সুসময়, তবুও চ্যালেঞ্জ
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। এতে স্বভাবতই উজ্জীবিত দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা। এ মুহূর্তে দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশে জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতিও ক্রমশ অপস্রিয়মাণ। শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব দৃশ্যত অনুপস্থিত। ফলে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের আগামী দিনের পথচলা অনেকটাই মসৃণ হবে- এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা।
এর পরও কোথায় যেন একটু শঙ্কা, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মধ্যেও যেন একটু অস্বস্তির ছোঁয়া। নেতাদের কথায়ও ফুটে উঠছে এমন সংশয়। তারা বলছেন, কার্যত বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। যেকোনো মুহূর্তে হামলে পড়তে পারে এই অপশক্তি, অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে মানুষের জীবন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও বলেছেন, ঈদুল ফিতরের দিনেও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা ছিল। তার নির্দেশনা এবং গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সেই বিপদ এড়ানো গেছে। তিনি এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী অপশক্তি মোকাবেলা করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনাটাই আওয়ামী লীগ এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ জন্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, নির্বাচন ব্যবস্থাকেও গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’-এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে হবে সরকারের কার্যক্রমে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত দেশ এবং সুশাসন তথা আইনের শাসন। পাশাপাশি মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ ঘোষণার সরকারি নীতির বাস্তব প্রতিফলনও ঘটাতে হবে।
তারা মনে করেন, কাঙ্ক্ষিত পরিবেশে আওয়ামী লীগ যেমন দেশ শাসনের সুযোগ পাচ্ছে, তেমনি সুশাসন নিশ্চিত করে উন্নতির পথে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জও তাকে মোকাবেলা করতে হবে।
এমন প্রেক্ষাপটেই আজ রোববার আওয়ামী লীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। দিনটিকে স্মরণীয় করে তুলতে আজ থেকে দেশজুড়ে মাসব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি পালিত হবে। উৎসবমুখর পরিবেশে নেতাকর্মী-সমর্থকরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দে যোগ দেবেন- এমনটাই প্রত্যাশা দলের নীতিনির্ধারকদের।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল শনিবার এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালি জাতির প্রতিটি মহৎ, শুভ ও কল্যাণকর অর্জনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে। জনগণই আওয়ামী লীগের শক্তি। ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ, উন্নত ও আধুনিক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও দেশবিরোধী অপশক্তির মূলোৎপাটন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি বিশ্বাস করি, এ দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করবে।’
প্রতিষ্ঠালগ্নের এই শুভক্ষণে বিশ্নেষকরা আওয়ামী লীগকে তার গুরুদায়িত্বগুলো মনে করে দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেছেন, একটানা ১০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থেকে আওয়ামী লীগ সফলতার সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরও ১০ বছর একই রকম সুযোগ ও পরিস্থিতি পেলে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে পৌঁছার সব শর্ত অর্জনে সক্ষম হবে। এ জন্য দলটিকে তার আদর্শ, নীতি ও কার্যক্রমকে ধরে রাখতে হবে। অটল থাকতে হবে ২০২১ ও ২০৪১ সালের টার্গেট পূরণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, আওয়ামী লীগকে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা যেন বারবার চিন্তা-ভাবনা করেন যে, একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, জনগণের অধিকার স্তিমিত অথবা আইনের শাসন সংকুচিত করাটা তাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল না। উন্নয়নের রাজনীতির জন্যও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও আইনের শাসন সুনিশ্চিত করাই আওয়ামী লীগের সামনের দিনের চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে দল ও দেশকে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন এবং দুঃশাসন থেকে বের করে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। জঙ্গিবাদের উত্থান মোকাবেলা করে শান্তিপূর্ণভাবে দেশ পরিচালনার উপায়ও খুঁজতে হবে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১০ বছরের সফলতায় দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। সরকারের কট্টর সমালোচকরাও এটা স্বীকার করছেন। এই সাফল্য ধরে রাখাটাও দল ও সরকারের জন্য আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। তবে তাদের দৃঢ়প্রত্যয় রয়েছে, জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী দিনে জাতির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা হবে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করে যেতে পারলেও কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দেওয়ার সময় পাননি। তার সেই অসমাপ্ত কাজটি এখন বাস্তবায়ন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ আছে বলেই আজ বাংলাদেশ একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, দেশে এ মুহূর্তে বিরোধী দলের অস্তিত্ব না থাকলেও তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। আওয়ামী লীগ ও সরকারকে তার চলার পথের এই কাঁটা সরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তার বিশ্বাস, জঙ্গি-সন্ত্রাস মোকাবেলা এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেতনা ধারণ করে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাস্তবায়ন করবে আওয়ামী লীগ।
৭০ বছরের বর্ণাঢ্য পথচলা :১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন পুরান ঢাকার কেএম দাস লেনে খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আবদুর রশীদের রোজ গার্ডেনের বাসভবনে প্রগতিশীল এবং তরুণ মুসলিম লীগ নেতাদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন। এতে গঠিত হয় পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ১৯৫৫ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর নামকরণ হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক ও কারাবন্দি অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান দলের অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব দলের সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে তরুণ মুজিব নিজেকে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে ১৯৭১ সালে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা লাভ। এ ছাড়া বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও সরকার গঠন, বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী ১১ দফা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভসহ গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সব আন্দোলন-সংগ্রামেও দলটি ছিল সম্মুখ সারিতে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যার পর তারই কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র এবং মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত চার দফায় ক্ষমতায় এসেছে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাকে ইতিমধ্যে বর্ণাঢ্য সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। জাতীয় ও দলীয় পতাকার পাশাপাশি রঙবেরঙের ব্যানার-ফেস্টুন আর নৌকা প্রতিকৃতি দিয়ে সেজেছে বিভিন্ন সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়, নবাবপুর রোডের পুরনো কার্যালয়সহ ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনকে বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জায় রাঙিয়ে তোলা হয়েছে।
দিনটি উপলক্ষে ঢাকায় তিন দিনব্যাপী এবং সারাদেশে মাসব্যাপী কর্মসূচিও পালন করবে আওয়ামী লীগ। আজ রোববার সকালে বঙ্গবন্ধু ভবন ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু হবে। সকাল সাড়ে ৮টায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সকাল ১১টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানাবে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রতিনিধি দল। আগামীকাল সোমবার বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কেন্দ্রে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভা ও প্রতি জেলার দু’জন করে প্রবীণ নেতার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। সারাদেশের জেলা-উপজেলায় আজ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি চলবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিবৃতিতে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করার জন্য দল এবং সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সব জেলা, উপজেলাসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।