অপরাধ দুর্নীতি করলেই শাস্তি: প্রধানমন্ত্রী

bd-pratidin-1-2020-07-18-01

করোনাকালের দুই আলোচিত চরিত্র মো. সাহেদ বা সাহেদ করিম এবং চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরী বা সাবরিনা শারমিন হোসেইন। এদের একজন ছিলেন ‘টকশো নায়ক’, অপরজন ‘তারকা উপস্থাপক’। নানা উপায়ে ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হতে চাওয়ার সাম্প্রতিক উদাহরণ এই দুই চরিত্র। তবে তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর অবস্থান থাকায় তারা গ্রেফতার হয়েছেন। এরই মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, কেবল সাহেদ বা সাবরিনাই নন, আওয়ামী লীগ ও সরকারের নাম ভাঙিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি বা অপরাধ করার চেষ্টা করলে কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না। প্রত্যেককেই শাস্তির আওতায় আনা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি নিয়েছেন। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের তিনি নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন।

গত ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতিবাজ যে-ই হোক ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। কে কোন দলের তা বড় কথা নয়, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের আমরা ধরে যাচ্ছি। আগের দিন ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে অপর এক বক্তৃতায় রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতাল নিয়ে বলেন, ওই (রিজেন্ট) হাসপাতালের এই তথ্য আগে কেউ দেয়নি, জানাতে পারেনি। সরকারের পক্ষ থেকেই খুঁজে বের করেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অপরাধ ও দুর্নীতি যার যার তার তার। দল বা সরকার কারও অপরাধের দায় নেবে না। এক্ষেত্রে কেউ দল বা সরকারের ভিতর বা বাইরের হতে পারেন। কাউকে ছাড় দেবেন না প্রধানমন্ত্রী। কোনোমতেই আইনের স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত করতে দেবেন না তিনি। সরকারের শীর্ষ পর্যায় মনে করে, ক্ষমতার টানা তিন মেয়াদে একটি সুবিধাবাদী শ্রেণি নানা ফটক দিয়ে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে। তারা দলের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টায় আছে। তাদের কর্মকান্ড দৃশ্যমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার বা দলের কোনো বড় নেতা বা কর্মকর্তা তাদের রক্ষা করতে পারবেন না। এখানে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান কঠোর ও অনমনীয়।

জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব মো. ইহসানুল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অপরাধ ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আপস নেই। যারা যেখানে উল্টাপাল্টা কিছু করছে তাৎক্ষণিক তাদের ধরা হচ্ছে। সে যেই হোক, দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কঠোর।

কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক রকম যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এক্ষেত্রে তিনি নিজের ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা শুরু করেন। এ অভিযানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের অনেক প্রভাবশালী নেতাকে প্রধানমন্ত্রী সংগঠন থেকে ছুড়ে ফেলে দেন।

সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত চরিত্র মো. সাহেদ কিছু রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে পড়েন। রাতারাতি তিনি ‘টকশো নায়ক’ বনে যান।  তার কথাবার্তায় মনে হতো তিনি সরকার ও দলের অন্যতম প্রধান নীতিনির্ধারক। রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ এমন কেউ নেই যে তার সঙ্গে সাহেদের ঘনিষ্ঠ ছবি নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাষ্ট্রের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির সঙ্গে সাহেদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখে তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলার সুযোগ ছিল না। এই সাহেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটিরও সদস্য ছিলেন। এই পদবি ব্যবহার করে রাষ্ট্রের সব বড় বড় অনুষ্ঠানের সামনের সারিতে বসতেন তিনি। এভাবেই তিনি নিজের রিজেন্ট হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেডে হাসপাতাল হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে চুক্তি করতে সমর্থ হন।  কিন্তু কভিড-১৯ টেস্ট নিয়ে প্রতারণা ও অনিয়ম ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দুটি হাসপাতালই সিলগালা করে দেওয়া হয়। দলীয় পরিচিতি এবং সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তাকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি।

এ সময়ে অপর আলোচিত চরিত্র ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ কেয়ার আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে কাজ বাগিয়ে নিত। বিনামূল্যে কভিড-১৯ টেস্ট করার ব্যাপারে তাদের প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু তাদের প্রতারণা ধরা পড়ার পর এরই মধ্যে এই দম্পতি গ্রেফতার হয়েছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক তাদের সুরক্ষা দেয়নি। স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতারণার সঙ্গে ডা. সাবরিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার ঠিক আগের আলোচিত চরিত্র ছিলেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম পাপুল ও তার সংসদ সদস্য স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে রাজনীতি ও ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে যান তিনি। অর্থ বিলিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দিয়েছেন, ওই সংসদ সদস্য (পাপলু) নাকি কুয়েতের নাগরিক! সে কুয়েতের নাগরিক কিনা, তা নিয়ে কিন্তু কুয়েতের সঙ্গে কথা বলছি, বিষয়টি দেখব। যদি এটা হয়, তাহলে তার ওই আসনটি (লক্ষ্মীপুর-২) খালি করে দিতে হবে। যেটা আইন আছে, সেটাই হবে। আর তার বিরুদ্ধে এখানেও তদন্ত চলছে।

লকডাউনের পর ত্রাণ তৎপরতায় যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করা হয়। অথচ এদের বেশির ভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত জনপ্রতিনিধি। মাস্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার নামে অভিযোগ ওঠায় তার নামেও মামলা হয়েছে। দলীয় পরিচিতি কাউকে রেহাই দেয়নি।

এর আগে হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছিলেন পাপিয়া নামের এক যুব মহিলা লীগ নেত্রী। মূলত, একশ্রেণির রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীর সঙ্গে সম্পর্ক করে তদবির বাণিজ্যই ছিল তার পেশা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই তথাকথিত নেত্রীকে গ্রেফতার করে এবং জেলহাজতে পাঠায়। পাপিয়ার আগে আলোচিত ছিলেন ক্যাসিনোর নায়কেরা। তাদের বাড়ি ভর্তি কাঁড়ি কাঁড়ি নগদ অর্থ আর শত শত বাড়ি ফ্ল্যাটের খবর পাওয়া যেত। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের কিছু প্রভাবশালী নেতার ছত্রচ্ছায়ায় ক্যাসিনো কর্মকান্ড চলত। কেউ কেউ সরাসরি ক্যাসিনোকান্ডে জড়িত ছিলেন। সরকারের নির্দেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনা হয়। ক্যাসিনোকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার করা হয়। সম্রাটকে সহযোগিতা করার অভিযোগে যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একইভাবে নির্মাণ খাতের গডফাদার জি কে শামীম অর্থ ব্যবহার করে যুবলীগে ঢুকে পড়েন। তিনিও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিতেন। শেষ পর্যন্ত তারও ঠাঁই হয় জেলখানায়। ক্যাসিনোকান্ড ও জি কে শামীমের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের তখনকার শীর্ষ নেতাদের বিদায় করে দেওয়া হয়। পরে সম্মেলনের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক লীগে নতুন নেতৃত্ব আনা হয়। তার আগে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজোয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তাদের দলীয় পদ থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, হাতেগোনা কয়েকজনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের অর্জন ম্লান হতে বসেছে। এ অবস্থার অবসান চায় সরকার। আওয়ামী লীগ কোনো অপরাধী বা দুর্নীতিবাজের আশ্রয়স্থল বা প্রতিরক্ষা হতে পারে না। তাই এখন থেকে ঘটনার পেছনের ঘটনাও খতিয়ে দেখা হবে। কেউই ছাড় পাবে না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অনড়।

Pin It