রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারকে ৪ নির্দেশ আইসিজে’র

rohingya-refugees-230120-01

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারকে জরুরি ভিত্তিতে চার দফা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)।

জাতিসংঘের এই সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা কোনো পক্ষ এমন কিছু করতে পারবে না, যা গণহত্যা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। গণহত্যার অভিযোগের সমস্ত আলামত তাদের সংরক্ষণ করতে হবে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে গাম্বিয়ার করা এক আবেদনের প্রেক্ষিতে আইসিজের ১৭ সদস্যের বিচারক প্যানেল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন এই আদেশ দেয়।

আইসিজের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুলকাভি আহমেদ ইউসুফ নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেস থেকে এই আদেশ ঘোষণা করেন।

তাতে এই আইনি লড়াইয়ে গাম্বিয়ার প্রাথমিক বিজয় আসে, বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার অনিশ্চিত জীবনে আসে একটুখানি আনন্দের উপলক্ষ।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার অভিযোগ ছিল, দুই বছর আগে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করেছে মিয়ানমার।

দ্য হেগের পিস প্যালেসে গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এ মামলার ওপর প্রাথমিক শুনানি হয়। তাতে গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। অন্যদিকে মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি।

বৃহস্পতিবার আদেশের শুরুতে মিয়ানমারের যুক্তি নাকচ করে দিয়ে আইসিজের প্রেসিডেন্ট বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না- সেই বিচারের এখতিয়ার আইসিজের রয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশনের ভিত্তিতে এই মামলা করার মত প্রাথমিক অধিকারও গাম্বিয়ার আছে।

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার যে আবেদন গাম্বিয়া করেছে, তা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে মিয়ানমারকে চারটি নির্দেশনা দিয়েছে এ আদালত।

১. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা বা হত্যার চেষ্টা, তাদের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করার চেষ্টা, তাদের জীবনযাপনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কোনো পদক্ষেপ কিংবা ওই জনগোষ্ঠীর জন্মহার কমানোর যে কোনো ধরনের চেষ্টা বন্ধের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা মিয়ানমারকে অবশ্যই নিতে হবে।

২. মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বা কোনো সশস্ত্র গ্রুপ যেন এমন কোনো কর্মকাণ্ড না ঘটায় যা গণহত্যা বা গণহত্যার ষড়যন্ত্রের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

৩. গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো আলামত ধ্বংস করা যাবে না, বরং সেগুলো যাতে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তা মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে।

৪. এই আদেশের ভিত্তিতে মিয়ানমার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে এই আদেশ হওয়ার চার মাসের মধ্যে আইসিজেতে প্রতিবেদন দিতে হবে। তারপর আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পরপর অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে হবে।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘের এই সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় আসতে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে।

তার আগে বৃহস্পতিবারের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে ১৭ বিচারকের প্যানেল সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে রোহিঙ্গারা এখনও গণহত্যার ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে এ আদালত বিশ্বাস করে এবং এ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ মিয়ানমারকে নিতে হবে।

আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা এ মামলায় গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তি বিধানে ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষরিত কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। ১৯৫৬ সালে ওই ‘জেনোসাইড কনভেনশনে’ সই করেছিল মিয়ানমার; গাম্বিয়াও এ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ।

এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো শুধু গণহত্যা থেকে বিরতই থাকবে না, এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং এমন অপরাধের জন্য শাস্তি বিধান করতেও অঙ্গীকারাবদ্ধ।

ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ তুলতে পারে। এ আদালত কোনো ব্যক্তিবিশেষকে সাজা দিতে পারে না, যেমনটি পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। আইসিসি আলাদাভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনা তদন্ত করছে।

আইসিজেতে মামলা হলে আদালতের সিদ্ধান্ত মানার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে সদস্য দেশগুলোর ওপর। আর সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। তবে সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা নেই এ আদালতের। সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করারও বহু উদাহরণ রয়েছে।

মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়েছে কিনা সে বিষয়ে রায় দিতে হলে আদালতে এটা প্রমাণ হতে হবে যে, রাষ্ট্রটি রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করেছে।

তবে সেটা যদি প্রমাণও হয় তবুও অং সান সু চি কিংবা মিয়ানমারের জেনারেলদের গ্রেপ্তার করা কিংবা তাদের বিচার করার মত পদক্ষেপ নিতে পারবে না আইসিজে।

মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দিলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো পদক্ষেপ আসতে পারে। তাতে মিয়ানমার বিশ্বে ভাবমূর্তি সঙ্কট এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

