আর্ট : রূপের মাঝে অরূপ মাধুরী

elements of both Adam and Eve by Masolino.

elements of both Adam and Eve by Masolino.

করোনা, তথা কোভিড-১৯ এর দোর্দণ্ড প্রতাপী কোপানলে পড়ে যখন ত্রাহি ত্রাহি করছে মানব সম্প্রদায়, মানুষের মৃত্যুর মিছিল যখন কয়েক লক্ষ অতিক্রম করেও ক্রমাগত যুক্ত হচ্ছে হাজারে হাজারে; তখন আর্ট নিয়ে ভাবনা, এবং তা নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়া; রোম পোড়ার সময় নিরোর বাঁশি বাজানোর সেই প্রবচনের মতোই বিদ্রুপাত্মক নয় কি ? কোটি কোটি মানুষ যখন কেবলমাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ, প্রতিনিয়ত প্রতিকারহীন শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত সময় যাপন করছে, তখন আর্ট-এর মতো প্রায় বৈষয়িক প্রয়োজনশূন্য একটি বিষয়ে মনোনিবেশ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ? এবং মনটাকে সেখানে দীর্ঘক্ষণ সংযুক্ত রাখাই-বা সম্ভব কতটুকু ? এমন সব প্রশ্ন মনে করে যখন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছি, তখন আবার বিপরীত ভাবনাটাও উঁকি দিচ্ছে বেদনার আহাজারির ভেতরে বেজে ওঠা সুন্দর সঙ্গীতের মতো। এই যে হাজার হাজার বছরের মনুষ্য সভ্যতার ইতিহাস, সেই ইতিহাসে তো প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক অনেক দুর্যোগই এসেছে অনেকবার, মহাযুদ্ধ-মহামারী ইত্যাদিতে বার বার বিপর্যস্ত হয়েছে মানুষের জীবন; তাতে কি আর্ট-এর মতো সুকুমার বৃত্তির চর্চা থেমেছিল কোনোকালে ? না। থামেনি। বেশিদূর যেতে হবে না, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সেই যুদ্ধ শেষ হতে না-হতেই ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া ভয়ঙ্কর ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডামিক বা স্প্যানিশ ফ্লু যখন কোটি কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছিল, তখনও তো কবিতা-গল্প-উপন্যাস-চিত্রকলার মানুষেরা তাদের সুকুমার বৃত্তির চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। এবং এসময় বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যে রচিত হয়েছে অসামান্য কিছু সাহিত্য নিদর্শনও। সুতরাং আর্ট নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে বিশেষ দোষের কিছু দেখি না।

আচ্ছা, আর্ট কী ? সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাছে লিখিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘রূপসৃষ্টিই আর্ট— যে রূপের মধ্যে আমি একান্তভাবে অহৈতুক ঔৎসুক্যের সঙ্গে realityকে দেখি।’ আর্ট মানুষের আবেগ ও অনুভূতির সৃজনশীল প্রকাশ। উপনিষদ অনুসারে ব্রহ্মস্বরূপের তিনটি ভাগ- সত্যম্, জ্ঞানম্, অনন্তম্; আমি আছি, আমি জানি এবং আমি প্রকাশ করি। ব্রহ্মস্বরূপের বিষয়টিকে আমরা যদি মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে দাঁড়ায় মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা প্রথম দুটি পার হয়ে তৃতীয় স্তর, তথা ‘আমি প্রকাশ করি’ গুণের অধিকারী হতে সক্ষম। মানুষের এই প্রকাশগুণ বা প্রকাশের ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষা থেকেই শিল্পের জন্ম। প্রকাশের এই ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষাকে ব্যবহার করেই একজন শিল্পী তাঁর শিল্পবস্তুটিকে অপরের নিকট উপস্থাপন করেন। শিল্পীর পছন্দ ও প্রবণতা অনুযায়ী উপস্থাপনের পদ্ধতি ও প্রকরণ হয়ে থাকে বিভিন্ন। পদ্ধতি বা প্রবণতা যাই হোক, শিল্পের কাজ হচ্ছে সংকীর্ণতার দাসত্ব থেকে জ্ঞানকে মুক্তি দেওয়া; ব্যক্তির সীমা থেকে সত্য ও সুন্দরকে নৈর্ব্যক্তিক অপরিসীমে উন্নীত করা।

Encyclopaedia Britannica-এর মতে আর্ট হলো— modes of expression that use skill or imagination in the creation of aesthetic objects, environments, or experiences that can be shared with others. Cambridge Dictionary বলছে আর্ট হলো— making of objects, images, music, etc. that are beautiful or that express feelings. দুটো সংজ্ঞাতেই অনুভূতির প্রকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমটিতে দক্ষতা বা কল্পনাকে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে ছবি, সঙ্গীত বা এই জাতীয় নান্দনিক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। উভয়স্থানেই যে-কোনো কিছু তৈরি বা সৃজনশীলতা গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু এরকম সীমিত পারিসরিক আভিধানপ্রসূত সংজ্ঞা বা ইঙ্গিতে আর্ট বা শিল্পের যিনি রসিক, তার চলে না। তিনি চান আর্ট বিষয়ে নান্দনিক একটি আলোচনা।
আর্ট নিয়ে আলোচনার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ, তবে আর্ট-এর ইতিহাস দীর্ঘতর; বলা যায় মানুষের সভ্যতার সাথে-সাথে তার আর্ট বা শিল্পানুভূতিরও যাত্রা শুরু। আর্ট নিয়ে লিখিত কিংবা মৌখিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা অনেক পরে এসেছে, কিন্তু প্রাচীন অরণ্যচারী মানুষের মনেও যে আর্ট বা নান্দনিকতার প্রতীতি ছিলো, বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র দেখে অনুমান করা যায়। প্রায় ৩লক্ষ বছর আগে শুরু হয়ে ১৫হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো যে-প্রস্তর যুগ, যার প্রথম পর্বকে পুরোপলীয় যুগ নামে অভিহিত করা হয়েছে, সেই যুগের মানুষের বসবাসের গুহার ভেতরে বায়সন, ঘোড়া, শূকর, হরিণ, ষাঁড়, শিকারের দৃশ্য কিংবা নৃত্যরত মানুষের যে-ছবি পাওয়া গেছে, তা সে-যুগের মানুষের চিত্রকলা চর্চার পরিচয় বহন করে। গাছের পাতা ও ছালে, মাটি ও পাথরের ফলকে, হাতির দাঁতেও প্রাচীন পৃথিবীর মানুষ তাদের শিল্পানুভূতি তথা সৌন্দর্যচর্চার ছাপ রেখে গেছেন। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে, আনুমানিক ২৩৫৭ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে রচিত একটি কবিতা, যা কি না লাইপৎজিগের একটি মাটির টালিতে উৎকীর্ণ ছিলো; নামহীন সুমেরীয় এই কবিতাটিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম কবিতা বলেছেন কেউ কেউ। মায়াসভ্যতার যে অসাধারণ শিল্পনিদর্শন পাওয়া গেছে, তার বয়সও কারো কারো মতে প্রায় ৪,৬০০ বছর। সিন্ধু সভ্যতায় বয়ন-শিল্পীদের তুলা ও পশমী বস্ত্র, মৃৎশিল্পীদের নকশা করা পাত্র, ব্রোঞ্জের নতর্কীমূর্তি প্রভৃতির বয়স সাড়ে ৪হাজার বছরেরও বেশি। কবিতায় লিখিত ঋগ্বেদের বয়সও চার থেকে পাঁচ হাজারের বছরের কম নয়, কারো কারো মতে সেগুলো আরো কয়েক হাজার বছরের পুরাতন। সভ্যতার সুদীর্ঘ পরিক্রমায় পৃথিবীর এক-একটি জাতি একেকভাবে তাদের নান্দনিক অনুভূতিকে ভেবেছেন, প্রকাশ করেছেন, আলোচনা করেছেন। সভ্যতার প্রথমপর্বের অধিকাংশ নমুনাই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি, বিধায় বিভিন্ন আলোচনায় কেবল সভ্যতার উৎকৃষ্ট সময়ের কীর্তিগুলোর খানিকটা আমরা জানতে পেরেছি। এবং সেই পর্বটারও ইতিহাস সিকিসত্যে মোহাচ্ছন্ন। যে-ভাষাভাষী মানুষেরা আলোচনা করেছেন, মূলতই তারা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসের মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছেন। ফলে আর্ট বিষয়ক আলোচনাতেও আধার কিংবা আধেয়, কোনোটাই সার্বিক বা নৈর্জাতিক হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না।

২.
কোনো কলাবিদ্যাই প্রকৃতির যথাযথ অনুকরণ নহে। প্রকৃতিতে প্রত্যক্ষকে আমরা প্রতীতি করি, সাহিত্যে এবং ললিতকলায় অপ্রত্যক্ষ আমাদের কাছে প্রতীয়মান।— রবীন্দ্রনাথ

