চার পেসারের বোলিং আক্রমণ। চার জনই বিপজ্জনক। কেউ নতুন বলে সুইংয়ে পারদর্শী, কেউ রিভার্স সুইংয়ের মাস্টার। গতি ও বাউন্সে শিকার ধরেন একজন, আরেকজনকে বলা যায় সবকিছুর মিশেল। পেস সহায়ক কন্ডিশনে ওই ভয়ঙ্কর পেস আক্রমণকেই পাল্টা আক্রমণে চমকে দিয়েছিলেন আফতাব আহমেদ !
সময়টা ২০০৫। আফতাবের বয়স তখন ২০ পূর্ণ হয়নি। অমিত সম্ভাবনার ঝলক ততদিনে দেখিয়েছেন বেশ কবার। ব্যাটিংয়ের ধরনের কারণে মূলত সীমিত ওভারের জন্যই উপযোগী মনে করা হচ্ছিল তাকে। কিন্তু চেস্টার-লি-স্ট্রিট টেস্টে আফতাব দেখিয়েছিলেন, তার ঘরানার ব্যাটিং দিয়েও ছাপ রাখা যায় সাদা পোশাকে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন, ‘স্মরণীয় দ্বৈরথ’-এ সাবেক ক্রিকেটার ও এখনকার কোচ আফতাব শুনিয়েছেন ইংলিশ চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প।
ওই টেস্টে ইংল্যান্ডের পেস আক্রমণে ছিল ম্যাথু হগার্ড, স্টিভ হার্মিসন, সাইমন জোন্স ও অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ। টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সাত নম্বরে নেমে পাল্টা আক্রমণে ৮২ বলে ৮২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন আফতাব ১৩ চার ও ১ ছক্কায়।
ব্যাটিংয়ের ধরনের কারণে একসময় বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটারদের একজন ছিলেন আফতাব। তবে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার পূর্ণতা পায়নি নানা কারণে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বেশ কিছু ভালো পারফরম্যান্স থাকলেও ১৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে তার ওই একটিই ফিফটি। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন লড়াই জয়ের স্মৃতি তার কাছে সেই ইনিংসটিই।
‘অনেক তৃপ্তি আর একটু আক্ষেপের ইনিংস’
“চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প বলতে গেলে আমার কাছে সবার আগে চেস্টার-লি-স্ট্রিটের ইনিংসটিই আসবে। কারণ সেদিন চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক রকমের। সবকটিই ছিল কঠিন পরীক্ষা।”
“প্রথমত, কন্ডিশন। ইংলিশ কন্ডিশনে খেলা তো এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক কঠিন। ওই মাঠে সুইং হয় বেশি। আর সেদিন আবহাওয়া ছিল স্যাঁতস্যাঁতে। সব মিলিয়ে পেস বোলিংয়ের আদর্শ পরিবেশ। ভারতের ব্যাটিংকে তখন বিশ্বসেরা মনে করা হতো। তারাও ইংল্যান্ড বা নিউ জিল্যান্ডে গিয়ে বিপদে পড়ত তখন।”