দ্য হেগের এই আদালত তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণার কিছুক্ষণ আগে ফিনানশিয়াল টাইমস মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। সেখানে তিনি বলেন, রাখাইনে সেনা অভিযানে যুদ্ধাপরাধ হলেও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু দেশান্তরী হওয়া ওই জনগোষ্ঠী নিপীড়নের যে বিবরণ দিয়েছে, তা ‘অতিরঞ্জিত’।

অন্যদিকে আদেশের পর গাম্বিয়ার বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু বলেন, “আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার জন্যই এ এক বড় বিজয়।

আইসিজের আদেশ উপলক্ষে দ্য হগে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরাও আদালতের রায়কে উদযাপন করেন প্রাথমিক বিজয় হিসেবে।

কানাডা থেকে আসা রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ইয়াসমিন উল্লাহ রয়টার্সকে বলেন, “বহু বছর ধরে আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে শুধু একটি অধিকারের জন্য, তারা যেন আমাদেরও অন্য সবার মত মানুষের মর্যাদাটা দেয়।”

এ কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় কক্সবাজারের এক আশ্রয়শিবির থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আইসিজের আদেশের লাইভ ভিডিওতে চোখ রাখা মোহাম্মেদ নূরের কথায়।

রয়টার্সকে তিনি বলেন, “এই প্রথম বোধহয় আমরা কোনো আদালতে একটু সুবিচার পেলাম। সকল রোহিঙ্গার জন্য এ এক বড় অর্জন।”

২০১৮ সালে জাতিসংঘের স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গণহারে হত্যা, ধর্ষণ এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে রেহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি নির্মূল করাই ছিল ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনে সেনা অভিযানের মূল উদ্দেশ্য।

সেনাবাহিনীর ওই সাঁড়াশি অভিযানে অন্তত ১০ হাজার মানুষ নিহত হয় বলে তদন্তকারীদের ধারণা। আর প্রাণ বাঁচাতে  প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়,  রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।

আর অং সান সু চির বেসামরিক সরকার ‘বিদ্বেষমূলক প্রচারকে উসকে’ দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ ‘আলামত ধ্বংস’ করেছে এবং সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ‘ব্যর্থ হয়েছে’। এর মধ্যে দিয়ে মিয়ানমার সরকারও নৃশংসতায় ‘ভূমিকা’ রেখেছে।

——————————————————————————————————————————————————————————-

icj-samakal-সমকাল-5e29736cd9b24

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় মিয়ানমারের প্রতি অবশ্যপালনীয় ৪টি অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।

বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) নেদারল্যান্ডসের হেগে স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা) অন্তর্বর্তী নির্দেশ বিষয়ক এ রায় পড়তে শুরু করেন আইসিজের প্রেসিডেন্ট আব্দুল কাওয়াই আহমেদ ইউসুফ। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তিনি রায় পড়ে শোনান। আইসিজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে সরাসরি এ রায় ঘোষণা সম্প্রচার করা হয়।

এর গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর ৩ দিনব্যাপী নেদারল্যান্ডসের হেগে এ মামলার শুনানি হয়। তাতে মিয়ানমারের পক্ষে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি অংশ নেন। সে সময় তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার রাখে না বলেও দাবি করা হয় মিয়ানমারের পক্ষে।

অন্যদিকে গাম্বিয়া রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে আদালতকে অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ জানায়।

এদিন শুরুতে ওই শুনানির সূত্রে গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের অবস্থান নিয়ে আদালতের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। আদালত জানান, গণহত্যা কনভেনশনের সদস্য রাষ্ট্র   হিসেবে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার রাখে।

ডিসেম্বরে মামলার শুনানিতে সু চি বলেন, সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’র বিরুদ্ধেই মূলত ২০১৭ সালে রাখাইনে সেনা অভিযান চালানো হয়। ওই গোষ্ঠী বেশ কিছু সেনা চৌকিতে হামলা চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করার প্রতিক্রিয়ায় ওই অভিযান পরিচালিত হয়।

আদালত মিয়ানমারের এ আত্মপক্ষ সমর্থনের সমালোচনা করে বলেন, ২০১৭ সালে মিয়ানমার যে সেনা অভিযান চালায় তাতে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। ব্যাপকহারে হত্যা, ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় বেসামরিক রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি ও বেসামরিক রোহিঙ্গাদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেনি।

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার বক্তব্য, এ বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য ও গণহত্যা কনভেনশনে উল্লেখিত গণহত্যার সংজ্ঞা অনুসারে মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর যে ধরনের নিপীড়ন ও সহিংসতার অভিযোগ উঠেছে তা গণহত্যার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে জানান আদালত। মিয়ানমারে এখনও বিভিন্ন ক্যাম্পে ৬ লাখ বিপন্ন রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে জানান আদালত।