আর্ট বিষয়ে আলোচনার কথা উঠলে, প্রায় সকলেই খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ শিষ্য এরিস্টটলের কথা দিয়ে শুরু করেন। কিন্তু একটি বিষয় উল্লেখ না-করলে সত্যকে খানিকটা এড়িয়ে যাওযা হয়; প্লেটো-এরিস্টটলের অনেক আগেই, ভারতীয় বৈদিক ঋষিগণ শিল্প নিয়ে বিশদ আলোচনা না-করলেও মানুষের সকল রচনাকে ‘দেবশিল্পানাম্ অনুকৃতি’ অর্থাৎ দেবতার রচনার অনুকৃতি বলে অভিহিত করেছিলেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আছে— ‘শিল্পানি শংসন্তি দেবশিল্পানি, মানুষের সব শিল্পই দেবশিল্পের স্তবগান। তবে একথা হয়তো ঠিক যে, গ্রিক দার্শনিকরাই প্রথম শিল্প-সাহিত্য-দর্শন বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন এবং গ্রন্থাদিতে সেগুলো লিপিবদ্ধ করেন। রেঁনেসাকালের তিন বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল, যারা কি না পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গুরু-শিষ্য পরম্পরার পতাকা ধারণ করে আছেন, তারাই প্রথম দর্শন-শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে যুক্তি-তর্কনির্ভর আলোচনা করেছেন। সক্রেটিসের আলোচনার কোনো লিখিত রূপ পাওয়া যায়নি। প্লেটো-এরিস্টটলদের রচনা এবং বিভিন্ন কিংবদন্তির মাধ্যমে সক্রেটিস সম্পর্কে জেনেছে পৃথিবী। প্লেটো ও এরিস্টটল; জ্ঞানরাজ্যের বহুবিচিত্র আলোচনার পাশাপাশি তাদের হাতেই প্রথম আর্ট ও কাব্য বিষয়ে নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রপাত হয়। ‘দ্য রিপালবিক’ গ্রন্থে কবি ও কাব্য সম্পর্কে যে-আলোচনা করেছেন প্লেটো, সেখানে কবি ও কাব্যকে রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর মনে করেননি। তিনি কবিকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করার কথা বলেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি নিজেই কবিতা লিখতেন এবং কবি ও কাব্যের মোহনীয়তা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাহলে নির্বাসনের কথা বলেছেন কেন ? এর উত্তরটিও হয়তো কবি ও কবিতার মোহনীয় ক্ষমতার ভেতরে নিহিত। তিনি হয়তো অনুমান করেছিলেন কবিরা তো রাষ্ট্রের ধরাবাঁধা নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না-করে স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দভাবে অনুভূতি প্রকাশ করেন, সেই অনুভূতি সমাজ-রাষ্ট্র ও প্রথাগত ধর্মের অনুকূলে যদি না-যায়, সাধারণ মানুষও এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা হারাতে পারে, রাষ্ট্রীয় নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি অবনত না-থাকতে পারে। ফলে রাষ্ট্রে ঘটতে পারে বিশৃঙ্খলা। এছাড়া তিনি শিল্প-সাহিত্যকে মনে করতেন ‘ইমিটেশন’ বা অনুকরণ, সত্যকে নকল করবার চেষ্টা। অনুকৃত বিষয়কে ‘ইলিউশন’ বা দৃশ্যমায়া নামে অভিহিত করেছিলেন তিনি। তাঁর `Theory of Ideas’- নামক রচনায় জাগতিক সত্য অপেক্ষা আধ্যাত্মিক ও কাল্পনিক সত্যকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। অবশ্য ‘দ্য ল-জ’ বা আইন গ্রন্থে নাগরিকদের অবশ্যই সৎ ও সুন্দর শিল্প সম্পর্কে শিক্ষিত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্লেটো বলেছেন— শিল্প যেহেতু অনুকরণ, তাই যে-বিষয় বা ব্যক্তির অনুকরণ করা হবে, তাকেও হতে হবে ভালো ও সুন্দর। এই বক্তব্যের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে বা সংকুচিত অর্থে হলেও শিল্পকে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা যে দিয়েছিলেন, তা অনুমান করা যায়।

কবি ও শিল্পীদের সৃষ্টিকে অসত্য এবং অপ্রয়োজনীয় মনে করা দার্শনিক প্লেটো ছিলেন ভাববাদী মানুষ, কিন্তু তাঁর শিষ্য এরিস্টটল ছিলেন বিজ্ঞানী। এরিস্টটলের কাছে জাগতিক বাস্তবতাই ছিলো সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শিল্পসাধনার ক্ষেত্রে প্রথাগত ভালোত্ব কিংবা অতিন্দ্রীয় বা আধ্যাত্মিক জগৎকে আবশ্যক মনে করেননি। প্লেটো যেখানে শিল্প-সাহিত্যকে অনাবশ্যক মনে করেছেন, এরিস্টটল সেখানে একে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আলোচনা করেছেন। প্লেটো মনে করতেন— আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শের অপার্থিব জগৎটি পূর্ণ সত্য। সেই জগৎকে অনুকরণ করে ঈশ্বর নিজেই যে-পার্থিব জগৎ সৃষ্টি করেছেন তা নিঁখুত ও সম্পূর্ণ নয়। একে অনুকরণ করে কবি-শিল্পীরা যা সৃষ্টি করেন আরও অসম্পূর্ণ ও বানোয়াট। এরিস্টটলও শিল্পকে অনুকরণ মনে করতেন, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বা মিথ্যা একেবারেই নয়। তিনি অনুকরণকে মানুষের স্বাভাবিক ক্রিয়া বলে উল্লেখ করে একে শিক্ষার অন্যতম সোপান ও আনন্দদায়ক ক্রিয়া এবং সৃষ্টিকর্মের উৎস হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। শিল্পকে মিথ্যা তো নয়ই, বাস্তবের চেয়ে সুন্দর ও মহোত্তর বলে মনে করেছেন। এমনকী ইতিহাসের চেয়েও অধিক দার্শনিক ও গভীর বলে মনে করেছেন শিল্পকে। তাঁর ‘কাব্যতত্ত্ব’ গ্রন্থে বলেছেন— কাব্য ইতিহাসের চেয়ে বেশি দার্শনিক এবং বেশি গভীর, কারণ ইতিহাস বলে নির্দিষ্ট তথ্যের কথা, কাব্য বলে সার্বজনীন সত্য। শিল্প যে শিল্পীর নিজস্ব সৃষ্টি, একে জগতের প্রথাগত নৈতিকতার মানদণ্ডে বিবেচনা করা চলে না, কেবল শিল্পের স্বতন্ত্র মানদণ্ডে যাচাই করতে হয়, এই ধারণাটি এরিস্টটলের আলোচনা থেকে অনুধাবন করা যায়। তবে এরিস্টটলও শিল্প ও শিল্পীর জন্য কিছু পরামর্শ রেখে গেছেন। ভাষার ক্ষেত্রে স্পষ্টতাকে শিল্পের প্রধান গুণ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। অবশ্য স্পষ্টতা বা সরলতার অর্থ যে খেলো বা হালকা শব্দের ব্যবহার নয়, বরং বিশিষ্ট শব্দমালার সমাহার, সেকথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শিল্পীকে আতিশয্য বর্জন করতে বলেছেন, তবে রূপক-উপমা-অলঙ্কারের ক্ষেত্রে অভিজাত হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। এরিস্টটলপরবর্তী সময়ে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের দিকে শিল্প-সাহিত্যের তত্ত্বগত দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন রোমান কবি ও তাত্ত্বিক কুইন্টাল হোরেসিয়াস ফ্ল্যাক্কাস, যিনি মূলত হোরেস নামেই পরিচিত। আমরা জানি শিল্পের একটি অন্যতম শাখা চিত্রকলাতে স্বাভাবিকের চেয়ে একেবারে অন্যরকমের, কখনও-বা সম্পূর্ণ উল্টোপাল্টা ছবি আঁকা হয়। সাহিত্যেও অস্বাভাবিকতা বা অতিরঞ্জনপ্রিয়তা আছে। ‘আর্স পোয়েটিকা’ গ্রন্থে শিল্পীর এই ধরনের স্বাধীনতাকে নেহাতই অলস মস্তিষ্কের উদ্দেশ্যহীন কল্পনাবিলাস বলে অভিহিত করেছেন হোরেস। শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ রীতি-নীতি অনুসরণ করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেছেন। হোরেসের মতে সাহিত্য-শিল্পের প্রধান গুণ হলো— সাহিত্যিক সমীচীনতা বা শিল্পগত সমীচীনতা। এই সমীচীনতা শিল্পীর সৃজনক্ষমতার পাশাপাশি নিশ্চয়ই তার বুদ্ধি-বিবেচনার উপরে নির্ভর করে। এরিস্টটল পরবর্তী আরেকজন সমীহ-জাগানো শিল্পতাত্ত্বিক ছিলেন লঙ্গিনুস। গ্রিক এই তাত্ত্বিক সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ কেউ তাকে লুঙিনুস বা লনজাইনাসও বলেছেন। তিনি শিল্প ও শিল্পীর উৎকর্ষতার বিষয়টিকে সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকাশরীতিতে ভাবাবেগ, বাগবাহুল্য ও শিশুসুলভ ভাষা বর্জন করে সুদৃঢ় ভাবনা, আবেগগত প্রেরণা, প্রকাশরীতিতে আভিজাত্য, যথাযথ রূপকলা নির্মাণ এবং উত্তরণের সমগ্রতার দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, লঙ্গিনুসের এই পরামর্শগুলো আজকের দিনেও যে-কোনো শিল্পী ও শিল্পের জন্য প্রযোজ্য। আলেকজান্দ্রিয়ান দার্শনিক প্লাটিনাস শিল্প-সাহিত্যকে প্রজ্ঞানিরপেক্ষ সুন্দর বলেছেন। তাঁর মতে— `The beauty of the human reason is the highest.’ বস্তু নিজেই সুন্দর হয়ে ওঠে না, প্রজ্ঞায় আলোকিত আত্মার দ্বারা সৃষ্ট রূপাবয়বইে তাদেরকে সুন্দর করে নিতে হয়। তবে সাধারণ সুন্দর হোক আর প্রজ্ঞানিরপেক্ষ সুন্দর হোক, শিল্পীর যদি বাস্তব অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকে, তবে যথার্থ শিল্প হয়ে ওঠে না। শিল্পীকেও হতে হয় সাধারণের থেকে আলাদা, অভিনব ও যথেষ্ট সৃজন-ক্ষমতার অধিকারী। এজন্যে বোধধহয় কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং বলেছেন— প্রথাহীন স্বাতন্ত্র্য, সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞা এবং অভিনবত্বের অন্তর্বয়ন শিল্পীর মনোজগতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ।

