যে কারণে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের একাংশ গ্রাস করতে চান নেতানিয়াহু

190657_bangladesh_pratidin_netaniahu

খলদার ইহুদিবাদী ইসরায়েল জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ এলাকা অধিকৃত ভূখণ্ডের সঙ্গে একিভূত করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ইসরায়েলের এ পদক্ষেপের ফল কি হতে পারে না নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।

ইহুদিবাদী ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের একাংশকে ইসরায়েলের সঙ্গে একিভূত করার পরিকল্পনা ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সংগঠন ও জনগণের পক্ষ থেকে ব্যাপক বিরোধিতা ও একের পর এক হুঁশিয়ারির পরিপ্রেক্ষিতে, এমনকি ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য ওই পরিকল্পনার বিরোধিতায় করায় এবং সেইসঙ্গে তারা এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরও নীতির বিরোধিতা করায় নেতানিয়াহু আপাতত ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকালের স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে ইসরায়েল কেন জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ ভূমি দখলিকৃত ভূখন্ডের সঙ্গে একিভূত করতে চায়। এক হাজার ৬১৩ বর্গ কিলোমিটার ওই এলাকায় ১৩০টি ইহুদি উপশহর রয়েছে যেখানে চার লাখ ৬০ হাজারের বেশি ইহুদি বসবাস করছে। পশ্চিম তীরে প্রাচীরের মধ্যে তিন লাখ ৫০ হাজার ইহুদির জন্য ৫২টি উপশহর এবং প্রাচীরের বাইরে ৭৮টি উপশহর এক লাখ ইহুদির জন্য বরাদ্দ রয়েছে।

জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ ভূখণ্ডকে ইসরায়েলের সঙ্গে একিভূত করার পেছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, ইসরায়েলের সম্প্রসারণকামিতা ও দখলদারী মানসিকতা। ইসরায়েল জন্মগতভাবেই একটি আগ্রাসী শক্তি। কেননা ইউরোপের সহযোগিতায় ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল করেই তারা অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং আরব ভূখণ্ড জবর দখলের প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের মতামতের বিষয়টি বাদ দিয়ে বলা যায় সামগ্রিকভাবে তারা পুরো ফিলিস্তিন ভূখণ্ড গ্রাস করে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে আছেন। তার ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার পর শুরু হয় তাদের রাজনৈতিক অচলাবস্থা। তিন দফায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এখনো রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটেনি। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে লিকুদ পার্টির নেতা  নেতানিয়াহু  এবং নীল ও সাদা দলের নেতা বেনি গান্তেয যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনে সম্মত হয়ে দেশ চালাচ্ছেন। কিন্তু ইসরায়েলের কোনো কোনো সূত্র জানিয়েছে, নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে অথবা নতুন করে নির্বাচন দিয়ে বেনি গান্তযকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য নেতানিয়াহু জর্দান নদীর পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে একিভূত করার চেষ্টা করছেন যাতে জন সমর্থন ধরে রাখা যায়।

তৃতীয় কারণ হচ্ছে, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের ক্ষমতার মেয়াদ প্রায় শেষ হতে চললো। ইসরায়েল ও ইহুদিবাদী লবির সমর্থন ধরে রাখতে ট্রাম্প গত চার বছরে ইসরায়েলের স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’ নামক বিতর্কিত পরিকল্পনা উত্থাপন করেছেন। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তেলআবিব থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে দূতাবাস স্থানান্তর করে বায়তুল মোকাদ্দাসকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেইসঙ্গে সিরিয়ার গোলাম মালভূমিকেও ইসরায়েলের অংশ বলে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ জন্য চিন্তিত যে আগামী নভেম্বর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হতে পারেন। এ কারণে নেতানিয়াহু আমেরিকায় আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই জর্দান নদীর পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে একিভূত করার চেষ্টা করছেন।

অন্য দেশের  ভূখণ্ডের একটি অংশকে নিজ দেশের সঙ্গে একিভূত করার অর্থ হচ্ছে নতুন ওই এলাকার উপর চীরতরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ১৯০৭ সালে হেগের চতুর্থ কনভেনশন ও ১৯৪৯ সালে জেনেভা চতুর্থ কনভেনশনের যুদ্ধরীতি এবং ১৯৭৭ সালে সংযুক্তকরণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক নীতির আলোকে অন্য দেশের ভূমি সংযুক্তকরণকে দখলদারি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেবল মাত্র শান্তি চুক্তির আওতায় এবং স্থানীয় জনগণের মতামত তথা গণভোটের মাধ্যমে এভাবে ভূখণ্ড হস্তান্তর করা যাবে। এসব আইনের ভিত্তিতে বলা যায় ইসরায়েল জর্দান নদীর পশ্চিম তীরকে অধিকৃত ভূখন্ডের সঙ্গে একিভূত করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ ছাড়া, ইসরায়েলের এ পদক্ষেপ বর্ণবাদী পরিকল্পনা। কেননা এখানে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়িগুলো ও কৃষিখেত অভিবাসী ইহুদিদেরকে দেয়া হয়েছে। ইসরায়েলের এ আচরণ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সব আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

অ্যামনেস্টি ইন্টার ন্যাশনালের উত্তর  আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দফতরের সচিব সালেহ হোজ্জাজি জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ এলাকা স্থায়ীভাবে দখলের ইসরায়েলি পরিকল্পনাকে আন্তর্জাতিক আইনের খেলাফ বলে অভিহিত করেছেন।

যাইহোক, ইসরায়েলের এ পদক্ষেপ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনাও বটে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি অনুযায়ী গাজা উপত্যকা ও জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের অধীনে রয়েছে যা মূল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মাত্র ২০ শতাংশ। কিন্তু এখন ইসরায়েলের চোখ পড়েছে পশ্চিম তীরের দিকে যা অসলো চুক্তির লঙ্ঘন। এ কারণে ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষও ঘোষণা করেছে ইসরায়েল যদি তার ওই ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তাহলে তারাও আমেরিকা ও ইসরায়েলের সঙ্গে করা সমস্ত শান্তি চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে। ইউরোপও বাহ্যিকভাবে হলেও ইসরায়েলের ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে।

যাইহোক, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু শেষ পর্যন্ত জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ এলাকা সংযুক্ত করার পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে গেছেন। তবে তিনি এ পরিকল্পনা একেবারে বাদ দেননি এবং ইসরায়েল উপযুক্ত সময়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। ফিলিস্তিনের অন্যান্য সংগ্রামী দলগুলোও হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছে, প্রয়োজনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তারা নতুন করে যুদ্ধ শুরু করবে।  এ ব্যাপারে অ্যামনেস্টি ইন্টার ন্যাশনালের উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দফতরের সচিব সালেহ হোজ্জাজি বলেছেন, ইসরায়েলের টার্গেটকৃত এলাকাকে ইহুদিকরণ করা হলেও তারা দখলদার হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

Pin It