আরও বিস্তারিত তদন্ত, সুস্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের আগে আদালত এখনই চূড়ান্ত রায় দেবেন না। এজন্য আরও সময় প্রয়োজন। কিন্তু সার্বিক বিশ্লেষণে রোহিঙ্গারা বিপন্ন প্রতিভাত হওয়ায় তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে চূড়ান্ত রায়ের আগ পর্যন্ত মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে অবশ্যপালনীয় ৪টি অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

অন্তর্বর্তী এ ৪ নির্দেশ হলো-

মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সব ধরনের হত্যা, হত্যা প্রচেষ্টা নিরসন করতে হবে। সেই সঙ্গে দূর করতে হবে তাদের যে কোনো রকমের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির আশঙ্কা। নিশ্চিত করতে হবে তাদের অধিকার। 

দেশটির সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী বা যে কেউ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর ব্যাপারে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র, উস্কানি বা কুকর্মে সহযোগিতার সুযোগ পাবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে।  

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের প্রমাণ ধ্বংস করা যাবে না। সব প্রমাণ অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে।   

উপরোক্ত নির্দেশগুলো যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে ৪ মাস পর মিয়ানমার সে বিষয় নিশ্চিত করে আইসিজেকে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর থেকে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক ৬ মাস অন্তর অন্তর মিয়ানমারকে এ বিষয়ক প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। সেসব প্রতিবেদন গাম্বিয়াকে পৌঁছানো হবে। গাম্বিয়া সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের মতামত জানাবে।  

গত বছরের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগ তুলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান দেশ গাম্বিয়া।

এরপর গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর ৩ দিনব্যাপী নেদারল্যান্ডসের হেগে ওই মামলার শুনানি হয়। এতে মিয়ানমারের পক্ষে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি অংশ নেন। সে সময় তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। ২০১৭ সালে রাখাইনে সেনা অভিযানকালে কিছু সেনা আইন লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন সু চি।

অন্যদিকে গাম্বিয়া মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখা যায় না বলে জানায়। তারা রোহিঙ্গা গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে অন্তর্বর্তী নির্দেশের দেওয়ার অনুরোধ করে।

২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ‘তাতমাদাও’র অভিযানে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

রাখাইনে গণহত্যা বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে: আইসিজে

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গণহত্যামূলক সহিংসতা বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। সেইসঙ্গে এ ধরনের সহিংতার সাক্ষ্যপ্রমাণ ধ্বংস করা যাবে না বলেও আদেশ দিয়েছে আইসিজে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার করা মামলার রায়ে  এই আদেশ দিয়েছে আইসিজে।

২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরদার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যাকাণ্ড, সংঘর্ষ, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বাস্তবতায় জীবন বাঁচাতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। এ নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিজেতে এ মামলা করে গাম্বিয়া।

এ বিষয়ে নেদারল্যান্ডসের হেগে শুনানি হয় ২০১৯ সালের ১০-১২ ডিসেম্বর।

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা প্রদান ও রাখাইনে গণহত্যার আলামত নষ্টের বিভিন্ন অভিযোগের ওপর এই শুনানি হয়। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিতে আদালতের প্রতি আহ্বান জানায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।

ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে মামলা করা গাম্বিয়া মিয়ানমারের গণহত্যার আচরণ অবিলম্বে বন্ধ করার ব্যবস্থা বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে জরুরিভাবে আদেশ দেওয়ার আহ্বান জানায়।

গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবাকার মারি তামবাদো ওই সময় এক বিবৃতিতে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের চালানো গণহত্যার বিচার ও জবাবদিহি চাইতে এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক আচরণ যা সব রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক তাকে সমর্থন ও জোরদার করতে গাম্বিয়া এ পদক্ষেপ নিচ্ছে।’

তবে মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী ও আদালতে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করা নোবেল জয়ী অং সান সু চি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে করা মামলাটি ‘অসম্পূর্ণ’ ও ‘বিভ্রান্তিকর’। তিনি দাবি করেন, এ বিষয়ে মামলা পরিচালনার এখতিয়ার জাতিসংঘের আদালতের নেই। গণহত্যার অভিযোগ খারিজ করতে বিচারককে তিনি আহ্বান জানান।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) অনুসারে, ১৯৯৩ সালের আন্তর্জাতিক আদালতে প্রথম গণহত্যা বিষয়ক মামলায় সার্বিয়ার বিরুদ্ধে অস্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। কারণ ওই মামলায় প্রমাণিত হয়েছিল যে, সার্বিয়া বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি স্থাপনে দায়িত্ব লংঘন করেছিল।

Pin It