ঝুঁকির মুখে ১৬০ কোটি মানুষের জীবিকা: আইএলও

coronavirus-lockdown-poor-310320-10

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে লকডাউনের কারণে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় বিশ্বে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ১৬০ কোটি শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও।

বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আইএলও জানিয়েছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এই কর্মীসংখ্যা বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক।

চলতি বছরের শুরুতে নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর শ্রমবাজারের ওপর এর প্রভাব নিয়ে গত মার্চে সমীক্ষা শুরু করে আইএলও। তারপর এপ্রিলের শুরুতে একটি এবং এপ্রিলের শেষে এসে তৃতীয় প্রতিবেদনটি তারা প্রকাশ করেছে, যেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

‘আইএলও মনিটর থার্ড এডিশন: কভিড-১৯ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক’ শিরোনামে এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে (এপ্রিল থেকে) যে হারে কর্মঘণ্টা কমে যাচ্ছে তা আগের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি আশঙ্কাজনক।

২০১৯ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) যখন এ সঙ্কটের শুরু হয়নি, সেই সময়ের তুলনায় এখন বিশ্বজুড়ে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা ১০ দশমিক ৫ শতাংশ কমে গেছে, যা প্রায় ৩০ কোটি পূর্ণকালীন চাকরির সমান (একটি ফুলটাইম চাকরিতে সপ্তাহে ৪৮ কর্মঘণ্টা ধরা হয়)।

আইএলও বলছে, এই সঙ্কটে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা ৬ দশমিক ৭ শতাংশ কমতে পারে, যা প্রায় ১৯ কোটি পূর্ণকালীন চাকরির সমান। কিন্তু দেশে দেশে লকডাউন দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে ক্ষতি হচ্ছে ধারণার চেয়ে অনেক বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন অঞ্চলভেদে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আইএলওর পূর্বাভাস বলছে, ২০২০ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দুই আমেরিকায় কর্মঘণ্টা হিসেবে শ্রমিকের কাজের সুযোগ সঙ্কট শুরুর আগের সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৪ শতাংশ কমে যেতে পারে। একইভাবে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে সাড়ে ৯ শতাংশ কমতে পারে।

আক্রান্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি

বিশ্বে বর্তমানে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৩৩০ কোটি। এর মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত আছে দুইশ কোটি মানুষ, যারা দৈনিক মজুরি বা কর্মঘণ্টার ভিত্তিতে বিভিন্ন কাজ করেন।

বাংলাদেশে কৃষি, মৎস্য চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ, নির্মাণ কাজ, হকার, চাতাল, সেলাই কাজ, ওয়েল্ডিং, তাঁত, বিড়ি কারখানা, প্রিন্টিং, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, গৃহস্থালি কর্ম, ক্ষুদ্র কারখানা প্রভৃতি খাতকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে গণ্য করা হয়।

আইএলও বলছে, মহামারীর কারণে সৃষ্টি অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রায় ১৬০ কোটি কর্মীর জীবিকা অর্জনের সুযোগ বা সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বা কমে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবীর মোট কর্মজীবী মানুষের অর্ধেকই কভিড-১৯ এর অভিঘাতের শিকার হচ্ছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারিতে সঙ্কট শুরুর প্রথম মাসে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের আয় ৬০ শতাংশ কমে গেছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আফ্রিকা ও আমেরিকায় কমেছে ৮১ শতাংশ, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২১ শাতাংশ এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ৭০ শতাংশ।

বাংলাদেশে আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টোমো পুটিয়ানেন বলেন, “নারী, নবীন, বৃদ্ধ (যাদের বয়স ৫৫ বছরের বেশি), অভিবাসী এবং যারা আত্মকর্মসংস্থানে রয়েছেন, তাদের জীবিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কভিড-১৯ এর প্রভাবে। নবীন ও তরুণরা ইতোমধ্যে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।”

পোশাক খাতের চিত্র

প্রায় চার হাজার কারখানা নিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগের যোগান দিচ্ছে। এ খাতে সরাসরি কাজ করছে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাদের অর্ধেকের বেশি নারী।

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী ধরা পড়ার পর থেকে বেতন ভাতা, চাকরিচ্যুতি ও কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকি নিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এ খাত। অনেক পোশাক কারখানা এখনও মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ করতে পারেনি। লে-অফ ও ছাঁটাইয়ের খবরও এসেছে কয়েকটি কারখানা থেকে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আকতার বলেন, “এই পরিস্থিতিতে এখনই ৯০ শতাংশ পোশাক কারখানায় লে অফ হয়ে গেছে। বিজিএমইএ হয়ত ৭০ শতাংশ কারখানায় লে অফ হয়েছে বলতে চাইবে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।

“অনেকে আবার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর পেছনের তারিখে লে অফ ঘোষণা করছে। ১৪ হাজার শ্রমিককে ছাঁটাইয়ের তথ্য আমাদের কাছে আছে। এর বাইরেও অনেকে ছাঁটাই হয়েছে। সব মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।”

ব্যবসার ভরা মৌসুমে প্রাণঘাতি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে লকডাউন ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশীয় পোশাকখাতও।

দেশীয় পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘ফ্যাশন উদ্যোগের’ সহ সভাপতি সৌমিক দাস বলেন, প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের এই খাতে গত বৈশাখ ও চলতি ঈদের মওসুমে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অবরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। পোশাক বিক্রি থেমে যাওয়ায় এ খাতের শ্রমিকদের বেতনভাতা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে মালিকদের পক্ষে।

আইএলও বলছে, করোনাভাইরাস সঙ্কটে বিশ্বব্যাপী ৪৩ কোটি ৬০ লাখ ব্যবসায়িক উদ্যোগ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ কোটি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীক উদ্যোগ রয়েছে। চার কোটি রিয়েল এস্টেট ও অন্যান্য ব্যবসাও রয়েছে এর মধ্যে।

এই পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকদের সুরক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে বলছে আইএলও।

তাদের পরামর্শ, এই প্রণোদনা হতে হবে খাতভিত্তিক এবং ঋণ হতে হবে সহজ শর্তের। ঋণ সঙ্কট দূর করার পাশাপাশি থোক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

পুটিয়ানেন বলেন, “ব্যবসা, কর্মসংস্থান ও শ্রমিকদের সুরক্ষায় সঠিক উদ্যোগ নিতে পারলেই কেবল আমাদের অর্থনীতি ও সমাজ কভিড-১৯ এর ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।“

Pin It