ঢাকা-১০: আ’লীগ-বিএনপির মর্যাদার লড়াই

Untitled-55-samakal-5e42fa1d166ba

ঢাকা-১০ (ধানমন্ডি-কলাবাগান-হাজারীবাগ-নিউমার্কেট) আসনের উপনির্বাচনে ‘মর্যাদার লড়াইয়ের’ জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় আসনটি নিজেদের কবজায় বহাল রেখে বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে। অন্যদিকে বিএনপি এই উপনির্বাচনকে দেখছে ‘ভোটাধিকার রক্ষার লড়াই’ হিসেবে।

গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের পদত্যাগের কারণে ঢাকা-১০ আসন শূন্য হয়। ১ ফেব্রুয়ারির ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হন।

ইতোমধ্যে ঢাকা-১০সহ অন্য দুটি শূন্য আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ২১ মার্চ এই তিন আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, এই তিন আসনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ১৯ ফেব্রুয়ারি, মনোনয়নপত্র বাছাই ২৩ ফেব্রুয়ারি এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৯ ফেব্রুয়ারি।

ঢাকা মহানগরীর ধানমন্ডি, কলাবাগান, হাজারীবাগ ও নিউমার্কেট থানা নিয়ে ঢাকা-১০ আসন গঠিত। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন ঢাকা-৯ ভেঙে ঢাকা-১২ আসন গঠন করা হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আবারও সংসদীয় এলাকার কিছুটা রদবদল করে ঢাকা-১০ আসন পুনর্গঠন করা হয়। এই আসন থেকে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮-টানা তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন শেখ ফজলে নূর তাপস। এর মধ্যে ২০০৮-এর নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এমপি (তৎকালীন ঢাকা-১২ আসন) নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৪ সালের দশম নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনর্নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যতম এই উত্তরাধিকার। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আবদুল মান্নানকে হারিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো এমপি হন তাপস।

ঢাকা-১০ আসনের মূল এলাকা ধানমন্ডি রাজধানীর ‘অভিজাত’ এলাকা হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির বসবাস এ এলাকায়। এখানে রয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব বাসভবন এবং রাজনৈতিক কার্যালয়। অন্যদিকে হাজারীবাগ এলাকায় রয়েছে স্থানীয় ঢাকাবাসীসহ নানা শ্রেণি ও আয়ের মানুষজনের আবাসস্থল। অতীতে যে দলই এই আসন থেকে জয়ী হয়েছে, সেই দলই সরকার গঠন করেছে। এ কারণে ঢাকা-১০ আসনকে দেশের ভিআইপি ও মর্যাদার আসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সম্ভাব্য প্রার্থীর আলোচনায় বঙ্গবন্ধু পরিবার :ঢাকা-১০ আসনসহ অন্য পাঁচটি আসনের উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আবেদন ফরম বিতরণ ও জমা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। গত সোমবার শুরু হওয়া এই কার্যক্রম চলবে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক হতে পারে। ঢাকা-১০সহ পাঁচটি আসনের উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারা নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হবেন, তা এ বৈঠকেই চূড়ান্ত হবে।

নেতারা বলছেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ের পর এবার রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ আসন ঢাকা-১০-এর উপনির্বাচনে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে দলে। এ লক্ষ্যে এই আসনের টানা তিনবারের এমপি ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের মতো জনপ্রিয় ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কাউকে প্রার্থী করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। দলের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনায় কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হতে পারে।

এই আসনে নৌকার টিকিট আবারও বঙ্গবন্ধু পরিবারেরই কেউ পাবেন, নাকি অন্য কাউকে প্রার্থী করা হবে- এ নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক কৌতূহল দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে। কারণ এখানে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তাপসের বড় ভাই যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্‌ পরশ এবং তাপসের সহধর্মিণী আফরিন তাপসের নাম আলোচিত হচ্ছে। তাপসের ছেড়ে দেওয়া আসনে তারই পরিবারের কাউকে বেছে নেওয়া হলে সেক্ষেত্রে এই দু’জনের যে কোনো একজনকে প্রার্থী করা হতে পারে। সাম্প্রতিক ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচার অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে সবার নজরে এসেছেন তারা দু’জন।

সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এখানে আরও আলোচনায় রয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। বঙ্গবন্ধুর এই দৌহিত্র আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। দলের কার্যক্রম বিশেষ করে বিভিন্ন নির্বাচনী কার্যক্রমে ববির গুরুত্বপূর্ণ অবদান দলীয় নীতিনির্ধারকদের বিশেষ দৃষ্টিও কেড়েছে।

অবশ্য বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বাইরেও আরও কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীর কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এবং ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান।

বিএনপিতে ঘুরেফিরে তিনজনের নাম :নির্বাচন নিয়ে সরকার ও ইসির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকার পরও বিভিন্ন আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। সদ্য সমাপ্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের মতো গুরুতর অভিযোগ তুললেও ‘ভোটের অধিকার রক্ষায়’ নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডের।

দলের এমন সিদ্ধান্তে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা যোগাযোগ শুরু করেছেন নীতিনির্ধারক নেতাদের সঙ্গে। লবিং-তদবিরের পাশাপাশি নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে মাঠে নেমেছেন তারা। তবে এই নির্বাচন নিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলেও দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

ঢাকা-১০ আসনে প্রায় প্রতিবারই বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তন করায় এবং স্থানীয় নেতার পরিবর্তে বহিরাগত নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ায় এ এলাকায় দলটির একক দায়িত্বশীল কোনো নেতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এর ফলে দলের ‘দুঃসময়ে’ পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকেও খুঁজে পাননি স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আসেন, নির্বাচন করেন, চলে যান। এবার তারা স্থানীয় কোনো নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে।

ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক ও ধানমন্ডি থানা কমিটির সদস্য সচিব শেখ রবিউল আলম রবির নাম। অনেক আগে থেকেই এ এলাকায় সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে আসছেন তিনি। তবে গত নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ায় তার জায়গায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানকে মনোনয়ন দিয়েছিল দলটি।

সমর্থকদের দাবি, শেখ রবিউল আলম রবি দলের দুঃসময়ে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। মামলা পাওয়ার ক্ষেত্রে ডাবল সেঞ্চুরির কাছাকাছি রয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত সাতবার কারাগারে যেতে হয়েছে ছাত্রদলের সাবেক এ নেতাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর নগর বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত রবি তৃণমূলের প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করে মহানগর রাজনীতিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচনী এলাকায় দল ও সব অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন তার নিয়ন্ত্রণাধীন থাকায় আগামী উপনির্বাচনে তার প্রার্থিতা অনেকটা নিশ্চিত বলে মনে করেন তার অনুসারীরা।

তবে গত নির্বাচনের প্রার্থী আবদুল মান্নান উপনির্বাচনেও দলের মনোনয়ন চাইবেন। এর আগে ঢাকা-১ আসন থেকে বিএনপির টিকিটে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হলেও গত নির্বাচনে তাকে ঢাকা-১০ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয়দের কাছে নতুন মুখ হিসেবে নির্বাচনে ভালো করতে পারেননি তিনি। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রক্ষাও করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এ ছাড়া আবদুল মান্নানের জামাতা ও বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীমও দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন। তবে দীর্ঘ ছয় বছর লন্ডনে টানা অবস্থান করায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বর্তমানে কোনো যোগাযোগ নেই দলের এই কেন্দ্রীয় নেতার। সব মিলিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে শেখ রবিউল আলম রবিকে নিয়েই বেশি আশাবাদী দলটির নেতাকর্মীরা ।

Pin It