“এই কন্ডিশনেই আমাদের সামনে ছিল চার পেসার সামলানোর পরীক্ষা। একেকজন একেকরকম পেসার। হগার্ড নতুন বলে সুইং করাতে পারত দুই দিকেই। নিয়ন্ত্রণ ছিল দারুণ। আউট সুইং করাতে করাতেই হুট করে স্কিড করে ভেতরে ঢোকাত বল। জেনুইন উইকেট শিকারি বোলার ছিল। হার্মিসন অনেক জোরে বল করত তখন। আর বাড়তি বাউন্স তো ছিলই, লেংথ থেকে আচমকা লাফাত বল।”
“সাইমন জোন্সের রিভার্স সুইং ছিল অসাধারণ। প্রথাগত সুইংও ছিল। আর ফ্লিন্টফ তো ছিলেন ফ্লিন্টফই। দারুণ আগ্রাসী। সুইং-পেস-বাউন্স, সব ছিল। হার্মিসনের চেয়ে ফ্লিন্টফের বাউন্সার বেশি বিপজ্জনক ছিল। কারণ হার্মিসনের অনেক শর্ট বল মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত। কিন্তু ফ্লিন্টফ শর্ট বল করত একদম শরীর তাক করে, এড়ানো মুশকিল। নড়াচড়ার জায়গা দিত না, হাঁসফাঁস করতে হতো ব্যাটসম্যানকে।”
“আরেকটা লড়াই ছিল নিজের সঙ্গে। সবাই তখন আমাকে ওয়ানডের ব্যাটসম্যান মনে করত। অনেকেই বলত, টেস্ট ক্রিকেটে আমি টিকতে পারব না। এজন্য নিজের ভেতর একটা তাগিদ ছিল কিছু করার।”
“সেদিন আমি যখন উইকেটে গেলাম, ততক্ষণে ইনিংস পরাজয় বলা যায় নিশ্চিত। ব্যাটসম্যানও ছিল না বাকি। আমার সঙ্গে কেবল পাইলট ভাই (খালেদ মাসুদ), তিনিও একটু পর আউট। লোয়ার অর্ডারদের নিয়েই খেলেছি।”
“আমার ভাবনা ছিল, নিজের মতোই খেলব। সাহসী, আগ্রাসী। যতদিন খেলেছি, সবসময় চেয়েছি ইতিবাচক ব্যাটিং করতে। বোলারকে আমার ওপর চড়াও হতে দিতে চাইনি। সেদিনও একই লক্ষ্য ছিল, নিজের মতো খেলেই চেষ্টা করব ভালো করতে।”
“আমি গিয়েই জোন্স আর হার্মিসনকে পেয়েছি। ৫০ ওভারের বেশি হয়ে গেছে তখন, বল রিভার্স করছিল। তবে আমি যাওয়ার পরপরই জোন্সকে দুটি চার মেরেছিলাম। তখন তাকে বদলে হগার্ডকে আনা হলো বোলিংয়ে। হার্মিসনকে খেলতে বেশি সমস্যা হয়নি। গতি ছিল অনেক, তবে গতি নিয়ে ভয় ছিল না। তার বল আশপাশ দিয়ে বেশি যেত, ছেড়ে দেওয়া তুলনামূলক সহজ ছিল।”
“তখন ঝামেলা করছিল হগার্ড। খুবই স্কিলফুল বোলার ছিল ওই কন্ডিশনের জন্য। আর মাথা খাটিয়ে বল করত। আমি যাওয়ার একটু পরই পাইলট ভাই, মনির (আনোয়ার হোসেন) ও রফিক ভাইকে দ্রুত আউট করে দিল হগার্ড। আমি ভেবেছিলাম, ইনিংস বোধহয় আর বেশিক্ষণ থাকবে না। তবে তাপস ভাই দারুণ সাপোর্ট দিলেন আমাকে।”
“হার্মিসনকে পরপর দুটি চার মারার পর তাকে সরিয়ে ফ্লিন্টফকে আনা হলো। স্লেজিংও চলছিল সমানে। তবে ওরা সাধারণত গালাগাল বা সরাসরি আক্রমণ করে কিছু বলে না। স্লেজিং এমনভাবে করে, সাইকোলজিক্যালি সেটা প্রভাব ফেলে। ফ্লিন্টফ আসার পর যেমন ওরা পেছন থেকে বারবার বলছিল, ‘এবার আউট হয়ে যাবে। হার্মির বল ছেড়ে দেওয়া গেলেও ফ্রেডিকে ছাড়া যাবে না। এবার নিশ্চিত আউট।’ এসব কথা ব্যাটসম্যানের মাথায় ঢুকে যায়। আসলেই ফ্লিন্টফকে সামলানো ছিল কঠিন। কঠিন অ্যাঙ্গেল থেকে বল ভেতরে ঢোকাত শরীরের দিকে।”