কেবল পাশ্চাত্যের পণ্ডিতবৃন্দ নন, ভারতীয় শিল্পরসিকেরাও আর্ট নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন। আর্ট বা শিল্প শব্দটি তাঁদের রচনায় কাব্য বা রসসৃষ্টি কিংবা রূপসৃষ্টি ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়েছে। অগ্নিপূরাণে আছে— ‘বাগ্বৈগ্ধ্যপ্রধানপি রস এবাত্র জীবিতম্ ।- অর্থাৎ, কাব্যে বাক্যের বিচিত্রতা প্রধান হলেও রসই তার জীবন। কেউ কেউ আবার নাট্যকলা শব্দটির আলোচনায় যা বুঝিয়েছেন, তাও শিল্পকেই ইঙ্গিত করে। এমনকী সৌন্দর্যচর্চা বা নন্দনচর্চা শব্দটিও অভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত হতে পারে। আর এ-সম্পর্কিত আলোচনা আমাদের কাছে নন্দনতত্ত্ব হিসেবেই অধিক সমাদৃত হয়ে আসছে। তবে একে অনেকেই সৌন্দর্যতত্ত্ব, সৌন্দর্যশাস্ত্র, শিল্পতত্ত্ব, বীক্ষাশাস্ত্র ইত্যাদি নামেও বিশেষিত করেছেন। পৃথিবীর প্রাচীন সমৃদ্ধ ভাষার অন্যতম একটি হলো সংস্কৃত। এই সংস্কৃত ভাষাতে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন বেদসমূহ রচিত। আদি কবিখ্যাত বাল্মিকীর রামায়ণ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসদেবের মহাভারতের মতো অসাধারণ দুটো মহাকাব্যও সংস্কৃত ভাষার অসামান্য সমৃদ্ধির পরিচায়ক। এ-ভাষাতেই কালিদাস লিখেছেন মেঘদূত, কুমারসম্ভব-এর মতো কাব্যগুলো। অতএব, ভারতীয় নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনার শুরুটাও এই সংস্কৃত ভাষায়, তথা— সংস্কৃত সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু সংস্কৃতের আগেও এই ভারতবর্ষে প্রচলিত থাকা পৃথিবীর অন্যতম জীবিত প্রাচীন ভাষা তামিলেও সৌন্দর্যচর্চা এবং এ-সম্পর্কিত আলোচনার প্রাচীনতর ইতিহাস থাকতে পারে, যা এই আলোচনার অগোচরে থেকে যাচ্ছে।

শিল্প মূলত সুন্দরের সাধনা। ভারতীয় শিল্পতাত্ত্বিকদের কেউ কেউ এটাকে ব্রহ্মস্বাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ শিল্পকে মুখে ব্যাখ্যা করা যায় না, অনুভব করা যায়। শিল্পের মধ্য দিয়ে আমরা রস ও আনন্দের স্বরূপ উপলব্ধি করি। ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘নাট্যশাস্ত্র’র রচয়িতা আচার্য ভরত মনে করতেন— সমস্ত প্রকার জনগণকে আনন্দ দেওয়ার জন্যেই শিল্প বা কাব্য কিংবা নাট্যের পরিকল্পনা। আঠারো শতকে দার্শনিক কান্ট প্রবর্তিত Aestheticism বা কলাকৈবল্যবাদের ধারণা কিংবা আরও পরে গতিয়েরের ‘Art for art sake’ প্রতীতির সাথেও এর সাদৃশ্য আছে। বিখ্যাত আলঙ্কারিক ভামহ বলেছেন— ‘সাধুকাব্যসেবনম্’। উৎকৃষ্ট কাব্যসেবা ধর্ম-অর্থ, কাম-মোক্ষ এবং কীর্তি ও প্রীতি সম্পাদন করে। আচার্য দণ্ডী, যিনি ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক, শিল্পের গুণ ও ধর্মের প্রতি সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে— ‘কাব্য শোভাকরান্ ধর্মান্ অলঙ্কারান্ প্রচক্ষতে’- অর্থাৎ, যে-সকল ধর্ম কাব্যের শোভা ও সৌন্দর্য বিধায়ক, তারা অলঙ্কার বলে কথিত হয়। বামন আবার শিল্পের সৃজনপ্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন— ‘রীতিরাত্মা কাব্যস্য’, রীতিই হলো কাব্যের গুণ। তাঁর বিখ্যাত উক্তি— ‘কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ’ এবং ‘সৌন্দর্যম্ অলঙ্কারঃ’। তিনি অলঙ্কারকে যেমন কাব্যের প্রধান অনুষঙ্গ বলে উল্লেখ করেছেন, তেমনি সৌন্দর্যই যে শিল্পের অলঙ্কার সেকথাও স্বীকার করেছেন। ‘ধ্বন্যালোক’ প্রণেতা, তাত্ত্বিক আনন্দবর্ধন শিল্প-সাহিত্যের আনন্দের দিকটিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। ড. সুধীরকুমার দাশগুপ্ত বলেছেন— ‘আনন্দময় বাক্যই কাব্য।’ আর বিখ্যাত ‘রসগঙ্গাধর’-এর রচয়িতা পণ্ডিত জগন্নাথ সাহিত্যকে রমণীয় আখ্যা দিয়ে বলেছেন— ‘লোকোত্তরহ্লাদ জনক জ্ঞান গোচরতা’, অর্থাৎ রমণীয়তা হচ্ছে অলৌকিক আহ্লাদজনক ও জ্ঞানের বিষয়ীভূত হওয়ার যোগ্য। তার মানে, সাহিত্যকে রমণীয় অর্থাৎ সুন্দর বা আকর্ষণীয় বা মোহনীয় করে তুলতে হয়। কীসের মাধ্যমে রমণীয় করা যায় ? শব্দ, অর্থ, রস, গুণ, অলঙ্কার, রীতি প্রভৃতি উপকরণাদির দ্বারা সাহিত্য তার রমণীয়ত্ব প্রকাশ করে। প্রাচীন ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্র বলে— শব্দ ও অর্থ বাক্যের শরীর, রসাদি তার আত্মা, গুণ শৌর্যাদির ন্যায়, অলঙ্কার বলয় ও কুণ্ডলাদির ন্যায়, রীতি অঙ্গসংস্থানবিশেষের ন্যায়, দোষ কাণত্বাদির ন্যায়। তবে এই সবগুলোর ভেতরে রসই যে-সাহিত্যের প্রধান অনুষঙ্গ বা প্রাণ, একথা বার বার ধ্বনিত হয়েছে শিল্পরসিকদের কণ্ঠে। আর্য-অনার্যের যুগ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই রসকে সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের মতে রসই শিল্পের আত্মা, জীবন। রসশূন্য সাহিত্য, সাহিত্য নামের অযোগ্য। বিখ্যাত সংস্কৃত অলঙ্কার তাত্ত্বিক বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর ‘সাহিত্য দর্পণে’ লিখেছেন— ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’, রসাত্মক বাক্যই কাব্য। এই রস আস্বাদনের জন্য বিভাব, অনুভাব, সঞ্চারী ভাব এই তিন প্রধান ভাব ও তার প্রকাশের কথা বলেছেন। জগন্নাথ পণ্ডিতের ‘রসগঙ্গাধরে’ আছে— ‘আনন্দ বিশেষজনকং কাব্যম্।’ এই আনন্দ মূলত রস থেকেই প্রাপ্ত হয়। আচার্য দণ্ডী বলেছেন— ‘মধুরং রসবৎ বাচি বস্তুন্যাপি রসস্থিতিঃ। / যেন মাদ্যন্তি ধীমন্তে মধুনেব মধুব্রতাঃ \’— অর্থাৎ, বাক্য ও বস্তু উভয়ের ভেতরেই রস অবস্থান করে। ভ্রমরগণ যেমন মধুপানে মত্ত হয়, পণ্ডিতগণ তেমনি রসপানে প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন। দার্শনিক বেনেদেত্ত ক্রোচে সৌন্দর্যকে সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার বলে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— সত্যের যথার্থ উপলব্ধিমাত্রই আনন্দ, তা-ই চরম সৌন্দর্য। তিনি বরাবরই শিল্পের আনন্দ বা রসসৃষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন— যে শিল্পের ভিতরে রসের সন্ধান করে তাহার কাছে স্বর্গ নাই, নরকও নাই, সে দেখে সুন্দরে-অসুন্দরে এক মহাসুন্দর বর্তমান।

রস, সৌন্দর্য, কাব্য, নন্দন ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে যে-বিষয়টির চারিত্র্য বা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, তা-হলো আর্ট বা শিল্প। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের বিবিধ কথাবার্তা থেকে আর্ট-এর কিছু বৈশিষ্ট্য যে-উঠে এসেছে, সেকথা সত্য। কিন্তু সেই বৈশিষ্ট্যসমূহকে একটি সংক্ষিপ্ত ও সহজ সংজ্ঞায় পরিণত করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবু আমরা যদি উপরের আলোচনার সারবার্তা নিয়ে একটি মোটামুটি পরিপূরক সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করি তাহলে এরকম দাঁড়াতে পারে—
আর্ট এমন একটি বিষয়, মানুষের আবেগ থেকে যার জন্ম, সুন্দরের প্রতি আকাঙ্ক্ষা থেকে যার বিকাশ; সৃজনশীল মানুষের হাতে যার প্রকাশ ও উৎকর্ষতা। সৃজনশীল মানুষ কখনও স্রেফ সুন্দরের প্রতি আকাঙ্ক্ষাবশত আপন আনন্দে শিল্পের জন্ম দিয়েছেন, কখনও আবার প্রয়োজনের তাগিদে শিল্পের আশ্রয় নিয়েছেন। কোনো কোনো পণ্ডিত কেবল রসসৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠার কথা বলেছেন, কেউ আবার জীবন ও সমাজের মহৎ ও কল্যাণাকাঙ্ক্ষায় শিল্পকে কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। বাস্তবের কোনো না-কোনো জিনিস বা ঘটনাকে অনুকরণ করে শিল্পের জন্ম হয়, এরকম কথা প্লেটো ও এরিস্টটল দুজনেই বলেছেন; তবে প্লেটো যেখানে শিল্পচর্চার ভেতরে কোনো সার্থকতা খুঁজে পাননি, এরিস্টটল সেখানে শিল্পকে মানুষের মহোত্তর বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আবার হোরেস শিল্পচর্চাকে অলস মস্তিষ্কের উদ্দেশ্যহীন কল্পনাবিলাস বলে আখ্যায়িত করবার চেষ্টা করলেও প্লাটিনাস শিল্পের ভেতরে উন্নত প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়েছেন। প্রকাশরীতিতে ভাবাবেগ, বাগবাহুল্য ও শিশুসুলভ ভাষা বর্জন করে সুদৃঢ় ভাবনা, আবেগগত প্রেরণা, প্রকাশরীতিতে আভিজাত্য, যথাযথ রূপকলা নির্মাণ এবং উত্তরণের সমগ্রতার দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে লঙ্গিনুস মূলত এরিস্টটলেরই ভাবনার প্রসারণ ঘটিয়েছেন। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের অধিকাংশই যেখানে শিল্পের ভেতরে ব্যক্তিক-সামাজিক প্রয়োজন বা উদ্দেশ্যের মাহাত্ম্য প্রকাশে অধিকতর গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন, সেখানে ভারতীয় পণ্ডিতদের প্রায় সকলের কাছেই শিল্প হলো আনন্দ ও সুন্দরের উপলব্ধি এবং তার রসময় প্রকাশ।

দৃশ্যমান কোনো বস্তু বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিংবা অদৃশ্য কোনো ভাব ও ভাবনার সূত্র ধরে যখন কোনো কিছু শিল্পীর হৃদয়রসে সিক্ত হয়ে নতুনভাবে রূপায়িত হয়, নবব্যঞ্জনায় ধরা দেয়; তখন তাকে বলা হয় শিল্প। শিল্প মানব ক্রিয়াকলাপের বৈচিত্র্যপূর্ণ এক দৃশ্যরূপ, যা-শিল্পীর অনন্য সৃজনক্ষমতাকেই ধারণ করে। চারদিকে আমরা যা-দেখি, তা-শিল্প নয়; দেখা জিনিসটিকে হৃদয়ের সৌন্দর্যানুভূতি, কল্পনাশক্তি ও সৃজনপ্রতিভা দিয়ে যা-প্রকাশ করি, তা-ই শিল্প। ধরা যাক, আমি যেখানে বসে আছি, তার জানালার ওপাশের কামিনী ফুলের গাছটিতে ফুলে ফুলে ভরে গেছে, আর তার মধু-সৌরভে গুণ গুণ করছে মৌমাছিরা। দৃশ্যটি অতীব সুন্দর, কিন্তু এটাই শিল্প নয়; শিল্প হবে তখনই, যখন এই দৃশ্যটি আমার ভেতরে দৃশ্যের অতিরিক্ত কোনো অনুভূতি তৈরি করবে এবং আমি সেটাকে দৃশ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনাসহকারে চিত্রে কিংবা সঙ্গীতে অথবা সাহিত্যে প্রকাশ করতে পারবো। ভোরের আলো ফুটলেই শিউলি ফুল ঝরে যায়, সেকথা আমরা জানি; দৃশ্যটি দেখিও শরতে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন গেয়ে ওঠেন— ‘আলোকপরশে মরমে মরিয়া হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া’, তখন আমাদের ভেতরে সেই জানা বা দেখার চেয়ে অতিরিক্ত কোনো ভাবনা বা ভাবের ব্যঞ্জনা অনুভূত হয়। এটাই শিল্প। আকাশে চিল উড়তে আমরা অনেক বার দেখেছি, কিন্তু জীবনানন্দ দাশের রচনায় যখন পড়ি— ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে / তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে / তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলে মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে; / পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; / আবার তাহারে কেন ডেকে আনো ? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে / বেদনা জাগাতে ভালোবাসে ?’, তখন দৃশ্যের অতিরিক্ত এক অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনা ধ্বনিত হয় আমাদের হৃদয়ে। আমাদের চিল দেখার সমস্ত ইতিহাস ভেঙেচুরে এক নতুন ইতিহাসের আবহ তৈরি হয়। এমনকী যে-লোকটা কখনও চিল দেখেনি, চিল নামের পাখিটিকে চেনেও না, তার হৃদয়েও চিল এক অন্য রূপে, অন্য রূপানুভবে ধরা দেয়। মহৎ শিল্পের ধর্মই এই। দৃশ্যের অতিরিক্ত দৃশ্য, রূপের অতিরিক্ত রূপ আরোপ করাই শিল্পের কাজ।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে আদিম শিল্পচর্চা সম্ভবত চিত্রকলা। লিখিত ভাষার আবিষ্কার, এমনকী মৌখিক ভাষার বিকাশের আগেই ছবি আঁকার শুরু। শিল্পের অন্যান্য শাখাগুলোর মধ্যে সঙ্গীত, সাহিত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি অন্যতম মর্যাদায় অধষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের আলোচনায় অন্যগুলোর উল্লেখ থাকলেও সাহিত্যই প্রাধান্য পাবে।

৩.
Art, freedom and creativity will change society faster than politics.—Victor Pinchuk

শিল্প কেন ? শিল্পের উদ্দেশ্য কী ? এই সমাজে এসবের প্রয়োজনীয়তাই-বা কী ? এরকম নানামুখী প্রশ্নও উচ্চারিত হতে পারে কারো কারো মুখে। যে-লোকটা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত, অর্থ-সম্পত্তিই যার কাছে জীবনের প্রধান পাথেয়, তার কাছে শিল্প বলতে কেবল নানারকমের বিপনন শিল্পই গুরুত্ব পাবে; যে-লোকটা দিনমজুর, সংসারের ভরণ-পোষণেই যার জীবনের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তার কাছে এসব সৌখিন শিল্পের কোনো মূল্য থাকার কথা নয়। সমাজের আরও অজস্র মানুষের কাছেই শিল্প-সাহিত্য-ভাস্কর্য কোনোটিরই কোনো গুরুত্ব নেই। সত্যিই কি তাই ? শিল্প কি কাউকে কিছুই দিতে পারে না ? এর কি কোনো উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনীয়তা নেই ? যে-লোকটা কেবলই তার ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থ-প্রতিপত্তি নিয়ে ব্যস্ত, সেই লোকটা কি ঘরের জিনিসপত্র ক্রয়ের সময় আর্থিক লাভালাভের পাশাপাশি কোনোকিছুতে কোনো সুন্দরকে খোঁজেন না ? ফার্নিচার বানানোর সময় কাঠশিল্পীকে নিজের পছন্দের নকশাটির কথা বলে আসেন না ? কাজের অবসরে সুন্দর গান শুনে গুনগুনিয়ে তাতে কণ্ঠ মেলান না ? যে-মানুষটা একেবারে অশিক্ষিত, ধুলো-কাদা-ঘামে জীবন চালান কোনোমতে, তিনিও-তো নাটক-সিনেমা দ্যাখেন, প্রিয় গানের তালে নেচে ওঠেন। উষ্ণ স্বেদ আর ক্ষুৎ-পিপাসাক্লান্ত পথিক রাস্তার মোড়ের ভাস্কর্যটির দিকে গলা উঁচিয়ে চেয়ে বলেন— বাহ, কী সুন্দর ! তাহলে ? শিল্পের কাছে কোনো না-কোনোভাবে প্রায় সব মানুষই আসে।
তারপরও অনেকেই শিল্প-সাহিত্যকে বলেন— অপ্রয়োজনীয় জিনিস। শিল্পরসিকেরাও সেটা বলেন, একটু অন্যভাবে। ‘সাহিত্যতত্ত্ব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন— ‘বিশুদ্ধ সাহিত্য অপ্রয়োজনীয়; তার যে-রস সে অহৈতুক। মানুষ সেই দায়মুক্ত বৃহৎ অবকাশের ক্ষেত্রে কল্পনার সোনার-কাঠি-ছোঁওয়া সামগ্রীকে জাগ্রত করে জানে আপনারই সত্তায়। তার সেই অনুভবে অর্থাৎ আপনারই বিশেষ আনন্দ উপলব্ধিতে তার আনন্দ। এই আনন্দ দেওয়া ছাড়া সাহিত্যের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে জানিনে।’সংস্কৃতিবান মানুষেরা শিল্পকে বলেন— অপ্রয়োজনের প্রয়োজন। মানুষের জীবন অন্যান্য মানুষের মতো কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটিয়ে শরীরে বেঁচে থাকার জন্য নয়। তাই যদি হতো, অন্যান্য প্রাণীদের মতো আজও তারা গৃহহীন, অরণ্যচারী, অসভ্য এবং প্রকৃতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতো। কিন্তু মানুষ তার জীবনকে অন্য প্রাণীদের থেকে কেবল আলাদাই করেনি, পৃথিবীর অসীম সম্পদ ও সম্ভাবনা, এবং নিজেদের অপরিমেয় ক্ষমতা, মেধা আর অধ্যবসায়কে পুঁজি করে সম্ভব-অসম্ভবের সীমাকেই অদৃশ্য করে দিতে চেষ্টা করেছে। অন্যান্য প্রাণীর মতো কেবল জীবনকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম নয়, জীবনকে নানারূপে সজ্জিত করার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে সর্বদা। জীবনের প্রথম স্তরে বেঁচে থাকবার সংগ্রামটি পূর্ণ করেই দ্বিতীয় স্তরে সে মানবসত্তার বিবিধ সাধনায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। নিজের অপরিসীম ধৈর্য, বুদ্ধি ও পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জন করেছে শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য। নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নিজেদের হাতে নিতে সক্ষম যে-মানুষ, তার কাছে অপ্রয়োজনের প্রয়োজনও অনেক বড়ো প্রয়োজন। আর যদি অমরত্বের কথা বলি, তাহলে তো শিল্প একটি অতুলনীয় আশ্রয় হয়ে উঠেছে মানুষের জন্য। হাজার বছর আগেই হারিয়ে যাওয়া মানুষের সৃষ্ট সাহিত্য-চিত্র-ভাস্কর্য এখনও পৃথিবীর মানুষ যে উপভোগ করছে, এটা-তো তারই প্রমাণ। অতএব, শিল্প-সাহিত্যকে একেবারে অপ্রয়োজনীয় বা অপাঙ্ক্তেয় বলবার মতো মানুষ, আর যাই হোক, যথার্থ মানুষ পদবাচ্য হতে পারে না। তাছাড়া শিল্প-সাহিত্য তো সমাজছাড়া, জীবনশূন্য কোনো বিষয় নয়, সমাজের বিভিন্ন দৃশ্য ও ঘটনাকে, জীবনের বিবিধ রূপ ও রূপানুষঙ্গকে একটু ভিন্নভাবে দেখার ও দেখানোর প্রয়াস। নিজেকে এবং নিজের জানা-অজানা পরিবেশকে একটু অন্যভাবে উপভোগ করতে চাওয়া তো প্রজ্ঞানুসন্ধানী মানুষেরই কাজ।

