অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি বিন মুর্তজার শেষ সংবাদ সম্মেলনের প্রথম কথা, ‘ভালো লাগছে…।’ মুখে হাসিতেও যেন সেই ভালো লাগার প্রকাশ। ভারমুক্তির স্বস্তি। চাপ মুক্তির অনুভূতি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সাড়ে ৫ বছর অধিনায়কত্ব করা মানে দীর্ঘ এক যুদ্ধ। শরীর আর মনের নিত্য ধকল। অবশেষে সেই লড়াইয়ে ক্ষান্তি। এবার নির্ভার হয়ে কিছুদিন খেলে যাওয়ার পালা। সেখানে চ্যালেঞ্জ আছে বটে। তবে বন্ধুর পথচলাতেই মাশরাফি খুঁজে নিচ্ছেন আনন্দ।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডে দিয়ে শেষ হয়ে গেছে মাশরাফির নেতৃত্বের অধ্যায়। এবার স্রেফ ক্রিকেটার হিসেবে দলে জায়গা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ।
তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এখন নিশ্চিতভাবেই গোধূলিবেলা। তবে ডুবে যাওয়ার আগে এই সময়টুকুই তিনি করতে চান দীর্ঘায়িত। শেষবেলায়ও তেজোদীপ্ত বিকিরণে আলোকিত করতে চান দেশের ক্রিকেট।
এমন নয়, কাজটি অসম্ভব। এমন নয়, এতদিন তিনি স্রেফ অধিনায়ক বলেই খেলেছেন। বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে বোলার তো বটেই, এই দফায় অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর দলের দ্বিতীয় সফলতম বোলারও তিনিই। ওয়ানডে ইতিহাসের মাত্র ৫ ক্রিকেটারের একজন, অধিনায়ক হিসেবে যিনি পেয়েছেন ১০০ উইকেটের স্বাদ।
অধিনায়ক হিসেবে যে ১০২টি উইকেট নিয়েছেন, এর ৭২টিই দলের জয়ের ম্যাচে। দলে বোলার মাশরাফির অবদানও স্পষ্ট পরিসংখ্যানের এই ছবিতে।
বোলার মাশরাফিকে নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না খুব একটা। গতির সীমাবদ্ধতা পুষিয়ে দিয়েছেন দারুণ সব কাটার, ছোট ছোট সুইং, সিমে হিট করা, আঁটসাঁট লাইন-লেংথ, গতি বৈচিত্র, ব্যাটসম্যানকে পড়তে পারার ক্ষমতা আর বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং দিয়ে। নিন্দুকেরা অধিনায়কত্ব কোটার অযাচিত গীত গেয়েছেন বটে। এমনকি বোর্ড সভাপতিও বেশ কয়েকবার নেতা মাশরাফির বিশালত্ব বোঝাতে গিয়ে ছুঁতে পারেননি বোলার মাশরাফির গভীরতা। কিন্তু দিনের পর দিন সাদা কুকাবুরা হাতে ২২ গজে ঝলক দেখিয়েই তিনি প্রমাণ করেছেন বোলার হিসেবে নিজের অপরিহার্যতা।
তবে সামনের পথচলা নিশ্চিতভাবেই হবে আগের তুলনায় অনেক কঠিন। সেটি গত এক বছরের প্রেক্ষাপটের কারণে। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কারণে। গত বিশ্বকাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ত্রিদেশীয় সিরিজেও মাশরাফি বল হাতে ছিলেন বেশ সফল। কিন্তু ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে টান লাগে হ্যামস্ট্রিংয়ে, তাতেই ভাটার টান আসে পারফরম্যান্সে। গোটা বিশ্বকাপে ধুঁকেছেন সেই চোটে, বোলিং ছিল তাই ধারহীন। স্বয়ং তার নিজের ভাষায় নিজের পারফরম্যান্স ছিল ‘বাজে, একদমই বাজে।”
বিশ্বকাপের পরপর শ্রীলঙ্কা সফরে তাকে যেতে দেয়নি চোট। সেই চোট থেকে পুরোপুরি মুক্তি মেলেনি গত বিপিএলেও। পারফরম্যান্স ছিল তাই সাদামাটা।
পর্যাপ্ত বিশ্রামের পর অবশ্য জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে মুক্তি মিলেছে সেই চোট থেকে। সেটির প্রতিফলন পড়েছে বোলিংয়েও। নিজের সেরা চেহারায় ফিরতে পারেননি বটে। তবে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত মিলেছে। তিন ম্যাচে চারটি উইকেট নিয়েছেন। জড়তা সময়ের সঙ্গে কেটেছে অনেকটা। দ্বিতীয় ম্যাচে অন্য দুই পেসারের খরুচে বোলিংয়ের পাশে তিনি ছিলেন যথেষ্টই নিয়ন্ত্রিত। শেষ ম্যাচে নতুন বলে সুইংও আদায় করেছেন। প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশ পরে বোলিং করেছে, যখন উইকেট ব্যাটসম্যানের জন্য হয়ে উঠেছে স্বর্গ, শিশির ভেজা বোলারদের কাজ ছিল কঠিন। সব বিবেচনায় এই সিরিজের বোলিং খারাপ ছিল না। বরং আত্মবিশ্বাস পাবেন সামনের লড়াইয়ের জন্য।
