগুলোও তাদের টিসি ফি বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া মা-বাবার বদলিজনিত ও বাসা বদলানোর কারণেও বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে টিসি নিতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের আগে ঢাকা বোর্ডে টিসি নেওয়ার সংখ্যা ছিল তিন থেকে চার হাজার। ২০১৫ সালের পর ৮ থেকে ১০ হাজার টিসি প্রতি শিক্ষাবর্ষে ইস্যু করতে হচ্ছে। দেখা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে শুধু প্রথম বর্ষেই দু’বার টিসি ইস্যু করতে হচ্ছে শিক্ষা বোর্ডগুলোকে। গত অক্টোবরে প্রথম দফা টিসি দেওয়ার কাজ শেষ হয়। জানুয়ারি মাসে আরেকবার টিসি ইস্যু করা হবে। আগে শুধু জানুয়ারিতেই টিসি ইস্যু করা হতো। টিসির সংখ্যা বাড়ার আরও একটি কারণ, পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এক ধরনের তাড়না কাজ করে।
ভুক্তভোগী কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, বিভিন্ন বোর্ডে টিসি দেওয়ার সময়কাল একই না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন হয়। এতে তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আশিক মোস্তফা আবীর নামের এক ছাত্র উদাহরণ দিয়ে জানায়, উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ক্ষেত্রে গত ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে টিসি দেওয়ার সময় শেষ হয়। বোর্ড কর্তৃপক্ষ আরও তিন দিন বাড়িয়ে তা ১৯ অক্টোবর নির্ধারণ করে। সেদিন টিসি দেওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। এদিকে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের টিসি দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ৩১ অক্টোবর। বোর্ডগুলোর টিসি দেওয়ার ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কারণে এবার ঢাকা থেকে টিসি নিয়ে চট্টগ্রাম বোর্ডের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারা যাচ্ছিল। অথচ চট্টগ্রাম বোর্ডের টিসি দেওয়ার তারিখ আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় ওই বোর্ডের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বোর্ডের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে আসতে পারছেন না। এতে যাদের মা-বাবা সরকারি বা বদলিজনিত চাকরি করেন, তাদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
দেখা গেছে, শিক্ষা বোর্ডগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যারেও ভিন্নতা রয়েছে। একই নিয়মে সব বোর্ডের সাইটে ঢোকা যায় না। একেক বোর্ডের ওয়েবসাইটে একেক কর্নার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকে। কমন কোনো ফরমেশন সেখানে নেই। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের দুই শিক্ষার্থী জানায়, এই বোর্ড থেকে টিসি নিতে গেলে একই ফরম চারবার পূরণ করতে হয়। এতে ছাত্রছাত্রীদের কষ্ট আর ভোগান্তি দুই-ই বেড়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে টিসির সব কাজ ডিজিটালি সম্পন্ন হলেও বাকি সব বোর্ডে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই করা হচ্ছে।
এসব বিষয়ে আলাপকালে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘সব বোর্ডে একসঙ্গে টিসি দেওয়া শুরু ও শেষ করা গেলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য তা ভালো হতো। ভবিষ্যতের জন্য এটি ভাবনার বিষয় হয়ে রইল।’ তবে ভিন্নমত পোষণ করে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মকবুল হোসেন বলেন, ‘মাইগ্রেশনের জন্য শিক্ষার্থীদের লম্বা সময় দেওয়া হয়। তাই বোর্ডগুলোর টিসি ইস্যুর সময়ের ভিন্নতা থাকলেও শিক্ষার্থীরা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল কবির জানান, বিটিসি বা বোর্ড ট্রান্সফারের আবেদন তারা সারাবছরই বিবেচনা করেন। কেবল এই বোর্ডের ভেতরে কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য টিসি নেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
হরেক রকম টিসি ফি: খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে টিসি ফি ৭০০ টাকা। কুমিল্লা বোর্ডেও ৭০০। নতুন প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে এই ফি ৮০০ টাকা। যশোর ও রাজশাহী বোর্ডে এক হাজার, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এক হাজার ২০০ টাকা, সিলেট বোর্ডে এক হাজার ৫০০ এবং বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে এই ফি সবচেয়ে বেশি- দুই হাজার টাকা। টিসি ফির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট শিক্ষার্থীকে আবার টিসির জন্য ব্যাংক ড্রাফট করতে হয়। সেখানে আরও ৫৮ টাকা ব্যাংক চার্জ দিতে হয়।
আবার একই বোর্ডে দুই ধরনের টিসি ফি রয়েছে। চট্টগ্রাম বোর্ডে ইন্টারনাল টিসি ফি (একই বোর্ডের আওতাধীন অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চাইলে) এক হাজার টাকা নেওয়া হলেও বোর্ড ট্রান্সফার বা বিটিসি (অন্য বোর্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে) ফি এক হাজার ২০০ টাকা।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল কবির মনে করেন, টিসি ফির ভিন্নতা থাকলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। সব শিক্ষা বোর্ডের আর্থিক সংগতি এক রকমের নয়। নতুন বোর্ডগুলোয় আয় কম। তাই তাদের বিভিন্ন ফির হার একটু বেশি। তিনি জানান, পরীক্ষার ফি ছাড়া বাকি সব ফি বোর্ডভেদে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের।
