বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে বছরব্যাপী কর্মসূচি নেওয়াকে যারা বাঁকা চোখে দেখছেন তাদের একহাত নিয়েছেন লেখক-অধ্যাপক জাফর ইকবাল।
একাত্তরের এই শহীদ সন্তানের মতে, কারও কাছে এই আয়োজন যদি ‘বাড়াবাড়ি’ মনে হয়, তবে সেই ‘বাড়াবাড়ির’ বড় প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশে।
এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে পঁচাত্তরের পরে দুই দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম ‘মুছে ফেলার চেষ্টা হওয়ার’ কথা তুলে ধরে তার পুনরাবৃত্তি রোধে তরুণ প্রজন্মের মনে স্বাধীনতার স্থপতির অবস্থান দৃঢ় করার কথা বলেছেন তিনি।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার ঠিক আগে আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে সরকার জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে ২০২০-২০২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে। আগামী ১৭ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত চলবে মুজিববর্ষের কর্মকাণ্ড।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশপ্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ক্ষণগণনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুজিববর্ষে শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে রোববার বিকালে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবাল।তিনি বলেন, “আমরা এখন মুজিববর্ষ পালন করছি। বিভিন্ন মানুষজনের সাথে কথা বললে অনেক সময় হাল্কাভাবে বোঝা যায়, যেভাবে এই মুজিববর্ষ পালন করা হচ্ছে অনেকের কাছে যেন মনে হয়, সেটা অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে- এটা আমি টের পাই অনেকের কথা-বার্তা দেখলে।
“কিন্তু আমি মনে করি যে, এটার খুব প্রয়োজন ছিল। আমরা যেভাবে পালন করছি তার থেকে আরও বেশি করে পালন করতে হবে।”
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, “পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত টেলিভিশনে কোনো দিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয়নি। কাজেই বাংলাদেশের মাটিতে যদি এইটা হতে পারে। যে মানুষটা আমাদের জাতির পিতা, আমাদেরকে বাংলাদেশটা উপহার দিয়েছে, সেই মানুষটাকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে এবং মানুষ বঙ্গবন্ধুকে চিনতে পারে না। সেই দেশে এই ধরনের ঘটনার ভবিষ্যতে যেন কখনও পুনরাবৃত্তি ঘটতে না পারে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের।
“সেজন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যদি আমরা মুজিববর্ষ পালন করি এবং সেখানে যদি আমরা নানাভাবে আমাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি, নানাভাবে যদি বাড়াবাড়ি করি আমি মনে করি কোনো ত্রুটি হবে না, কোনো ভুল হবে না। আমাদের এটা করতেই হবে।”
নবীনদের ইতিহাস শোনান, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা
বক্তব্যে জাতীয় সংগীতের বিকৃতি নিয়ে খেদ প্রকাশ করেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল।
তিনি বলেন, “আমার সোনার বাংলা গানটি বঙ্গবন্ধুর খুব প্রিয় ছিল, যেটা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখন যখন গানটা শুনি তখন আতঙ্কে থাকি যে, গানের লিরিক ঠিকভাবে গাওয়া হবে কি না। প্রায়ই এই গানের পেছনে বা সামনে একটা বাড়তি জিনিস জুড়ে দেওয়া হয়।
“জাতীয় সংগীতের লিরিক ঠিকভাবে গাওয়া হবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা মুজিববর্ষে জাতীয় সঙ্গীত যাতে ঠিকভাবে গাওয়া হয় সেটা নিশ্চিতে কাজ করতে পারে।”
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই সংস্কৃতিকর্মীদের রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি বিপুল পরিসরে কাজের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “বক্তৃতার মাঠ, গণসঙ্গীতের আসর, নাটক, কবিতার মাধ্যমে মুক্তির বাণী প্রচার করে দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যটা তারা অনেকখানি দেখিয়ে দিয়েছেন, যেটা মুক্তিযুদ্ধে সত্যিকার অর্থে আমাদের শক্তি জুগিয়েছিল। মুজিব জন্মশতবর্ষে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মানুষের মাঝে সঞ্চারিত করার কাজটা এসব শিল্প-সাহিত্যের মানুষেরাই আবার করতে পারেন।”
দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে পারলেই ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপনের স্বার্থকতা আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। আলোচনায় অংশ নেন ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর সেক্যুলার বাংলাদেশ, ফিনল্যান্ডের আহ্বায়ক মুজিবুর দফতরি, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিজম, তুরস্কের সাধারণ সম্পাদক শাকিল রেজা ইফতি।
স্মারক বক্তৃতা রাখেন নাট্য নির্দেশক ও গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ। সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী।