প্রায় শত শত বছর ধরে চর্চা করে আসা এই দেশের মুসলিমরা রোযার রাখার পূর্বে তারাবি নামাজ পড়তে অভ্যস্ত। কিন্তু সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্বেই মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ রয়েছে। শুধু নিজেকে রক্ষা নয়, সেই সঙ্গে নিজের পাশে থাকা মুসলিম ভাইকে রক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। আগামী শুক্রবার থেকে সৌদি আরবে শুরু হবে মুসলিমদের জন্য সবচাইতে পবিত্র মাস রমযান। আর এই মাসকে ঘিরে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে মসজিদে নামাজ পড়ার বিষয়ে।
রমজানকে সামনে রেখে সর্ব প্রথম সৌদি আরব মসজিদে তারাবি নামাজ না পড়ানোর ঘোষণা দেয়। এরপর একে একে মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশ থেকেই আসে এই ঘোষণা। সেই সঙ্গে ইতেকাফও বন্ধ ঘোষণা করে দেশগুলো। বাংলাদেশও মসজিদে তারাবির নামাজ আয়োজন না করার ঘোষণা দেয়, সেই সঙ্গে ইতেকাফ না করার পরামর্শও দেয়া হয়। কিন্তু মসজিদে তারাবির নামাজ না হলে খতম তারাবি কিভাবে হবে? জামাতে তারাবির নামাজ পড়ার নেকি কিভাবে অর্জন হবে? যারা তারাবির নামাজের মাসলা মসায়েল না জানে তারা কিভাবে নিজেদের পরিশুদ্ধ করবে? এমন অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই সঙ্গে বেশ কিছু মসজিদ-মাদ্রাসা ও ওয়াজের বক্তারা তারাবির নামাজ মসজিদে না পড়ার বিরোধিতা করছে। কিন্তু ইসলাম কি বলছে তারাবির নামাজ প্রসঙ্গে?
তারাবি না পড়লে রোজা হবে না এমন কোন হাদিস নেই। মসজিদের ইমাম এক বুজুর্গ বলেন, তারাবির ইতিহাস মূলত পাওয়া যায় হযরত উমর (রা.) সময় থেকে। এর আগে রসূল করীম (সা.) মাত্র একবার তারাবির নামাজ পড়িয়েছিলেন। হাদিসে আছে প্রথম দিন তারাবির নামাজ পড়ার পর দ্বিতীয় দিন সকলে নামাজের জন্য সমবেত হলেও তিনি রসূল করিম (সা.) মসজিদে আসেননি। কিন্তু হযরত উমর (রা.)-এর সময় নিয়ম করে সমবেতভাবে তারাবির নামাজ শুরু হয়। মূলত যারা দুর্বল ইমানের অধিকারী, তারা যেন রমজান মাসে তারাবির নেকি থেকে বঞ্চিত না হন সে কারণে এই ব্যবস্থা।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে তারারির নামাজ কখনো জামাআত পড়েছেন। আবার কখনো এমন হয়েছে যে, কয়েক রাকাআত জামাতের সাথে পড়ে হুজরায় চলে গেছেন আবার কখনো একাকী নামাজ পড়েছেন। এ বিষয়ে জায়েদ বিন তাবিদ (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, রসুল করিম (সা.) প্রথম রাতে মসজিদে নামাজ আদায় করেন। এ কথা প্রচার হলে দ্বিতীয় দিন আরো লোক সমাগম হয় মসজিদে এবং তারা রসুল করিমা (সা.) এর পেছনে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। তৃতীয় দিন আরো বেশি লোক সমাগত হয় এবং রসূল করিম (সা.) জামায়াতে নামাজ আদায় করেন। চতুর্থদিন মসজিদে যখন তিল পরিমাণ ঠাই নেই এবং সকলে অপেক্ষা করছিলো কখন রসুল করিম (সা.) এসে নামাজ পড়াবেন। কিন্তু সেদিন রসুল করিম (সা.) মসজিদে আসলেন না। তখন বেশ কয়েকজন রসূল করিম (সা.)-এর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলে তিনি বলেন, আমি নিয়মিত এখানে সালাত আদায় করলে তা আমার উম্মতের জন্য ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক) হয়ে যাবে। (বুখারী শরীফ, হাদিস-১১২৯)।
