‘আব্বু, আমাকে বাঁচাও, আমাকে মেরে ফেলবে।’ এটা ছিল বাঁচার জন্য সুজন মৃধার শেষ আকুতি। এ মাসের ১৬ তারিখে পরিবারের কাছে পাঠানো একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে এমন আকুতি জানায় গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বামনডাঙ্গা গ্রামের এই তরুণ। সুজন বাঁচতে পারেনি। বাঁচতে পারেনি তার সঙ্গের আরও ২৫ জন। গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার মিজদাহ শহরে একটি মানব পাচারকারী চক্রের হাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন বাংলাদেশি এই ২৬ জন। আহত হন ১১ জন। ওই ঘটনায় আফ্রিকা অঞ্চলের আরও চারজন নিহত হন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির পথে স্বপ্নযাত্রা পরিণত হয় রোমহর্ষক শবযাত্রায়।
সুজনের বাবা কাবুল মৃধা বলেন, ‘ছেলের অডিও শোনার কিছুক্ষণ পর দালালচক্র মোবাইলে ফোন দিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তাদের বলেছিলাম আমার বাজানের কোনো ক্ষতি করো না। জুনের ১-২ তারিখে টাকা দিয়ে দেব। তার আগেই বাজানকে মেরে আমার বুকটা খালি করে দিল। বাজান আমাকে কামাই করে খাওয়াতে চাইছিল। তার কামাই আমরা খাতি পারলাম না।’
কাবুল মৃধা বলেন, আমাদের পাশের গ্রামের রব মোড়লের মাধ্যমে চার লাখ টাকায় লিবিয়ায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। পরে রব মোড়ল মাদারীপুরের রাজৈর থানার শ্রীরামপুর গ্রামের জুলহাসের মাধ্যমে আমার ছেলেকে চার মাস আগে লিবিয়ায় পাঠায়। এদিকে, গোহালা ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের কালাম শেখ জানান, তার ছেলে ওমর শেখ ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ত্রিপোলির একটি হাসপাতালে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। তিনিও চার লাখ টাকায় একই গ্রামের দালাল লিয়াকত মোল্লার মাধ্যমে ছেলেকে লিবিয়া পাঠান।
যশোর সরকারি সিটি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল ঝিকরগাছা উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের খাটবাড়িয়া গ্রামের ঈসরাইল হোসেন দফাদারের ছেলে রাকিবুল ইসলাম রকি। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট সে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় আত্মীয়-পরিজনের কাছে ধারদেনা ও জমি বিক্রি করে সাড়ে চার লাখ টাকায় দালালের মাধ্যমে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ায় যায় রকি। সেখান থেকে তাদের ইতালি যাওয়ার কথা। কিন্তু দালালচক্র একটি বন্দিশালায় রকিসহ অন্যদের আটকে রেখে নির্যাতন করে। এ মাসের ১৭ তারিখে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে পাচারকারী চক্রটি। এরই মধ্যে টাকা দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে রকির বাবা। শুক্রবার আচমকা খবর আসে রকিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল সকালে যশোর শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে খাটবাড়িয়া গ্রামের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিহত রকির মা মেহেরুন্নেছার বুকফাটা আর্তনাদ। তিনি বিলাপ করে বলছেন, ‘আমাগের দালানবাড়ি করা লাগবে না; লাগবে না আর কোনো কিছুই। শুধু তুই ফিরে আই বাজান, ফিরে আই!’
ঘুরেফিরে সব পরিবারের কাহিনি একই। ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বল্লভদী ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামে কামরুল ইসলামের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। কবির শেখের ছেলে কামরুলের রয়েছে দুই বছর বয়সী একটি পুত্রসন্তান। শুক্রবার স্বামীর মৃত্যুর খবর আসার পর থেকেই অবুঝ শিশুটিকে বুকে নিয়ে স্ত্রীর আর্তনাদ। কামরুলের বাবা কবির শেখ বলেন, ‘অভাব-অনটনের সংসার। আশা ছিল ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে একটু সুখের মুখ দেখব। কিসের স্বপ্ন, কিসের সুখ; তারা ছেলেটাকে বাঁচতেই দিল না।’
গতকাল মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামে লালচাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে মানুষের ভিড়। স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে আছে। সেই কান্না ছুঁয়ে গেছে আশপাশের লোকজনকেও। সবার চোখেই পানি। চোখের পানি মুছতে মুছতে লালচাঁদের বাবা ইউনুস আলী বলেন, ‘প্রায় আট মাস আগে ছেলে ঢাকায় বসবাসকারী কুষ্টিয়ার আদম ব্যবসায়ী কামাল হাজির মাধ্যমে লিবিয়া যায়। জমি বন্ধক, সমিতির লোন, গরু, ছাগল, গাছ বিক্রি করে স্থানীয় দালাল জিয়ার মাধ্যমে আদম ব্যবসায়ীকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিই। লিবিয়ার মিজদাহ শহরেই তাকে মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনে তাকে কাজ দেওয়া কথা ছিল। উল্টো ছেলেটাকে মেরেই ফেলল তারা।’
এদিকে, লিবিয়ায় গুলিতে নিহত ২৬ জনের মধ্যে আটজনই কিশোরগঞ্জের। তারা হলেন- ভৈরব উপজেলার আকবরনগর গ্রামের মেহের আলীর ছেলে মো. মাহবুব, শ্রীপুর গ্রামের বাচ্চু মিয়ার ছেলে সাকিব, ভৈরব বাজারের অমিত দাসের ছেলে রাজন, শম্ভুপুর গ্রামের শাকিল, রুসুলপুর গ্রামের আকাশ ও হোসেনপুর উপজেলার রহিম। আহত তিনজন হলেন- শম্ভুপুর গ্রামের জানু মিয়া, জগন্নাথপুর গ্রামের সজল মিয়া ও মৌটুপী গ্রামের সোহাগ।
মাদারীপুরের ১৩ যুবকের খোঁজ নেই : লিবিয়ায় গুলি করে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় মাদারীপুরের ১৩ যুবকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজরা হলেন- রাজৈর উপজেলার হোসেনপুরের আবদুর রহিম, বিদ্যানন্দী গ্রামের জুয়েল, মানিক হাওলাদার, টেকেরহাট এলাকার আসাদুল, মনির হোসেন, আয়নাল মোল্লা, ইশিবপুর এলাকার সজীব, শাহীন, সদর উপজেলার জাকির হোসেন, জুয়েল হোসেন, সৈয়দুল, ফিরোজ ও দুধখালীর শামীম।
এদিকে, লিবিয়ায় হতাহতের ঘটনার খবর শুনে রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের দালাল জুলহাস শেখের বাড়িতে হামলা করেছে এলাকাবাসী। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় জুলহাস নিজেকে করোনা রোগী বলে পরিচয় দেয়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করে।