৪.
রূপ সবার চোখেই ধরা পড়ে, কিন্তু রূপের মাধুরী তো সবার কাছে ধরা দেয় না।— অবনীন্দ্রনাথ

শিল্পের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা যে-আছে, সেকথা না-হয় বোঝা গেল, কিন্তু কতটুকু ? এই প্রশ্নে প্রধানত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায় শিল্পীসমাজ। একভাগের শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধারা বলেন, শিল্পের কোনো উদ্দেশ্য নেই— কেবল শিল্পসৃষ্টি ছাড়া। শিল্পের জন্যই শিল্প— তাদের মূলমন্ত্র। আরেকদল বলেন, কেবল শিল্পসৃষ্টিই শিল্পের উদ্দেশ্য হতে পারে না, শিল্পসৃষ্টির পিছনে থাকতে হবে মহৎ পরিকল্পনা। জীবনের উৎকর্ষতার জন্য, মানুষের মহোত্তর অবস্থানে উপনীত হওয়ার জন্য শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা থাকতে হবে। তবে এ-দুইয়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে তৃতীয় আরেকটি মত, সুন্দর-বাস্তব-কল্পনা সবকিছুকেই ধারণ করে গড়ে উঠতে পারে নান্দনিক শিল্প, মানবিক শিল্প।
সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য তত্ত্বের নাম— Aestheticism বা কলাকৈবল্যবাদ। কলাকৈবল্যবাদীরা মনে করেন— বিশুদ্ধ শিল্প উদ্দেশ্যনিরপেক্ষ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিজের সার্থকতার জন্য এর কোনো হিতবাদী বা জনকল্যাণকামী সূত্র অবলম্বন করতে হয় না। উনিশ শতকের শেষদিকে জার্মান দার্শনিক কান্টের `purposiveness without purpose’, উদ্দেশ্যহীন উদ্দেশ্য— প্রবচনটির সূত্র ধরে ফ্রান্সে একটি কলাকৈবল্যবাদী আন্দেলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের শ্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফরাসি কবি-নাট্যকার-শিল্পসমালোচক থিয়োফিল গতিয়েরের একটি উক্তি— I’art pour I’art, ইংরেজিতে যা `Art For art’s sake’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। গতিয়ের মনে করতেন— আর্টের সঙ্গে উপযোগের কোনো সম্পর্ক নেই, শিল্পকলা হবে সর্বপ্রকার উপযোগিতাবার্জিত। প্রয়োজনের জগতে যার মূল্য সর্বাধিক, তা অসুন্দর— এই ছিলো তাঁর মত। গতিয়েরের সুরেই যেন সুর মিলিয়েছিলেন অ্যাডগার এলান পো, আর্থার সাইমনস্, বোদলেয়ার, ফ্লবেয়ার, মালার্মে, ভালেরি, অস্কার ওয়াইল্ড প্রমুখ কবি-শিল্পীরা। এলান পো বলেন— `I make beauty the province of the poem, simply because it is an obvious rule of Art that effects should be made to spring as directly as possible from Their causes.’ অস্কার ওয়াইল্ড মনে করেন— প্রকৃত শিল্পী, তাঁর শিল্পকর্মে রূপায়বয়বহীন জীবনকে রূপায়িত করেন। তাঁর মতে, শিল্প জীবনকে নয়, জীবনই শিল্পকে অনুকরণ করে। আর শিল্প অনুসরণ করে সুন্দরকে। সুন্দরের রূপায়ণের মধ্য দিয়ে সবকিছুকে উদ্ভাসিত করে শিল্প। সৌন্দর্যকে তিনি বলেছেন— `Symbol of symbols’. চূড়ান্ত স্বতন্ত্রবাদীর মতো ঘোষণা করেছেন— `All art is useless’ অভিন্ন মতানুসারী আরেক তাত্ত্বিক ক্লাইভ বেল শিল্পকে Significant form আখ্যা দিয়ে এর হিতকারিতা-অহিতকারিতার প্রশ্নকে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করেছেন। বিশ-শতকের কবি এজরা পাউন্ডও কবি ও কবিতার সাথে সমাজের চাহিদাকে অস্বীকার করেছেন। প্রায় সমসাময়িক কবি টি এস এলিয়ট বলেছেন— শিল্প হিসেবে সার্থক হওয়া ছাড়া শিল্পের আর কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।
ভারতীয় শিল্পরসিক ও নন্দনতাত্ত্বিকদের অধিকাংশেরই মত শিল্পের হিতবাদিতা বা সমাজসংশ্লিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যের বিপক্ষে। বিশ্বনাথ কবিরাজ, জগন্নাথ পণ্ডিত, আচার্য দণ্ডী প্রমুখ তাত্ত্বিকবৃন্দ পাশ্চাত্যের কলাকৈবল্যবাদী আন্দোলনের বহু আগেই কলাকৈবল্যবাদ প্রকাশ করেছেন তাঁদের শিল্পালোচনায়। কেউ বলেছেন— শিল্প কেবল আনন্দের জন্য, কেউ বলেছেন— শিল্প শুধু সুন্দরের জন্য; কেউ রসসৃষ্টিকেই শিল্পের প্রধান উদ্দেশ্য বলে অভিহিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যশিল্পীদের ভেতরেও শিল্পের জন্য শিল্প বা সুন্দরের জন্য শিল্প ভাবনার মানুষ আছেন। রবীন্দ্রনাথ তো শিল্পের কোনো উদ্দেশ্য থাকা উচিৎ, এমন কথা বিশ্বাস করতেন না। ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে লিখেছেন— ‘বিষয় থাক না থাকে তো নাই থাক, সাহিত্যের তাহাতে কিছু আসে যায় না।’ তিনি মনে করতেন বিষয় বিশুদ্ধ সাহিত্যের প্রাণ নয়। প্রকৃত সাহিত্যের ভেতর থেকে উদ্দেশ্য টেনে বের করতে গেলে সেই সাহিত্যের প্রতি সুবিচার করা হয় না। রবীন্দ্রনাথ বিশেষ নয়, নির্বিশেষে বিশ্বাসী মানুষ। শরীরের সর্বাঙ্গ মিলিয়ে যেমন প্রাণের বিকাশ, সাহিত্যেরও সবটুকু মিলিয়েই সাহিত্য; এর থেকে আলাদাভাবে প্রাণটাকে বের করতে গেলে সমগ্রটাই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। অতএব, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য না-খুঁজে সমগ্রটাকে অনুভব করতে হয়। কবি বলেন— ‘গঙ্গার প্রশান্ত ভাব কেবল অনুভব করা যায়— কিন্তু কোনো উপায়ে ডাঙায় তোলা যায় না।’ তার মানে, সাহিত্যের কোনো উদ্দেশ্যই কি মানতেন না রবীন্দ্রনাথ ? একেবারেই মানতেন না বললে তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রতিও অবিচার করা হয়। তিনি মনে করতেন— সাহিত্যের যদি কোনো উদ্দেশ্য থাকে, সে-হলো সৌন্দর্য ও আনন্দের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করা। হৃদয়বৃত্তিই সাহিত্যের গম্য, নীতি-বুদ্ধি তার সহায়কমাত্র। এই হৃদয়বৃত্তির কারণে শক্তিমত্তার বিচারে সবচেয়ে দুর্বল ও কোমল হওয়া সত্তে¡ও সৌন্দর্য সবার উপরে স্থান করে নিয়েছে। রবিঋণের সাহায্যেই একে বলা যায়— ‘সে কাড়িয়া লয় না, আনন্দ দান করিয়া যায়, লোকের প্রাণ আপনি অবশ হয়। মানবসভ্যতার উচ্চতম শিক্ষাই এই— প্রেমের দ্বারা দুর্বলভাবে পশুবলের উপর জয়লাভ’। তাঁর কবিতায়ও ধ্বনিত হয় হৃদয় জয়ের সুর — ‘জীবনে জীবন যোগ করা / না-হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।’ বলেছেন— ‘সেটা সত্য হোক, / শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না-ভোলায় চোখ।’ অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কাছে বাস্তবসত্য আর শিল্পসত্য এক ছিলো না। সাহিত্যের সত্যের বেলায় তিনি রোম্যান্টিক কবি জন কিটসের `Beauty is truth, truth is beauty- thats is all’, এই নীতির সমর্থক ছিলেন। এই সত্য যে-বাস্তবের নয়, রূপের সত্য বা সাহিত্যের সত্য, এই কথাটি অনুধাবন করতে না-পারলে উভয়কবির মর্মবাণীকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা থেকে যায়। ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘কাব্যে এই ট্রুথ রূপের ট্রুথ, তথ্যের ট্রুথ নয়। কাব্যের রূপ যদি ট্রুথ-রূপে অত্যন্ত প্রতীতিযোগ্য না-হয় তাহলে তথ্যের আদালতে সে অনিন্দনীয় প্রমাণিত হলেও কাব্যের দরবারে সে নিন্দিত হবে।’ আবারও রবি কবির শরণ নিয়েই বিষয়টিকে সরল করবার চেষ্টা করতে পারি। ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় নারদ-বাল্মীকির কথোপকথনে নারদের বয়ানে কবি বলেছেন—
সেই সত্য, যা রচিবে তুমি
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোদ্ধার চেয়ে সত্য জেনো।
বাস্তবের হুবহু বর্ণনা যে কাব্যের সত্য বা রূপের সত্য নয়, ইতিহাসের ঘটনাই অবিকল তুলে ধরা যে-সাহিত্যের কাজ নয়; এ-সত্য যে কবি বা শিল্পীর নিজস্ব সৃজনক্ষমতার দ্বারা প্রসূত এক নান্দনিক সত্য, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও শিল্প-আলোচক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শিল্পের জন্য শিল্প তথা আনন্দ ও সুন্দরের জন্যই শিল্প-সাহিত্যের চর্চাকে সমর্থন করেছেন। শিল্পকে তিনি কোথাও কোথাও ‘রূপ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। শিল্পীকে বলেছেন রূপদক্ষ। রূপের ভেদাভেদজ্ঞান ও রহস্য প্রকাশ করা রূপদক্ষের কাজ বলে মনে করতেন তিনি। রসের স্পর্শে রূপকে মুক্তি দেওয়াতেই রূপদক্ষের আনন্দ ও চরম সার্থকতা। তাঁর ‘বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী’তে বিস্তৃত আলেচনা করেছেন শিল্পের বিবিধ বিষয়-আশয় নিয়ে। ‘অসুন্দর’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আর্ট যা তা সুন্দর ও সত্য, ভাণ যা তা অসুন্দর ও অসত্য। আর্ট বস্তু ও ভাবের সত্যটাই প্রকাশ করে, যা ভাণ তা শুধু বাইরের জিনিসটা দিয়ে ধোঁকা দিয়ে যায়।’ রবীন্দ্রপরবর্তী প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার কথা’য় লিখেছেন— ‘কবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায়; জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মূষিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মতো ম্লান না করে যেন আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের শাদা রৌদ্রের মতো;— সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ পায়।’ আবার ‘কেন লিখি’গদ্যে জানিয়েছেন— ‘কবিতার উপর বাস্তবিক কোনো ভার নেই। কারো নির্দেশ পালন করবার রীতি নেই কবিমানসের ভিতর, কিংবা তার সৃষ্ট কবিতায়।’ তিনিও যে শিল্পের সুন্দর ও সত্যে বিশ্বাসী ছিলেন, আনন্দ ও রসাস্বাদনের অনুগামী ছিলেন, উপরিউক্ত বক্তব্যে তা অনুমান করা যায়।

