অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ সংখ্যক চারটি শিরোপা জয়ী ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ইতিহাসে নাম লেখালো বাংলাদেশের যুবারা। ভারতের দেয়া ১৭৮ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে শুরু থেকেই দুর্দান্ত খেলতে থাকা বাংলাদেশ ৪২.১ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে জয় নিয়ে ইতিহাস গড়লো আকবর বাহিনী।
দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রমে পারভেজ হোসেন ইমন ও তানজিদ হাসান তামিমের উড়ন্ত সূচনায় প্রথমবারের মতো কোন ক্রিকেট বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলো বাংলাদেশ। এ জয়ের ফলে বাঙালী জাতিকে এক সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেলো বাংলাদেশ ক্রিকেট। ১৭৮ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে দলীয় ৫০ রানের মাথায় প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ শিবির। ৮.৫ ওভারের মাথায় ব্যক্তিগত ১৭ রান করে রবি বিষ্ণুর শিকার হন তামিম। এই ১৭ রানে এক ছক্কা ও দুটি চারের মার ছিলো তার।
তামিমের বিদায়ের পর মাহমুদুল হাসান জয়কে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন ওপেনিংয়ে নামা ইমন। তবে তাকে বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে পারেননি মাহমুদুল হাসান জয়। ১২.৫ ওভারের মাথায় রবি বিষ্ণুর দ্বিতীয় শিকার হয়ে ব্যক্তিগত মাত্র ৮ রান করে মাঠ ছাড়েন তিনি। উদ্বোধনে নামা ইমন মাথায় আঘাত পেলে ক্রিজে আসেন তৌহিদ হৃদয়।
রবি বিষ্ণুর লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে থাকা বল পায়ে আঘাত লাগলে আম্পায়ার হৃদয়কে আউট হওয়ার সিগনাল দেন। ফলে বিষ্ণুর তৃতীয় শিকায় হয়ে ০ রানেই মাঠ ছাড়তে হয় হৃদয়কে।
তবে বাংলাদেশ শিবিরে বড় ধাক্কাটা আসে ১৬.১ ওভারের মাথায়। দলীয় ৬৫ রানের মাথায় রবি বিষ্ণুর বলে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়ে শাহাদাত হোসেনও ফেরেন মাত্র ১ রান করেই। বিপর্যয় এড়াতে শামীম হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে অধিনায়ক আকবর আলী বাংলাদেশের ইনিংস বড় করার লক্ষ্যে ব্যাট করতে থাকেন। কিন্তু সুশান্ত মিশ্রর বলে ক্যাচ দিয়ে ৭ রানেই মাঠ ছাড়েন শামীম। এরপর ধীর গতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ শিবিরে মিশ্রর দ্বিতীয় শিকার হয়ে মাঠ ছাড়েন অভিষেক দাস। তার ব্যাট থেকে আসে ৫ রান। ১০২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ।
এরপরই মাঠে নামেন বিশ্রামে যাওয়া ইমন। এই জুটি বাংলাদেশকে জয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দলীয় ১৪৩ রানের মাথায় অর্ধশতকের কাছে গিয়েও ৪৭ রানে পারটাইম বোলার জয়শোওয়ালের শিকার হয়ে সাজঘরে ফেরেন ইমন। আকবর-ইমনের জুটি থেকে আসে ৪১ রান। তার আউটের পর আবারো জয়ের শঙ্কায় পড়ে বাংলাদেশ। পরে রকিবুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে আবারো হাল ধরেন আকবর আলি। এই জুটি থেকে আসে ২৭ রান। জয় থেকে মাত্র ১৫ রান দুরে থাকলে বৃষ্টির হানায় খেলা সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর মাঠে নামলে বৃষ্টির হানায় আম্পায়ার খেলা বন্ধ করে দেয়। ফলে বৃষ্টি-আইনে ৩ উইকেটে জয় পায় বাংলার যুব টাইগাররা। বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর আলির ব্যাট থেকে আসে অপরাজিত ৪৩ রান। তবে এই ম্যাচে ৩৩ রান আসে অতিরিক্তের খাতা থেকে। ভারতের হয়ে বল হাতে রবি বিষ্ণু ১০ ওভারে ৩০ রান দিয়ে নেন ৪টি উইকেট। সুশান্ত মিশ্র নেন দুটি উইকেট।