টিসি ফি গ্রহণে সর্বশীর্ষে থাকা বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ইউনুস যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘আমার বোর্ডে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্য সব বোর্ডের চেয়ে কম। আয়ও কম। সব খরচ বোর্ডের আয় থেকেই নির্বাহ করা হয়ে থাকে। বোর্ডের অর্থ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারেই সব ফি নির্ধারণ করা হয়। এটি চেয়ারম্যানের একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। আর আমার বোর্ডের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ।’
আরও যত ভোগান্তি: শিক্ষার্থীরা জানান, পাবলিক পরীক্ষা চলাকালীন দুর্ভাগ্যবশত কোনো শিক্ষার্থীর প্রবেশপত্র হারিয়ে গেলে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় তাদের। ফের প্রবেশপত্র ইস্যু করতে বোর্ডে যেতে হয়। বোর্ড থেকে ডুপ্লিকেট প্রবেশপত্র ইস্যু করানোর আগে রয়েছে কয়েক রকমের ঝক্কি। নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা, গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ নানা জটিলতা পেরিয়ে তারপর পেতে হয় ডুপ্লিকেট প্রবেশপত্র। এতে পরীক্ষাকালীন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় পড়েন সংশ্নিষ্ট পরীক্ষার্থী। একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান মনে করেন, আসলেই এসবের কোনো দরকার নেই। একবার প্রবেশপত্র ইস্যু করা হলে ছবি মিলিয়ে দ্রুতই সংশ্নিষ্ট পরীক্ষার্থীর নামে ডুপ্লিকেট প্রবেশপত্র ইস্যু করা যায়। বড়জোর সংশ্নিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রত্যয়ন চাওয়া যেতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীদের মানসিক যন্ত্রণা কমাতে এগিয়ে এসেছে। তারা এরই মধ্যে ডুপ্লিকেট প্রবেশপত্র ইস্যুর কাজ সহজ করে দিয়েছে। এ পদ্ধতিতে বোর্ডের মূল তথ্য সার্ভারের পাসওয়ার্ড সংশ্নিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রবেশপত্র হারালে সংশ্নিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্র থেকেই মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে প্রবেশপত্রের একটি প্রিন্ট আউট কপি সহজেই বের করে নিতে পারছেন পরীক্ষার্থী। এতে এই শিক্ষা বোর্ডের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারের মতো দূরবর্তী স্থান থেকে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চট্টগ্রামে আসার প্রয়োজন পড়ছে না। কেন্দ্র সচিবই ১০ টাকার বিনিময়ে প্রবেশপত্রের একটি কপি প্রিন্ট করে দিচ্ছেন সংশ্নিষ্টদের।
সম্মানীর নামে অর্থ লুটপাট: জানা গেছে, শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বছরে ছয়টি বোনাস পেয়ে থাকেন। এর বাইরে কর্মকর্তারা বিভিন্ন মিটিংয়ে সিটিং অ্যালাউন্স তুলে নিচ্ছেন ইচ্ছেমতো। উত্তোলন করছেন পরিদর্শন ভাতা, অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের নামে ভাতা, রয়েছে ওভার টাইম। বিষয়টি এখন অনেকটা এমন দাঁড়িয়েছে, বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল দায়িত্ব কোনটি, সেটিই নির্ধারণ এখন দুরূহ হয়ে গেছে।
একাধিক প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ জানান, পরীক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও প্রবেশপত্র স্বাক্ষরের জন্য বোর্ডের সংশ্নিষ্ট পরিদর্শক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা সম্মানী নেন। আগে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফরমে সই করার জন্য ৫০ পয়সা বা ২০ পয়সা (বোর্ডভেদে ভিন্ন ভিন্ন) করে সম্মানী নিতেন বিদ্যালয় পরিদর্শক। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন কার্ডে সইয়ের জন্য সম্মানী নেন কলেজ পরিদর্শক। আর প্রবেশপত্রে সইয়ের জন্য সম্মানী নেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। বর্তমানে সফটওয়্যার অটোমেশনের মাধ্যমে এসব কাজ ডিজিটালি সম্পন্ন হওয়ায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং স্কুল ও কলেজ পরিদর্শকদের নিজ হাতে স্বাক্ষর করা লাগে না। অথচ তারা এই কাজের জন্য একই হারে সম্মানী নিয়ে চলেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক তদন্তে ধরা পড়েছে, গত কয়েক বছরে আটটি শিক্ষা বোর্ডে ১৫৪ কোটি টাকার ‘সম্মানী’ বোর্ড কর্মকর্তারা অতিরিক্ত গ্রহণ করেছেন, যা তাদের প্রাপ্য ছিল না।
সই না করে সইয়ের সম্মানী গ্রহণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মকবুল হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি ঠিক আমার জানা নেই।’ আর ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল কবির বলেন, ‘সই না করে কেউ সম্মানী নিলে তা সঠিক হবে না।’ কুমিল্লা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘প্রবেশপত্র ও রেজিস্ট্রেশন কার্ডে এখন কোনো সই লাগে না। শুধু কারও এ দুটি জিনিস হারিয়ে গেলে পুনরায় ইস্যুর সময় লাগে। তবে একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ও সনদপত্রে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সই লাগে। তাই এ সম্মানী নেওয়া হয়। এটি কোনো অবৈধ আয় নয়। এ ব্যাপারে সরকারি পরিপত্রও রয়েছে।’