৫.
সত্যের যথার্থ উপলব্ধিমাত্রই আনন্দ, তাহাই চরম সৌন্দর্য।— রবীন্দ্রনাথ

রাশিয়ান সাহিত্যিক নিকোলাই গোগোল মনে করতেন— সাহিত্য হচ্ছে বাস্তবতার বিশ্বস্ত রূপায়ণ। গোগোল ছাড়াও আরও একাধিক রাশিয়ান লেখক একথা বিশ্বাস করে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তলস্তয় নিজেও মনে করতেন না যে— সৌন্দর্যই শিল্পের প্রাণ। তিনি মনে করতেন সাহিত্যের ভেতরে যে-সুন্দরের অবস্থান, তার মূলে আছে বাসনার তাড়না, আর বাসনাকে জয় করতে পারলেই সাহিত্য নিয়ে আসতে পারে মঙ্গলের সম্ভাবনা। মিশেল ফুকো মনে করেন— শিল্পকে হয়ে উঠতে হবে শিল্পীর অভিজ্ঞতার আকর। তিনি সাহিত্য ও শিল্পকে অভিজাত্যের গণ্ডি থেকে মুক্তি দিয়ে সকল শ্রেণির মানুষের সৌন্দর্যচর্চার অন্তভূক্ত করার কথা বলেছেন।
বাংলা উপন্যাসের পুরোধা বঙ্কিমচন্দ্রও সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ হিসেবে আখ্যা দিয়ে সেখানে জনকল্যাণমুখী, স্বজাতির মঙ্গলকামী সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও শিল্পীর স্বাধীনতা বলতে বাস্তবকেই তুলে ধরবার স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে গোগোল যে-অর্থে বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তলস্তয় হয়তো ঠিক সে-অর্থে বলেননি। আবার বঙ্কিম যে-অর্থে সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ হতে বলেছেন মানিক বন্দোপাধ্যায় সে-অর্থে বলেননি। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের স্বাধীনতা হয়তো-বা বঙ্কিম-মানিকের অবস্থানের মাঝামাঝি অবস্থানের। মানিক যে-রাজনৈতিক মতবাদে আাস্থাশীল ছিলেন, সেই মার্ক্সবাদ তো সাহিত্যকে বুর্জোয়া ও রোম্যান্টিক প্রভাবের বাইরে নিয়ে আসার পক্ষপাতীই বলা যায়; যা-মানিকপূর্ব বাঙালি সাহিত্যিকদের ভেতরে তেমন প্রষ্ফুটিত নয়। মার্ক্সবাদী সাহিত্যিক ও তাত্ত্বিকদের অনেকেই সাহিত্যকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার করতে চেয়েছেন। সাহিত্য যদিও সমাজের উপরিকাঠামো, তবু এটি সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। বাংলা সাহিত্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, দীনেশ দাস, সতীনাথ ভাদুড়ী, সোমেন চন্দ প্রমুখ মার্ক্সবাদী সাহিত্যিকবৃন্দ সাহিত্যে সময়ের বাস্তবতাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে বস্তুবাদী সাহিত্যের উজ্জ্বল নমুনা রেখে গেছেন। মার্ক্সবাদ মনে করে মানুষের অন্য সমস্ত অনুভূতির ন্যায় সৌন্দানুভূতিও নির্ভর করে সমাজে শ্রম ও উৎপাদন পদ্ধতির ওপর, শাসক ও শোষিতের সম্পর্কের ওপর। তবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মার্ক্সবাদ কিংবা আমজনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উৎকট সাম্যবাদী চেতনা প্রকাশ করতে গেলে সাহিত্যকর্ম যে-তার শিল্পমূল্য হারিয়ে কেবল রাজনৈতিক প্রচারের মুখপত্র হয়ে পড়ে, সেই উদাহরণও ইতিহাসে আছে। আবার দলীয় মতবাদকে সমর্থন করে তাকে আরও উৎকৃষ্টতর পর্যায়ে উন্নীত করবার প্রয়াসে সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে সেই দলেরই বিরাগভাজন হতে হয়, তারও নমুনা পাওয়া যায়। বিশ্বখ্যাত রুশ সাহিত্যিক বরিস পাস্তারনাক ‘ডা. জিভাগো’ লিখেছিলেন তৎকালীন রাশিয়ান কম্যুনিস্ট দলের নীতি-পদ্ধতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন, এই ভেবে। কিন্তু বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি উল্টো সমালোচনার শিকার হন তীব্রভাবে। বাংলা সাহিত্যেও একটা সময় এহেন উদগ্রতা প্রচার করতে গিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্যকে বুর্জোয়া ও পরিত্যাজ্য হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন দু-একজন। কিন্তু যে মার্ক্সবাদকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে কোনো কোনো সাহিত্যিক রাজনৈতকি উগ্রতা দেখিয়েছেন, সেই মার্ক্সবাদের যিনি ¯্রষ্টা সেই কার্ল মার্ক্স এবং তাঁর সহযোগী বন্ধু এঙ্গেলস কি এহেন কার্যকলাপ সমর্থন করতেন ? যতুদূর জানা যায় মার্ক্স- এঙ্গেলস দুজনই শিল্প-সাহিত্যের সমঝদার ছিলেন। তাঁরা চাইতেন যে শিল্প-সাহিত্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশ পাক। কিন্তু সেই আদর্শ যদি শিল্পের আদর্শকে ক্ষুণ্ন করে, সুন্দরের বিকাশকে ব্যাহত করে হোক, তা সমর্থন করতেন না তাঁরা। ১৮৫১ সালে ‘নিউইয়র্ক ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লেখকদের এই প্রচারক ভূমিকার নিন্দা জানিয়েছিলেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। ১৮৮৫ সালের একটি চিঠিতেও লেখকের খোলাখুলি রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের বিপক্ষে কথা বলেন এঙ্গেলস। মার্ক্স নিজেও শিল্প-সাহিত্যের ভেতরে নান্দনিক আনন্দ খুঁজেছেন এবং সময়ের সমস্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে সৃষ্ট চিরায়ত সাহিত্যের প্রশংসা করেছেন। গ্রিক মহাকাব্য কিংবা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি-রাফায়েল-মাইকেল এঞ্জেলার শিল্পকর্মগুলো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে থেকেও যে অসামান্য সব সৃষ্টি হয়ে উঠেছে, একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন মার্ক্স-এঙ্গেলস। মার্ক্সবাদ কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক দর্শন, যেটাই হোক, সাহিত্যে সেটা থাকা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেছেন কেউ কেউ। বিখ্যাত ইতালিয়ান লেখক ইতালো ক্যালভিনো এই মতাবলম্বীদের একজন। তিনি মনে করেন— সাহিত্য থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা বাদ দিলে তা-কেবল সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য হয়। তবে রাজনীতির সঙ্গে লেখকের দূরদর্শিতা, মানসিক দৃঢ়তা ও যুক্তিনিষ্ঠতা, নান্দনিকতা ও সুন্দর পরিকল্পনা থাকটা জরুরি। কিন্তু সত্যিই কি রাজনৈতিক শিক্ষা কিংবা কোনো ধরাবাঁধা নীতিচেতনা খুব জরুরি ? আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কিন্তু তা মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন— নীতিচেতনা সকলেরই আছে। কিন্তু সেই নীতিচেতনা কীভাবে কাজ করবে, এ-ব্যাপারে কারো বাঁধাধরা নিয়ম থাকা উচিৎ নয়। রাজনীতিমনস্ক কোনো লেখকের লেখা যদি টিকে যায়, তাহলে সেই লেখা পাঠ করবার সময় রাজনৈতিক মতাদর্শের অংশটুকু এড়িয়ে যেতে বলেছেন হেমিংওয়ে। এর অর্থ দাঁড়ায়, লেখক-পাঠক উভয়কেই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে সাহিত্যের কাছে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি।
আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান বিখ্যাত সাহিত্যিক টনি মরিসন বলেছেন— সেই রাজনৈতিক শিল্পই প্রকৃত শিল্প যা কি না প্রশ্নাতীতভাবে পক্ষপাতহীন এবং একই সাথে অসম্ভব সুন্দর। মরিসনের এই রাজনৈতিক গণ্ডীবদ্ধতাহীন রাজনীতিমনস্কতা বোধহয় পাঠকের জন্য, পৃথিবীর জন্য অধিকতর মঙ্গলদায়ী। গুন্টার গ্রাস যে মনে করতেন— পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে সাহিত্যের একটি কার্যকরী ভূমিকা আছে, সেটা বোধকরি এরূপ গুণাবলির কারণেই। বস্তুত, শিল্পের ভেতরে রাজনীতি থাকলেও তাকে সার্থক শিল্প হয়ে ওঠার গুণাবলিসম্পন্ন হতে হবে, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও তা শরীরের ত্বকের নিচে শিরা-উপশিরার মতো অনিবার্য কিন্তু অস্পষ্টভাবে থাকা উচিৎ, এমনভাবে বলা যায়।