“আমি ঠিক করেছিলাম, ফ্লিন্টফকে মারার মানসিকতা নিয়েই খেলব। কারণ টিকে থাকার চেষ্টা করতে গেলে আরও সে পেয়ে বসবে। আউট হতে পারি, গায়ে লেগে আঘাতও পেতে পারি। সে শরীর সোজা বল করছিল, আমিও শট খেলছিলাম। কয়েকটি শট ব্যাটে লাগার পর আত্মবিশ্বাসও পেলাম।”
“সবচেয়ে বেশি রান ফ্লিন্টফের বলেই করেছিলাম। ওর স্পেলের প্রতি ওভারেই মনে হয় একটি করে চার মেরেছি। ওকে ছক্কা মেরেই ফিফটি করেছিলাম (৪৭ বলে)। ওই ওভারে পরে চার মেরেছি আরও দুটি। পরের ওভারে ওকে সরিয়ে স্পিনার আনল (অফ স্পিনার গ্যারেথ ব্যাটি)।”
“তাপস ভাইও দারুণ খেলেছে। ফিফটি জুটি গড়েছিলাম আমরা (৬০ রানের)। তিনি বলছিলেন যে, ‘তুই চিন্তা করিস না, তোর সেঞ্চুরি পর্যন্ত আমি থাকব।”
“হগার্ড যখন বোলিংয়ে এলো, ওরা আবার স্লেজিং করছিল যে বাউন্স সামলাতে পারলেও সুইংয়ের সামনে টিকতে পারব না। তবে সেদিন আমি যা চাচ্ছিলাম, সবই হচ্ছিল। হগার্ডকেও ভালো সামলাতে পারলাম। কিন্তু তাপস ভাই আউট হয়ে গেল। এরপর মাশরাফি এসেও টিকতে পারল না। এক ওভারে দুজনকে আউট করে দিল হগার্ড। আমি আরেকপাশে ৮২ রানে অপরাজিত।”
“ভেবেছিলাম সেঞ্চুরিটা করতে পারব। সেঞ্চুরি করতে পারলে আমরা ইনিংস ব্যবধানে হারও এড়াতে পারতাম ( ইনিংস ও ২৭ রানে জিতেছিল ইংল্যান্ড)। অল্পের জন্য হলো না। ভালো খেলার খুশির পাশে ওই ঘাটতিটুকু ছিল।”
“যতটা সহজে বললাম, খেলা কিন্তু তত সহজ ছিল না। একজন বোলার থেকে আরেকজন কঠিন। কারও স্পেল পার করে দেব, আরেকজন এসে আরও ভালো করত। এইরকম অভিজ্ঞতা আরও একবার হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে (২০০৬ সালে)। এত ভালো বোলিং আক্রমণ ছিল, কাকে রেখে কাকে সামলাব! লি-গিলেস্পিকে পার করে দেব, এরপর ছিল ওয়ার্ন-ম্যাকগিল!”
“সেবার চ্যালেঞ্জটা জিততে পারিনি। পেস তবু সামলাতে পেরেছিলাম। কিন্তু ম্যাকগিলের গুগলিটা ধরতেই পারছিলাম না। এমনিতে সে ভালো স্পিনার হলেও গুগলি অত ভালো ছিল না। কিন্তু আমি পারছিলাম না পড়তে। মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল, ম্যাকগিলকে সামলাতে না পারলে ওয়ার্নকে কীভাবে পারব!”
“ওই ভয়েই আউট হয়ে গেছি। ওয়ার্নকে খারাপ খেলিনি, তার বলে ছক্কা-চার মেরেছি। কিন্তু ম্যাকগিলের সামনে প্রচণ্ড অস্বস্তি ছিল। দুই টেস্টে ম্যাকগিলের বলেই তিনবার আউট হয়েছি, একবার ওয়ার্ন।”
“ভয়ঙ্কর বোলিং আক্রমণের সামনে চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প যেমন আছে, তেমনি ব্যর্থও হয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে ওই সিরিজে। হয়তো নিজের মতো সাহস নিয়ে খেললে আরও ভালো করতাম।”