পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও মিল মালিক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। আসন্ন রমজানের বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিতে ব্যবসায়ীরা প্রায় তিন মাস আগে থেকেই এ কারসাজি শুরু করেছেন বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা। ব্যবসায়ীদের এই কারসাজি রোধে এখনই পদক্ষেপ নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বেশকিছু সুপারিশও করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা এই বাহিনী।
সম্প্রতি পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি মীর শহিদুল ইসলাম ছয় পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল ও মসলা জাতীয় পণ্য এবং পেঁয়াজের বাজারের সার্বিক চিত্র বাণিজ্য সচিব জাফর উদ্দীনকে জানিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। আমদানি, কোম্পানির উৎপাদন, পাইকারি বাজার ও খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে সরেজমিনে খোঁজখবর নিয়ে পুলিশের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, চাল, পেঁয়াজ, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল ও মসলা পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ক্রেতার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার কারণ হিসেবে উৎপাদন ঘাটতি ও আমদানিতে বেশি খরচের কথা বললেও বাজারে সব ধরনের পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। দাম বাড়ার পেছনে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি, বাজার মনিটরিংয়ের শিথিলতা ও সরকারকে বিব্রত করতে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা রয়েছে। এসব পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি এখনই রোধ করা না গেলে আসছে রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। যাতে ভোক্তা সাধারণ দুর্ভোগের শিকার হবেন আর সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশ দিনে খুচরা বাজারে চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে। কৃষকের কাছে থাকা আমন মৌসুমের ধান শেষ হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন মিল মালিক ও আড়তদাররা। তাদের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আড়তদার ও মিল মালিকরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। এ বছর তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়েছে। এতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরো চাষ হবে না। ফলে উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সম্প্রতি ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। এই বৃদ্ধিও অযৌক্তিক বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি। সংস্থাটি বলছে, দেশে যে সকল কোম্পানি ভোজ্যতেল পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারজাত করে তাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বাজারে সরবরাহও পর্যাপ্ত। এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে চীনের আমদানি কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। বিশ্ববাজারে দাম কমতে থাকায় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পামওয়েল আগের চেয়ে ১২ টাকা ও সয়াবিন ৯ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু খোলা বাজারে তার প্রভাব নেই। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা কারসাজি করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়াচ্ছে।
পেঁয়াজ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ব্যাপক ঘাটতির পর দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসায় দাম কমে এসেছিল। সম্প্রতি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসা অব্যাহত রয়েছে। ফলে এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যদিকে চীনে করোনাভাইরাসের অজুহাতে বাজারে আদা, রসুনের দাম প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। আগামীতে আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ১০ দিনের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। গত মাসের শেষে প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ছিল ১০৫ থেকে ১১০ টাকা, যা বর্তমানে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ছোলার দামও বেড়েছে। রমজান মাসে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টন মসুর ডালের চাহিদা থাকে। ছোলার চাহিদাও সমান পরিমাণে। অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের কথা বলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। এজন্য ছোলা ও ডাল আমদানির জন্য বিকল্প দেশ খোঁজা হচ্ছে। চিনির দাম ঠিক রাখতে রমজানের আগে ও রমজানের সময় চিনি পরিশোধনকারী বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে সচল রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আসন্ন রমজানে টিসিবিকে আরও বেশি কার্যকর করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে বাজারে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবসায়ীরা পণ্যের সংকট যাতে সৃষ্টি করতে না পারেন সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সিটি করপোরেশনকে প্রতিদিন বাজারে বাজারে পণ্যের মূল্য তালিকা টানিয়ে দিতে হবে এবং মূল্য তালিকা অনুযায়ী বিক্রি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। অসৎ ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে।
প্রতিবেদনে আমদানির প্রতিবন্ধকতার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দাবানলের কারণে অস্ট্রেলিয়াতে পণ্যের রপ্তানি মূল্য বেড়ে গেছে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে চীনের রপ্তানি বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এই দুটো দেশ বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্য আমদানির অন্যতম উৎস। ফলে ব্যবসায়ীরা আমদানি বন্ধের প্রচারণা বা অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছেন। এজন্য সহজে নতুন দেশ থেকে আমদানির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে এবং টিসিবির মাধ্যমে ভোগ্যপণ্য আমদানি করে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পরামর্শ এসেছে। নতুবা রমজানে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা কষ্টসাধ্য হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।