তারপরও এই লড়াই হবে ভীষণ কঠিন। যে দেশে ক্রিকেট প্রশাসকরা মাঠের ক্রিকেট নিয়েই বেশি ব্যতিব্যস্ত, বোর্ড প্রধানের মতো ব্যক্তিত্ব এখানে একাদশ ও স্কোয়াড নির্বাচনের কথা সরাসরি বলে দেন ভরা মজলিসে, সেখানে মাশরাফি হোক বা যে কোনো ক্রিকেটার, বোর্ড কর্তাদের ইচ্ছের ওপর অনেকটা নির্ভর করে ক্রিকেটারদের ভাগ্য।
টিম ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারও আছে। প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো, বোলিং কোচ ওটিস গিবসন এখনও নতুন। মাশরাফিকে তারা গভীরভাবে দেখেছেন কমই। তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ আছে। আরও বড় চ্যালেঞ্জ, দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নিজের জায়গা খুঁজে নেওয়া।
২০২৩ বিশ্বকাপ মাশরাফি নিশ্চিতভাবেই খেলবেন না। প্রায় তিন বছর পরের বিশ্বকাপের জন্য এখনই উঠে-পড়ে লাগা বা দলের খোলনলচে পাল্টে ফেলা হয়তো জরুরি নয়। তবে কোচিং স্টাফ, টিম ম্যানেজমেন্টের ভাবনায় তিন বছর পরের একটি সম্ভাব্য ছবি থাকবেই। মাশরাফি তাই যতদিনই খেলুন, হয়তো প্রায় প্রতিদিন, প্রতি ম্যাচেই নিজেকে প্রাসঙ্গিক প্রমাণ করে যাওয়ার দায় তার থাকবে। পাশপাশি, ফিটনেসের ব্যাপার তো আছেই। সেখানে কোনো ঘাটতি কিংবা আরেকটা চোট, তার পথচলা থমকে দিতে পারে সেখানেই। তাই পারফরম্যান্স ও ফিটনেস নিয়ে নিত্য আতশ কাঁচের নিচে থাকার আঁচ নিয়েই ক্যারিয়ারের বাকিটায় তাকে এগিয়ে যেতে হবে।
মাশরাফি অবশ্য সব বাস্তবতাকেই আলিঙ্গন করছেন। ক্যারিয়ার জুড়ে অসংখ্য প্রতিকূলতা ঠেলে এগিয়ে গেছেন যিনি, ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন বারবার, হয়ে উঠেছেন সংশপ্তক, নিজের মনের খোরাক জোগাতে আরেকবার চ্যালেঞ্জ নিতে কেন তিনি পিছপা হবেন!
হ্যাঁ, মনের দাবি মেটানোই। গত বিপিএল থেকে এই সিরিজ পর্যন্ত বেশ কবারই বলেছেন, এখন তিনি স্রেফ খেলে যেতে চান মনের আনন্দে। বাংলাদেশ দলে সুযোগ মিললে খেলবেন। সুযোগ না মিললে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলবেন। উপভোগ করবেন। মনের আনন্দে ডানা মেলে বেড়াবেন ক্রিকেটাকাশে।
কেন অবসর নিচ্ছেন না, কেন খেলা চালিয়ে যেতেই হবে, এই প্রশ্ন তোলার লোকের অভাব সামনেও হবে না। তবে প্রশ্নের সুতোগুলো কেটে দিয়ে তিনি মুক্ত ঘুড়ি হয়েই উড়তে চেয়েছেন। বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এবার নেতৃত্বও ছাড়লেন। বিতর্ক তোলার মতো বন্ধন নেই, এখন নিশ্চয়ই নিজের মতো করে খেলে যাওয়ার অধিকার বা স্বাধীনতা তার আছে!
নেতৃত্বের প্রায় সাড়ে ৫ বছরে ভাঙাচোরা একটি দলকে পরিবার করে তুলতে হয়েছে, পরিবারের প্রধান কর্তার মতোই দলের সদস্যদের ক্রিকেটের পাশাপাশি ব্যক্তিগত-পারিবারিক অসংখ্য ঝামেলা সামলাতে হয়েছে, বোর্ড কর্তা, সংবাদমাধ্যম, চারপাশের রঙিন দুনিয়া, এমন অনেক ঝড়-ঝাপ্টায় বুক দিয়ে আগলে রাখতে হয়েছে দলকে। অনেক সময় আপোস করতে হয়েছে নিজের সঙ্গে, অনেক সময় ছাড়াতে হয়েছে নিজের সীমানা। এসব করতে গিয়ে নিজের জীবনেও ব্যাঘাত ঘটেছে অনেক। টেনশন-চাপ মিলিয়ে বড্ড মনের পীড়ন গেছে। এবার মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে মনকে প্রশান্তির পরশ দেওয়ার পালা। চ্যালেঞ্জ যেটুকু আছে, মাশরাফির ক্যারিয়ারই বলে দিচ্ছে, এসবে তিনি হার মানার লোক নন। তবে এখন সবকিছু তার হাতেও নেই। বোলিং আর ফিটনেসে তার ঠিকঠাক থাকলেও বোর্ড বা টিম ম্যানেজমেন্টের ভিন্ন ভাবনা থাকতেই পারে।
তবে নেতৃত্বের শেষ ম্যাচে ক্যারিয়ার শেষের ভাবনা নিয়ে মাশরাফি বলেই দিয়েছেন, “বিদায় তো বিদায়ই, ঘরে বসে হোক আর মাঠে থেকে!” সবকিছুতেই স্পষ্ট, এসব ভাবনায় তিনি আর কাতর নন। শেষ বেলার এই মাশরাফি, কেবলই আনন্দ রথের যাত্রী!