পাঁচ দিন গড়িয়ে ছুটির বিকালে লেখক-পাঠকের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠল অমর একুশে বইমেলা।
মেলার এই কয়েক দিনে বই বিক্রি তুলনামূলকভাবে কম হলেও শুক্রবার বদলে গেছে সে চিত্রও। পছন্দের গল্প, উপন্যাস, কবিতা বা প্রবন্ধের বই হাতে ঘরে ফিরেছেন অনেকেই।
প্রকাশকরা বলছেন, গেল পাঁচ দিনের চেয়ে শুক্রবার তাদের বিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ।
এদিন মেলার প্রথম ভাগ ছিল এবারের গ্রন্থমেলার প্রথম শিশুপ্রহর। সকাল ১১টায় মেলার দুয়ার খুলতেই দেখা যায় উপচেপড়া ভিড়। মধ্য দুপুরে সেই ভিড় তুলনামূলক কম থাকলেও বিকাল গড়াতে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ছিল না তিলধারণের ঠাঁই।
দুপুরে রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে সপরিবারে বইমেলায় এসেছিলেন রিয়াজ আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, “একটু বেলা করেই বইমেলায় এসেছি। এ সময়ে ভিড় একটু কম হবে আশা করে এসেছি। এতে নিজের পছন্দের বইগুলো একটু যাচাই-বাছাই করে কেনা যাবে।”
তার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে শারার মাশরাফি চৌধুরী বলেন, “আমি সাধারণত উপন্যাসই বেশি পড়ি। হুমায়ূন আহমেদের সবগুলো কিশোর উপন্যাস পড়া শেষ। এখন অন্যান্য লেখকদের উপন্যাসও আমাকে কিনতে হবে।”
বায়িং হাউজ কর্মকর্তা রমজান আকন্দ এসেছিলেন তার দুই ছেলে কনক আশরাফ ও রনক ইশরাককে নিয়ে।
তিনি বলেন, “ছেলেরা সিলেবাসের বাইরে এসে দুনিয়াকে জানুক, এটা সব সময় চাই। গল্প, উপন্যাসের মাধ্যমে ওরা দুনিয়ার অনেক অজানা তথ্যও জানতে পারে। নিজে যাচাই-বাছাই করে ওদের বই কিনে দিচ্ছি।”
উত্তরার হালিমা আফরোজও এসেছিলেন সপরিবারে। তার দুই মেয়ে জুঁই ও ইতি জানালেন, তারা গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি রাজনীতি ও সমকালীন বিশ্ব ভাবনার বই খুঁজছেন।
নতুন বই কী কী এসেছে, তা জানতে বইমেলায় এসেছেন দুই বন্ধু মাহবুবা তাবাবসুম ইমা ও প্রিয়াঙ্কা হালদার।
ইমা বলেন, “আজ শুধু নতুন বই কী কী এসেছে, তা জানতে এসেছি। আজ বইয়ের তালিকা করব। কাল পছন্দের বইগুলো কেনা শুরু করব।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেড-বিপিএলের স্টলে এসে প্রিয়াঙ্কা তুলে নেন অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’।
এদিন বইমেলায় এসেছিলেন অধ্যাপক বেগম আখতার কামাল। কথাপ্রকাশ থেকে বইমেলায় এসেছে তার লেখা ‘শতাব্দী সন্ধির কবিতা দিশা ও বিদিশা’। সত্তর ও আশির দশকের বাংলা কবিদের কবিতা নিয়ে বিশ্লেষণ রয়েছে এই বইটিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক আখতার কামাল বলেন, “প্রতি বছর আমি বইমেলায় ঠিক একটি বই প্রকাশ করি। যে কথা কেউ বলে না, আমি সে কথা বলতে চাই। আমার চিন্তার জগতের ভাষাও আলাদা।”
বইমেলায় প্রথমবারের মতো এসেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কবি নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, “আমি প্রথমবারের মতো এবার বইমেলায় এসেছি। এখানকার বইমেলার আবেদন অন্যরকম। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের বইয়ের প্রতি কী অসীম টান, তা এ বইমেলায় এলে জানা যায়।”
কবি ও প্রকাশক তারিক সুজাত বলেন, “এবারের বইমেলা যেন আজ প্রাণ পেল! পাঠকের পদভারে চারিদিক মুখরিত। ঠিক এমনটিই তো চাই আমরা।”
তার প্রকাশনা সংস্থা জার্নিম্যান বুকস থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কয়েকটি বই বের হচ্ছে। প্রবন্ধ, উপন্যাস আর কবিতাতেও থাকবে বৈচিত্র্য।
কবি মাজহার সরকার বলেন, “বইমেলায় এলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি এর ঐতিহাসিক জায়গা থেকে। বইমেলার পরিসর বেড়েছে, স্টলগুলো সুন্দর হয়েছে। কিন্তু বইমেলার মূল যে বিষয়, ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা ও মুক্তচিন্তা সেটাই হারিয়ে গেছে।সুতরাং বইমেলায় এলেও গোপন হাহাকার কাজ করে।”
