ভয়াল পঁচিশে মার্চের কালরাত আজ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগমুহূর্তে ১৯৭১ সালের এই কালরাতেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ এদেশের বড় শহরগুলোতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কমপক্ষে ৫০ হাজার ঘুমন্ত বাঙালিকে হত্যা করে।
বিশ্ব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ও তমসাচ্ছন্ন এক অধ্যায় ২৫ মার্চের মর্মন্তুদ গণহত্যার দিনটি মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পর ২০১৭ সাল থেকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সেইসঙ্গে দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবেও ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবিও অব্যাহত রয়েছে।
তবে এবার দিবসটি পালিত হচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ায় এবার কোনো কর্মসূচিই থাকছে না দিনটিকে ঘিরে। করোনা সংকটের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কার্যত অচলাবস্থা চলছে। সব ধরনের সভা-সমাবেশ, জনসমাগমসহ পরিবহন চলাচল, মার্কেট ও বিপণিবিতান বন্ধ হয়ে গেছে। ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশের সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। দেশের সিংহভাগ মানুষও নিজ নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে সংকট মোকাবিলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর পরও দেশের মানুষ আজ নীরবে স্মরণ করবেন, শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাবেন ২৫ মার্চের গণহত্যার শিকার অগণিত শহীদকে।
পঁচিশ মার্চের ভয়াল রাতে গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মেতে উঠেছিল বাঙালি নিধনযজ্ঞে। অন্যদিকে এই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে অসম সাহসী বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। জাতির অস্তিত্ব রক্ষার এ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ দিনভর অশান্ত-উদ্বেল পরিস্থিতি ছিল দেশজুড়ে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত অবধি মিছিল-মিটিং-স্লোগানে মুখরিত রাজধানী ঢাকাবাসীর প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েন এক সময়। গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঘুমাতে যাওয়ার। কিন্তু নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষগুলোর কেউই ঘুণাক্ষরে জানতে পারেননি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রথম রাস্তায় নেমে আসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পরে একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমন্ডি ও পিলখানা পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদর দপ্তরসহ রাজধানীর সর্বত্র আক্রমণ চালিয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাশাপাশি নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও।
তবে রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তবে শত্রুর ট্যাঙ্ক আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশ সদর দপ্তর। পরে পাকিস্তানি সেনাদের ভারী ট্যাঙ্ক ও সৈন্যবোঝাই লরিগুলো নল উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। একে একে জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ও রোকেয়া হলসহ সব হলেই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ৯ শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীসহ তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করে।
এর পাশাপাশি নগরজুড়ে রাতভর চলেছে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংসের তাণ্ডব। দানবীয় বাহিনীর আক্রমণের বিভীষিকায় নিমজ্জিত হয় নগরীর রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাত, খেলার মাঠ ও ক্যাম্পাস। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। মর্মন্তুদ সে কান্না ছাপিয়ে চারপাশে তখন কেবলই আগুনের লেলিহান শিখা ও ধ্বংসযজ্ঞ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়েছে লাশের স্তূপ। একসময় গোটা নগরীই পরিণত হয় লাশের শহরে। স্তম্ভিত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ।
অবশ্য এ পরিস্থিতিতেও রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাঙালি ছাত্র-জনতা। ঢাকার ফার্মগেট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার চারপাশ এবং চট্টগ্রামেও এ প্রতিরোধ ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতার মুখে সেদিন কিছুই করতে পারেননি অকুতোভয় বাঙালি।
পঁচিশে মার্চ শুরু হওয়া এ বাঙালি নিধনযজ্ঞ চলেছে পরের টানা ৯ মাস ধরে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে গোটা বাংলাদেশই হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। নৃশংস ও বর্বরোচিত এ হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতক দালাল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।