৬.
A thing of beauty is joy forever.—Keats

নিছক সৌন্দর্যবাদ বা মার্ক্সবাদের বাইরেও সাহিত্যজগতে অনেক মতবাদ জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছে বিভিন্ন সময়ে। কোনো কোনো সাহিত্য আবার কোনো মতবাদ ছাড়াই বিকশিত হয়েছে শিল্পীর কল্পনা ও সৃজনজগতের রূপ-রস লাভ করে; পরে ক্লাসিক বা ধ্রুপদি, রোম্যান্টিক, ন্যাচেরালিস্টিক বা যথাস্থিতবাদী, নারীবাদী, অস্তিত্ববাদী, মনঃসমীক্ষণবাদী, বাস্তববাদী, পরাবাস্তববাদী, আধুনিকতাবাদী, উত্তরাধুনিকতাবাদী, উত্তর-উপনিবেশিকতাবাদী প্রভৃতি উপাধি ধারণ করেছে। তবে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা উচিৎ, কোনো প্রকৃত সাহিত্য নির্দিষ্ট কোনো মতবাদকে প্রকাশ করে না, তোয়াক্কাও করে না; কিন্তু অবলীলাক্রমে সেইসব সাহিত্যে ওইসব মতবাদের উপাদান থেকে যেতে পারে। লেখকের প্রবণতা অনুসারে কোনো কোনো মতবাদের আধিক্য বা প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে— এই যা। একজন লেখকের একটি লেখায় হয়তো রোম্যান্টিসিজম প্রাধান্য পেতে পারে, কিন্তু বাস্তববাদিতাকে অস্বীকার করে তো নয়। বাস্তববাদিতা আসে প্রধানত শিল্পী যে-সময়ে, যে-সমাজে বসবাস করেন, সেখান থেকে। আর নিজের সমাজ ও সময়কে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো শিল্পীর থাকতে পারে না। এবং অধিকাংশ শিল্পীই যে তা এড়িয়ে যান না, বরং তাঁর সমাজ ও সময়কেই তিনি রূপায়িত করেন নানারূপে ও ভাবনায়, তা-তাঁদের কীর্তির দিকে তাকালেই অনুধাবন করা যায়। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন— ‘বড়ো লেখকরা সকলেই একদিকে যেমন চিরন্তন, তেমনি অন্যদিক থেকে সমকালীন, স্বীয় সময়ের আদর্শ অনুসারে আধুনিক, এমনকি— topical. সমকালীনতা লেখকদের একটা মস্ত গুণ।’ (কালের পুতুল)। সমকালিক বাস্তবতা কিংবা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সবধরনের প্রকাশেই থাকতে পারে একাধিক মতবাদের উপকরণ। বাস্তবাদিতার ভেতরে একইসঙ্গে নারীবাদ, এমনকী কলাকৈবল্যবাদেরও অস্তিত্ব থাকতে পারে। ধারণ করতে পারে ধ্রপদি সাহিত্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্য। আসলে যে-কোনো মতবাদ বা চেতনা সে-তো জীবন থেকেই প্রাপ্ত; আর সাহিত্যও সেই জীবন থেকেই প্রসূত। উইলিয়াম ফকনার বলেছেন— একজন লেখক শুধু তাঁর শিল্পকর্মের কাছে দায়বদ্ধ; সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্যসৃষ্টিই তার দায়। আমরাও মনে করি, এই দায়টুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারলে কোনো মতবাদের দরকার হয় না। সুতরাং সাহিত্যে সুনির্দিষ্ট কোনো মতবাদকে প্রাধান্য না-দিয়ে বরং জীবন ও তার সৌন্দর্যভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
`The Mother’ (MATb) বা ‘মা’উপন্যাসটি বিশ্বসাহিত্যের এক মহান সৃষ্টি। সেখানে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের ছোঁয়া স্পষ্ট, কিন্তু তা-এমন যে মহৎ শিল্পের গুণাবলি বিস্মৃত হয় না কোনোভাবেই। ‘ম-র স্রষ্টা ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন— মহৎ শিল্পীদের রচনায় বাস্তবতা ও রোম্যান্টিকতা একইসঙ্গে মিশে থাকে। কথাটি যে-কতো বড়ো সত্য, যে-কোনো কালজয়ী সৃষ্টিকর্মের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। রোম্যান্টিক জিনিসটি আসে মানুষের কল্পনাপ্রবণতা থেকে। কল্পনাশক্তি ব্যতীত কোনো কিছু সৃষ্টি করা কি সম্ভব ? অবনীন্দ্রনাথ কল্পনাকে ‘শিল্পের প্রাণ’ বলেছেন। তাঁর মতে— ‘মানুষের সমস্ত কাজে, কর্মে, সাহিত্যে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে কল্পনাটা প্রথম, তারপর বাস্তব।’প্রকৃতপক্ষে, বাস্তবের জগৎ হলো সসীম বা সীমাবদ্ধ এক বিদ্যমান জগৎ, আর কল্পনার জগৎ হলো অসীম অবিদ্যমান একটি জগৎ। শিল্পীর মনের যে কল্পনা, তা এমন অতুলনীয় যে, হাওয়ার মতো তা অদৃশ্য ও হালকা, কিন্তু বিশ্বের ভার সে ধারণ করতে সক্ষম। বিজ্ঞানের যে অপূর্ব সব আবিষ্কার, মানুষের অপরিসীম কল্পনা ব্যতীত সম্ভব ছিলো কি ? কল্পনাশক্তিতে যিনি যতো বেশি স্বতন্ত্র ও গভীরতাস্পর্শী, তার সৃষ্টি ততো বেশি আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী। বাল্মীকি-হোমার-বেদব্যাস-কালিদাস-শেক্সপিয়র-রবীন্দ্রনাথ-তলস্তয়-গ্যেটে-ওয়ার্ডসওয়ার্থ-শেলি-কিট্স-জীবনানন্দ প্রমুখ কালজয়ী সাহিত্যিকদের সকলেই কল্পনাশক্তিতে যে অসাধারণ শক্তিমত্তার অধিকারী ছিলেন, সে-তো তাদের রচনাবলিতেই প্রমাণিত। এঁদের মধ্যে বাল্মীকি-হোমার-বেদব্যাস-কালিদাস ভাবাবেগের আতিশয্যে বাস্তবতাকে অসম্ভবতার পর্যায়ে নিয়ে গেলেও তাদের শেকড়ও ছিলো বাস্তবের মাটিতেই। আর সমাজবাস্তবতাকে যারা প্রাধান্য দিয়ে মানবকল্যাণে ব্রতী হতে চেয়েছেন, তারাও তো বাস্তবের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছেন অসাধারণ সব স্বপ্ন-কল্পনাকে। বাস্তব ঘটনাকে হুবহু রূপায়িত করা প্রকৃত শিল্পের কাজ নয়, বাস্তবতার সাথে কল্পনা ও সৌন্দর্যের অনন্য সমন্বয়ের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে প্রকৃত শিল্পকর্ম। ‘মেঘদূত’-এর যক্ষের শাস্তি পাওয়াটা বাস্তব, কিন্তু সেই শাস্তির সূত্র ধরে নির্বাসিত যক্ষ যখন আষাঢ়ের মেঘকে দূত বানিয়ে অলোকাপুরিতে থাকা প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে বিরহকাতর পত্র লেখে, তখন সেটা কল্পনা এবং কল্পনার সাথে সৌন্দর্যের এক অপূর্ব সমন্বয়। এটাই শিল্প। এটাই সৌন্দর্য-রস। রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’র মতোই অনন্ত-যৌবন নিয়ে সে বাস্তব আর কল্পনার অপরূপ আবিষ্কার। বাস্তবের সাথে কল্পনার সমন্বয়ে কী অপরূপ শিল্পরস সৃষ্টি হতে পারে তার অনেক উদাহরণ আছে রবীন্দ্র কবিতায়। শুধু যদি ‘শা-জাহান’ কবিতাটির কথা বলি, তাজমহলের মতো অনন্য স্থাপত্যকে উপজীব্য করে লিখিত এই কবিতার পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাসের বাস্তবতাকে অতিক্রম করে রোম্যান্টিকতার আবহ আর জীবন-দর্শনের অনিন্দ্য সমন্বয়ে ব্যক্তিক থেকে নৈর্ব্যক্তিক, সীমা থেকে অসীমের দিকে উত্তরণের এক অতুলনীয় বাস্তবতার মেলবন্ধন। কবিতায় যখন পড়ি—
হায় ওরে মানবহৃদয়,
বার বার
কারো পানে ফিরে চাহিবার
নাই যে সময়,
নাই নাই।
জীবনের খরস্রোতে ভাসিছ সদাই
ভুবনের ঘাটে ঘাটে—
এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য হাটে।
তখন মনে হয় হয়, এটা আর ব্যক্তিগত নেই, কোনো একজন সম্রাটে আবদ্ধ নেই। শা-জাহান কিংবা তাজমহল, তাদের প্রেম, সবকিছু থেকে বের হয়ে এক অমোঘ বাণীমালা উচ্চারণ করলেন কবি; যে-বাণীর রস আস্বাদন করতে গেলে কবিতার নাম কী, কাকে নিয়ে লেখা, এসবের কিছুই দরকার হয় না। সমস্ত সীমা ও সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে নিজে যেমন, তেমনি পাঠককেও ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকে, সীমা থেকে অসীমের দিকে নিয়ে গেলেন। এক অনন্ত হাহাকারকে অপরূপ শব্দব্যঞ্জনায় ধ্বনিত করে, পাঠককে সময় থেকে সময়ান্তরের নিরুদ্দেশ পথে নিয়ে মহাকালের বুকে একেবারে আছড়ে ফেললেন। স¤্রাট শা-জাহানের যেমন তাজমহল, তেমনি রবীন্দ্রনাথের বেলাতেও শা-জাহান কবিতাটি কবির একটি তাজমহলের মতোই, ছন্দ-শব্দ-ব্যঞ্জনায় অমরত্বের কাব্যসুষমা; ‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’রূপে তা টিকে থাকে কাল থেকে কালান্তরের পাঠকের অন্তরে। ‘পোস্টমাস্টার’, ‘একরাত্রি’র মতো গল্পের শেষেও এরকম অনির্বচনীয় শিল্পসুষমার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এটাই মহৎ শিল্পের সার্থকতা। সীমার মাঝে অসীম, কালের ভেতরে মহাকাল, বিশেষের মাঝখানে নির্বিশেষকে অবলীলায় প্রবেশ করিয়ে দিয়ে এক অপরূপ শিল্পভুবন গড়ে তোলেন মহান সাহিত্যিকবৃন্দ। আর সেই শিল্পভুবনের বাসিন্দারূপে প্রকৃত পাঠক উপলব্ধি করেন জীবনের এক অভূতপূর্ব নান্দনিকতার স্বাদ। বলা যায়, শিল্পীই এই উপলব্ধিটি অর্জন করিয়ে দেন পাঠককে। এই অর্জন করিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষাকেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ তুলনা করেছেন হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের, জীবনের সাথে জীবনের যোগ করিয়ে দেওয়া। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কেন লিখি’তে জানিয়েছেন— ‘জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি।… সকলের সঙ্গে আমার জানার এক শব্দার্থক ব্যাপক সমভিত্তি আছে। তাকে আশ্রয় করে আমার খানিকটা উপলব্ধি অন্যকে দান করি।’এই উপলব্ধির জন্যই পাঠক প্রকৃত সাহিত্যের কাছে যান। আবার ওই যে— হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ, সেই যোগাযোগটা ঘটাতে গিয়ে শিল্পী যখন তাঁর নিজস্ব সৃজনী-ক্ষমতার দ্বারা বিদ্যমান দৃশ্য বা জগতের বাইরে এক অবিদ্যমান দৃশ্য বা জগতের সন্ধান দেন, অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনা অনুভব করিয়ে দেন, এটাকে যদি রূপের ভেতরে অরূপের সন্ধান দেওয়া বলি, হয়তো সঠিক বলা হয়। রূপের সঙ্গে রূপাতীতের এই বন্ধন, সসীমের সাথে অসীমের এই সম্পর্ক, মহৎ শিল্পের মর্মকথা।