বুখারী শরীফের অপর এক হাদিসে রসুল করিম (সা.) এর অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, মানুষকে নিজেদের ঘরে নামাজ আদায়ে উৎসাহিত করেন তিনি। সেখানে বলা হয়, বাধ্যতামূলক ইবাদত ছাড়া ঘরে বসে যে ইবাদত করা হয় তা নিশ্চয়ই উৎকৃষ্ট।
নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত তারাবির জামাআত পড়াননি, বরং অধিকাংশ সময় তিনি একাকী তারাবির নামাজ পড়তেন। তিনি নিজে কেন জামাতের নিয়ম করেননি তা উম্মতকে বলে গেছেন, জামাআতের সাথে নিয়মিত (তারাবীর) নামাজ পরলে এ নামাজটিও উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। তাই তিনি এর জামাআত নিয়মিত চালু করেননি।
তারাবির নামাজ বিশ রাকাআতের প্রচলন শুরু হয় হজরত উমর (রা.) সময় থেকে। ১৪ হিজরি রমজানের কোন এক রাতে হজরত উমর (রা.) মসজিদে তাশরীফ নিয়ে যান এবং সেখানে দেখতে পান যে, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামাআত হচ্ছে। তিনি চিন্তা করলেন সকল নামাজিকে এক ইমামের পেছনে একত্র করে দেওয়া উচিত। তখন তিনি এই আদেশ জারি করেন এবং উবাই ইবনে কা’ব (রা.) কে ইমাম বানিয়ে দেন। (বুখারী শরীফ, হাদিস-২০১০)
রমযান মাসে রোজাদারদের তাহাজ্জত নামাজের বিকল্প হিসেবে তারাবি নামাজ পড়া হয় বলেও মত দেন অনেক আলেম। একজন আলেম জানান, তারাবির নামাজ না আদায় করলে রোজা হবে না এমন কোন নিয়ম হাদিসে পাওয়া যায়নি। বরং এ ধরণের ইবাদত যত একাগ্র মনে করা যায় তত ভালো। আর যেই ব্যক্তি তারাবির নামাজের মাসলা মসায়েল জানেন না, এটা সবচাইতে উত্তম সময় তা শিখে নেয়ার। ঘরে বসে থেকে নিজে তারাবির নিয়মগুলো শিখে নিন এবং পরিবারসহ তারাবির নামাজ আদায় করুন ঘরে।
এ সময় তিনি আরো বলেন, ইসলাম এমন ধর্ম যেখানে নিজের ওপর জুলুম করে কোন কিছু করার প্রয়োজন নেই। আর সে কারণেই ফরজ নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে, প্রয়োজনে মানুষ ইশারায় সালাত আদায় করতে পারবে। সেখানে এই মহামারীর সময় মসজিদে না এসে ব্যক্তিগতভাবে তারাবি আদায়ে আল্লাহ তাআলা কখনো অসন্তুষ্ট হতে পারেন না। হৃদয়ে ঈমান মজবুত থাকলে, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা থাকলে সমগ্র পৃথিবীটাই একজন ইমানদার ব্যক্তির জন্য মসজিদ।
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি: তোমরা তোমাদের ঘরকে কবরস্থান বানিও না। [মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) হাদিস নম্বর: ৯২৬]
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আলেমরা জানান, তোমরা তোমাদের ঘরকে কবরস্থানে পরিণত করো না। অর্থাৎ- তোমরা ঘরকে কবরের মতো করে ফেলো না যেখানে কোন ‘ইবাদাত করা যায় না। এমনকি সালাতও আদায় করা যায় না। বরং ঘরেও তোমরা সলাত আদায় কর এবং ‘ইবাদাতের একটি অংশ তাতে আদায় কর। এও বলা হয়ে থাকে যে, হাদীসের এ অংশ দ্বারা ঘরে সলাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় ও ‘ইবাদাত করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে টিভিতে ইমামের আওয়াজ শুনে নামাজ পড়ারও বিরোধিতা করেন অনেক আলেম। তারা জানান, যখন আপনাদের নিজেদের মধ্য থেকে ইমামতি করার সুযোগ আছে, তখন এভাবে নামাজ পড়ার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই মনে করি।