এরআগে, টস হেরে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশী বোলারদের তোপের মুখে শুরু থেকেই ধুকতে থাকে ভারতের যুবারা। ৬.৪ ওভারে মাত্র ৯ রানের মাথায় সাক্সেনাকে ২ রানে ফিরিয়ে দিয়ে ভারত শিবিরে প্রথম আঘাত হানেন অভিষেক দাস। তবে তিলক ভার্মাকে সঙ্গে নিয়ে বড় টার্গেটের দিকেই এগিয়ে যেতে থাকেন জয়শোওয়াল। ২৮.৬ ওভারের মাথায় তানজিম হাসান সাকিবের বলে আউট হওয়ার আগে এ জুটি থেকে আসে ৯৪ রান।
এরপর ব্যাটিংয়ে নামা অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গকেও বেশিক্ষণ টিকতে দেয়নি রকিবুল হাসান। ব্যক্তিগত ৭ রানেই সাজঘরে ফিরেন তিনি। সিদ্বেশ ভিরকে নিয়ে জয়শোওয়াল আরও একটি ইনিংস গড়েন। ৩৯.৫ ওভারে দলীয় ১৫৬ রানের মাথায় শরিফুলের শিকার হয়ে সাজঘরে ফেরেন ওপেনিংয়ে নামা জয়শোওয়াল। আউট হওয়ার আগে তার ব্যাট থেকে আসে সর্বোচ্চ ৮৮ রান। জয়শোওয়াল আউট হওয়ার পরের বলে সিদ্বেশ ভিরকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে আউট করেন শরিফুল।
এরপর আর ভারতের হয়ে কোন ব্যাটসম্যানকেই দাঁড়াতে দেয়নি বাংলাদেশী বোলাররা। ফলে নির্ধারিত ওভারের আগেই ৪৭.২ বলে অলআউট হয় ভারত শিবির। বল হাতে অভিষেক দাস নেন তিনটি উইকেট। আর শরিফুল ও সাকিব নেন দুটি করে উইকেট।
বোলিংয়ে ছিল আগুন, ফিল্ডিংয়ে বারুদ। লক্ষ্যটা ছিল নাগালে। ব্যাটিংয়ে দারুণ শুরুর পর ছোট-খাটো এক ধসে ম্যাচ হাত থেকে ছুটতে বসেছিল। তবে ছিল খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। এই লড়াকু মানসিকতার সঙ্গে পেরে ওঠেনি ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দল। তাদের হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ।
পচেফস্ট্রুমে ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে ৩ উইকেটে জিতেছে বাংলাদেশ। ১৭৭ রান তাড়ায় বাংলাদেশের ইনিংসের ৪১তম ওভার শেষে বৃষ্টি নামে। সে সময় তাদের স্কোর ছিল ১৬৩/৭। আবার খেলা শুরু হলে নতুন লক্ষ্য পায় ৪৬ ওভারে ১৭০। সাত বলের মধ্যে ছুঁয়ে ফেলে লক্ষ্য।
জয়ের কাছে গিয়ে হারের স্মৃতি কম নেই বাংলাদেশের। সিনিয়র ক্রিকেটে একের পর এক ফাইনালে হার দেখেছে বাংলাদেশ। যুব ক্রিকেটেও হয়েছে তীরে এসে তরী ডোবার অভিজ্ঞতা। সবশেষ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেই বাংলাদেশ জয়ের দুয়ারে গিয়ে হেরেছে ভারতের কাছে।
এবার কোনো ভুল করেনি বাংলাদেশ। ঠাণ্ডা মাথায় দলকে বন্দরে নিয়ে গেছেন আকবর আলি। পেয়েছেন পারভেজ হোসেন ও রকিবুল হাসানের দারুণ সহায়তা।
টস হেরে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের আগুনে বোলিংয়ের সামনে পড়ে ভারত। শরিফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান শুরু করেন মেডেন দিয়ে। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের খেলান একের পর এক ডট বল।
দিনের শেষটা যেমন বাংলাদেশের, শুরুটাও তাদেরই। কন্ডিশনে পেসারদের জন্য সুবিধা বুঝতে পেরে একাদশে একটি পরিবর্তন আনে বাংলাদেশ। হাসান মুরাদের জায়গায় একাদশে ফেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডার অভিষেক দাস আক্রমণে এসেই দলকে এনে দেন ‘ব্রেক থ্রু’। পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন দিব্যানশ সাক্সেনা।
চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় শুরুর কঠিন সময়টা পার করে দেন জয়সাওয়াল ও তিলক ভার্মা। দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের ব্যাটে ধীরে ধীরে রানের গতি। তবে থিতু হওয়ার পরও তাদের ডানা মেলতে দেননি বাংলাদেশের বোলাররা। নিখুঁত লাইন লেংথে বল করে বারবরই ধরে রেখেছিলেন চাপটা।