ইউনিভার্সাল একাডেমির প্রকাশক শিহাব উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, “কবিতা, উপন্যাস নয় এবার সিরিয়াস বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ অনেক বেশি। আমরা মুজিববর্ষকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা বই প্রকাশ করেছি। পাঠক এবার সেসব বই খোঁজ করছেন। তরুণরা বিষয়ভিত্তিক বই খুঁজছে। বইয়ের আবেদন চিরন্তন। এ আবেদন কখনও হারিয়ে যাবে না।”
অন্বয় প্রকাশনীর প্রকাশক হুমায়ূন কবীর ঢালী বলেন, “সব ধরনের বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ বাড়ছে। এটা মেলার ইতিবাচক দিক। আজ বই বিক্রির হারও বেড়ে গেছে। বলা যেতে পারে, ১০ থেকে ১২ শতাংশ বই বিক্রি বেড়েছে। পনের তারিখের পর বইমেলায় বই বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়বে।”
শেষ বিকালে বইমেলায় আসেন লেখক-অধ্যাপক জাফর ইকবাল। তাকে পেয়ে ভক্তের দল ছেঁকে ধরে সেলফির আবদারে।
সেলফিতে খুব একটা আপত্তি না থাকলেও জাফর ইকবাল বলেন, মোবাইল ক্যামেরার চেয়ে পাঠকের হাতে বইয়ের সংখ্যা বেশি হলে তাতে বেশি আনন্দ হত তার।
“আমি লক্ষ করলাম, বইয়ের চেয়ে লোকজন ক্যামেরা নিয়ে আসছে, তারা সেলফি তুলতে চায়। একটা সময় ছিল যখন লোকজন বই নিয়ে আসত। তবে কিছু পাঠক বই নিয়ে আসছেন, তবে আরও বেশি হলে ভালো লাগত।”
জাফর ইকবাল মনে করেন, যারা বই পড়েন তাদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি।
“যারা বয়স্ক, তারা আজকাল বেশি বই পড়ে না।”
তরুণদের বইয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “বুক আর ফেইসবুকের ভেতরে কিন্তু আকাশপাতাল পার্থক্য। বুক একটা মানুষকে বিকশিত করে, আর ফেইসবুক মানুষকে নিমজ্জিত করে। ”
বাংলা একাডেমির তথ্য মতে, গ্রন্থমেলার ষষ্ঠ দিনে নতুন বই এসেছে ৩০৮টি।
যত আয়োজন
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে বইমেলা প্রাঙ্গণে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা সস্ত্রীক পরিদর্শন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার।
বইমেলা ‘প্রাণ পেল’ শিশুদের প্রহরে
বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সৈয়দ শামসুল হক রচিত বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা নিয়ে আলোচনা।
সেখানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন খায়রুল আলম সবুজ, আনিসুল হক এবং ওই গ্রন্থের ইংরেজি সংস্করণের প্রণেতা ফখরুল আলম।
সভাপতির বক্তব্যে এমরান কবির চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতা হঠাৎ করেই আবির্ভূত হন না। দীর্ঘ সময়ের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসাই বঙ্গবন্ধুকে মহান নেতায় পরিণত করেছিল। কালজয়ী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা এবং ফখরুল আলম কৃত ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে এদেশের শিশু-কিশোরেরা এই মহান নেতার জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে সম্যক অবগত হবে।”
কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি হাসান হাফিজ, কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, কবি নুরুন্নাহার শিরীন, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল, আলোক বসু ও কাজী বুশরা আহমেদ তিথি। নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যসংগঠন ‘বুলবুল একাডেমী অব ফাইন আর্টস’ (বাফা)-এর নৃত্যশিল্পীরা।
সংগীত পরিবেশন করেন আজগর আলীম, নারায়ণ চন্দ্র শীল, শান্তা সরকার ও আল মনসুর।
শুক্রবার ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কুমার চক্রবর্তী, তুষার আব্দুল্লাহ, কাজী রাফি ও জাহানারা পারভীন।