ঝরে যাওয়া নক্ষত্র

image-147983-1588070472
জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যু আমাদের শোকাহত করেছে। তার মৃত্যুতে দেশে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একাধারে প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক। অন্তত অর্ধযুগ ধরে সরাসরি তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, তিনি কতটা কর্মচঞ্চল, অমায়িক ও সজ্জন মানুষ ছিলেন। কর্মব্যস্ত জীবনে সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তিনি জাতীয়,আন্তর্জাতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়নে তিনি অনস্বীকার্য অবদান রাখেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতেও প্রথম থেকেই তিনি কাজ করেন। ২০২১ সালে তার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং কনটেস্ট হওয়ার কথা ছিল। দেশের প্রায় সব বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। পদ্মাসেতু, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান প্রায় সব মেগা প্রজেক্টের কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।
শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে পুরকৌশল বিভাগে তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। দেশে-বিদেশে রয়েছে তার হাজার শিক্ষার্থী। ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় জামাল স্যার। বুয়েটে অধ্যাপনার পর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগ দিন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কে শীর্ষস্থানে নিয়ে যেতে তার যেমন অবদান রয়েছে, তেমনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিককে সম্মুখ সারিতে নিয়ে যেতে তার ভূমিকা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের এ সময়েও গত রোববার দেড় ঘণ্টা ধরে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তিনি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেন। কথা বলেন বাংলাদেশের শিক্ষা ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
আমরা তার কাজ নিয়ে বিস্মিত হই, তিনি কীভাবে সব কিছু সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো তিনি একটা মিটিং সেরেছেন, এর পরই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য হয়তো পদ্মাসেতুর প্রতিনিধি দল অপেক্ষা করছে, এরপর অন্য কারও সঙ্গে। এভাবে তিনি কর্মচঞ্চল জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন তীক্ষষ্টমেধাসম্পন্ন। তার স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। জটিল গাণিতিক সমস্যা সহজেই মুখে মুখে তিনি সমাধান দিতে পারতেন। পেশাজীবনের বাইরে পরিবারকে যেমন সময় দিয়েছেন তেমনি বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজেও তিনি ছিলেন অগ্রগামী। নানা সংগঠনের সঙ্গেও তিনি নিবড়ভাবে কাজ করেছেন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্ব পর্যায়ে যেমন দায়িত্ব পালন করেছেন তেমনি পরিবেশ সংগঠন বাপা, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি সংগীতের অত্যন্ত গুণগ্রাহী ছিলেন। এমন পেশাজীবীর ক্ষেত্রে যেটা দেখা বিরল; এমনকি খেলাধুলার প্রতিও তার অনুরাগ ছিল। ক্রিকেট, ফুটবল, টেবিল টেনিসসহ অন্যান্য খেলায় তিনি উৎসাহিত করতেন।
জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৩ সালে জন্ম নেওয়া এই জাতীয় অধ্যাপক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় একুশে পদক যেমন তিনি পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক। একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে তিনি ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি।
এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর আকস্মাৎ মৃত্যুতে আমরা আমাদের অভিভাবক হারিয়েছে, দেশ হারিয়েছে একজন দেশপ্রেমিক নীতি নির্দেশককে। এ মানুষটির চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। আসলে যখন এমন কোনো গুণী ব্যক্তিত্ব চলে যান, তার শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আর তিনি এমন সময়ে চলে গেলেন, যখন করোনার প্রভাবে দেশের উন্নয়নমূলক মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ হয়ে আছে। যখন আমাদের শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা থমকে আছে। এ দুর্যোগের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যখন আমরা সর্বত্র এক বিশাল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, এ সময় মানুষটি নিশ্চয়ই যথাযথ পরামর্শ আমাদের দিতে পারতেন। ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারতেন।
জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রয়াণে দেশ ও জাতি শোকাহত। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী

অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর; ট্রেজারার,

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক ।

Pin It