দলের রান তিন অঙ্ক ছোঁয়ার পর ভাঙে ভারতের প্রতিরোধ। তানজিমের বলে সীমানায় ভার্মার চমৎকার ক্যাচ মুঠোয় জমার শরিফুল। ভাঙে ৯৪ রানের জুটি।
এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়েছে ভারত। দলটি সবশেষ ৯ উইকেট হারায় ৭৪ রানে; ২১ রানে শেষ সাতটি।
প্রিয়ম গার্গকে দ্রুত থামান রকিবুল হাসান। ভারতের শেষ ছয় ব্যাটসম্যানের কেউ যেতে পারেননি দুই অঙ্কে। শেষ আট ব্যাটসম্যানের মধ্যে দুই অঙ্কে যাওয়া একমাত্র ব্যাটসম্যান ধ্রুব জুরেল ফিরেন রান আউট হয়ে।
এক প্রান্ত আগলে রাখা জয়সাওয়ালের সঙ্গে শুরু থেকে জমে উঠেছিল শরিফুলের দ্বৈরথ। বাঁহাতি বোলারের দারুণ কিছু ডেলিভারি একটুর জন্য ভারতীয় ওপেনারের ব্যাটের কানা নেয়নি। শেষ হাসি হাসিন শরিফুলই। থামান জয়সাওয়ালের পথ চলা।
১২১ বলে ৮ চার ও এক ছক্কায় ১২১ রান করে ফিরেন জয়সাওয়াল। তার বিদায়ের পর বেশিদূর এগোয়নি ভারতের ইনিংস।
৪০ রানে ৩ উইকেট নেন অভিষেক। দারুণ বোলিংয়ে দুটি করে উইকেট নেন তানজিম ও শরিফুল।
তানজিম হাসান ও পারভেজের ব্যাটে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল দারুণ। বাজে বল কাজে লাগিয়ে দ্রুত রান তোলেন দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
বিষ্ণুইকে ছক্কা হাঁকানোর পর একই চেষ্টা করতে গিয়ে তানজিদের বিদায় দিয়ে শুরু বাংলাদেশের দিক হারানোর। লেগ স্পিনারের ছোবলে বিনা উইকেটে ৫০ থেকে ৬৫ পর্যন্ত যেতে চার উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ।
একের পর এক গুগলিতে মাহমুদুল হাসান, তৌহিদ হৃদয়কে ফিরিয়ে দেন বিষ্ণুই। স্টাম্পড হয়ে ফিরেন শাহাদাত। কেউ যেতে পারেননি দুই অঙ্কে। ক্র্যাম্পের জন্য দলীয় ৬২ রানে মাঠ ছাড়েন পারভেজ।
অধিনায়কের সঙ্গে জমে উঠছিল একটা জুটি। বাজে এক শটে শামীম হোসেন ফিরে গেলে বিপদ আরও বাড়ে বাংলাদেশের। এক ওভারে দুইবার জীবন পাওয়ার পর সেই ওভারেই ফিরেন অভিষেক।
১০২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশকে কক্ষপথে ফেরান পারভেজ ও আকবর। খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে অধিনায়ককে সঙ্গ দেওয়া পারভেজ খেলে দেন বিপজ্জনক বিষ্ণুইয়ের দুটি ওভার।
অনিয়িমিত লেগ স্পিনার জয়সাওয়ালের বলে পারভেজ ক্যাচ দিলে ভাঙে ৪১ রানের জুটি। ৭৯ বলে ৭ চারে ৪৭ রান করেন বাঁহাতি ওপেনার।
রকিবুলকে নিয়ে বাকি পথটুকু পাড়ি দেন আকবর। টুর্নামেন্টে এর আগে খুব একটা ব্যাটিংয়ের প্রয়োজন হয়নি অধিনায়কের। যখন প্রয়োজন হলো লড়াই করলেন বুক চিতিয়ে। হারের মুখ থেকে দলকে নিয়ে গেলেন বিজয়ের মঞ্চে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দল: ৪৭.২ ওভারে ১৭৭ (জয়সাওয়াল ৮৮, সাক্সেনা ২, ভার্মা ৩৮, গার্গ ৭, জুরেল ২২, বীর ০, আনকোলেকার ৩, বিষ্ণুই ২, সুশান্ত ৩, তিয়াগি ০, আকাশ ১*; শরিফুল ১০-১-৩১-২, তানজিম ৮.২-২-২৮-২, অভিষেক ৯-০-৪০-৩, শামীম ৬-০-৩৬-০, রকিবুল ১০-১-২৯-১, হৃদয় ৪-০-১২-০)
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল: (লক্ষ্য ৪৬ ওভারে ১৭০) ৪২.১ ওভারে ১৭০/৭ (পারভেজ ৪৭, তানজিদ ১৭, মাহমুদুল ৮, হৃদয় ০, শাহাদাত ১, আকবর ৪৩*, শামীম ৭, অভিষেক ৫, রকিবুল ৯*; কার্তিক ১০-২-৩৩-০, সুশান্ত ৭-০-২৫-২, আকাশ ৮-১-৩৩-০, বিষ্ণুই ১০-৩-৩০-৪, আনকোলেকার ৪.১-০-২২-০, জয়সওয়াল ৩-০-১৫-১)
ফল: ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ীম্যান
ম্যান অব ম্যাচঃ অধিনায়ক আকবর আলী ।