৭.
জনম অবধি হাম রূপ নেহারিনু
নয়ন না তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু
তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।
— বিদ্যাপতি

শিল্প এরকমই। মুহূর্তের প্রকাশে সে অনন্তকালের ব্যঞ্জনা দেয়। মানব মনের সুন্দরতম অনুভূতির সূক্ষ্মতম প্রতিধ্বনি হলো শিল্প। স্থূলদৃশ্য কোনো বিষয়কেও সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনায় বিকশিত করা তার কাজ। শিল্পের পরিসর ছোটো, সংস্কৃত পণ্ডিত যাকে বলেছেন— ‘নালমতিবিস্তরেণ’, কিন্তু এর পরিব্যাপ্তি বৃহৎ। ক্ষুদ্রের মাঝেই বৃহত্তরকে ধারণ করে সে, সীমার মাঝে অসীমের সন্ধান দেয়; বিন্দুর ভেতরে সিন্ধুর আস্বাদন দান করে পাঠককে। সেখানেই তার সৌন্দর্য ও বিশেষত্ব।
হোর্হে লুইস বোর্হেসের ‘আর্স-পোয়েটিকা কবিতার শেষ দুটি স্তবক পাঠ করলে অনুভব করা যায় শিল্পের বিশেষত্বকে কোথায়–
ইউলিসিস, যে-বীর ক্লান্ত দেখে-দেখে চোখ-ধাঁধানো বিষয়
মোছেন চোখের জল ভালোবেসে, দেখেই ইথাকা,
শ্যামল ও সাধারণ। শিল্প সেই সামান্য ইথাকা,
শ্যামলিমা অনন্ত কালের, নয় চোখ-ধাঁধানো বিষয়।

শিল্প সে নদীর মতো, যার শেষ নেই কোনো,
বয়ে যায়, সেই সঙ্গে থেকে যায়, যে আয়না সেই একই
হেরাক্লিটাসের, স্থিত নন যিনি। সব সময় তো একই,
এবং অন্য একই সঙ্গে, সে নদীরই মতো, যার শেষ নেই কোনো।

[ডব্লিউ এম মারউইনের ইংরেজি তর্জমা থেকে বঙ্গানুবাদ : মনজুরে মওলা]

শিল্প সেই অনিঃশেষপ্রবাহ নদীর মতো, যে-বয়ে চলে চিরকাল ধরে; ‘শিল্প সেই সামান্য ইথাকা’, যা অনন্তকালের শ্যামলিমা ধারণ করতে সক্ষম তার ছোট্ট শরীরে। এখানে এসে প্রাচ্য-প্রতীচ্য এক হয়ে যায়। আর্স-পোয়েটিকার অনন্তের সঙ্গে মিলে যায় আর্য-শিল্পের অরূপের সন্ধান। রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে— ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ-রতন আশা করি’,— প্রকৃত পাঠক শিল্প-সাহিত্যের রূপসাগরে আসলে অরূপ-রতনেরই সন্ধান করেন। এবং সেই অরূপের সন্ধান পাইয়ে দেওয়াতেই শিল্প ও শিল্পীর সার্থকতা। সেখানে কলাকৈবল্যবাদ প্রাধান্য পেলো, না কি রাজনৈতিক কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হলো কিংবা বিশেষ কোনো আন্দোলনের স্বরূপ ফুটে উঠলো, অথবা শিল্পীর নিজের সময়ের বিশেষ সংকট ও সম্ভাবনা জায়গা করে নিলো;— তা-কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। মনে রাখা দরকার, শিল্পীর রুচি ও আকাঙ্ক্ষাভেদে পথ ও পাথেয় ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তার গন্তব্য এক ও অভিন্ন— সুন্দর ও সত্যের উদ্বোধন, রূপ ও অরূপের মেলবন্ধন।

Pin It