ঈদ বাজারে বাবুরহাটে দীর্ঘশ্বাস

download

ঈদকে ঘিরে মাসখানেক আগে থেকেই জমজমাট হয়ে উঠত বেচাকেনা, পাইকারি ক্রেতাদের চাপে যেন দম ফেলার ফুরসৎ থাকত না, কিন্তু এবারের রোজার ঈদের আর দুই সপ্তাহ হাতে থাকলেও পুরনো সেই চেহারা নেই দেশে পাইকারি কাপড়ের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে পরিচিত নরসিংদীর শেখের চড়ের বাবুরহাটে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেচাকেনায় গতি না আসায় রোজা শুরুর আগে সুতার দাম মিল থেকে কমিয়ে দিলে থান কাপড়ে গজ প্রতি ১০ টাকা কমে আসে। এরপরও বেচাকেনার ভরা মৌসুমে আগের মত ক্রেতা পাচ্ছেন না তারা।

বাজারে পাইকারি ক্রেতা কমে গিয়ে বেচা-কেনায় গতি হারানোকে স্থানীয় ভাষায় ‘দম’ বলছেন বাবুরহাটের রাম কৃষ্ণ সাহা কালেকশনের বিক্রয়কর্মী রাকিব হাসান।

তার ভাষায়, “ব্যবসা ‘দম’ মেরে গেছে। এমনটি এর আগে কখনও দেখা যায়নি।”

মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক দেশের অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন রাকিব বলেন, “আমি ওড়না সেকশনে কাজ করি। রোজায় আমাদের বেশি সেল (বিক্রি) হওয়ার কথা। কিন্তু গতবারের তুলনায় এবার অনেক কমেছে।

“কম করে হলেও চার আনা (২৫ শতাংশ) কমে গেছে। পাইকাররা তেমন আসছে না। এমন সময় মার্কেট ভরা থাকত, পা-ফেলতে পারতেন না। এখন দেখেন চাপ নেই।”

কোভিড মহামারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে এগোতে শুরু করলে আমদানির চাপে পড়ে দেশের অর্থনীতি। আমদানি খরচ বাড়লেও রপ্তানি আয় সেভাবে না বাড়ায় অস্থির হতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার।

ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ও বৈদেশিক বিনিময় হারজনিত চাপে থাকা অর্থনীতিতে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির পারদ এখন ৯ শতাংশ পার করে দুই অঙ্কে উঠেছে। এতে মানুষের ব্যয় বেড়ে গেলেও সমানুপাতিকভাবে আয় বৃদ্ধি পায়নি। তাতে কমে গেছে ক্রয় সক্ষমতা।

সেই মূল্যস্ফীতির আঁচ পড়েছে এবারের ঈদুল ফিতরের নতুন পোশাকের বাজারেও। উচ্চ বিত্তদের সেই ধাক্কা সামলানো সহজ হলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা কাটছাঁট করছেন সব ধরনের ব্যয়ে, যার প্রভাব পড়ছে কেনাকাটায়।

ঈদের মধ্যেও সরগরম হয়নি বাবুরহাট

বাবুরহাটের অবস্থান নরসিংদীর সদর উপজেলার শিলমান্দি ইউনিয়নের শেখেরচরে। পুরো নাম শেখেরচর বাবুরহাট। কথিত আছে, এই অঞ্চলের জমিদার আশু বাবু গত তিরিশের দশকে মাধবদীতে একটি হাট বা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু কোনো কারণে তার ভাই কালী বাবুর সঙ্গে তার ঝগড়া হলে কালী বাবু, প্রমথ বাবু ও গোপাল বাবু শেখেরচরে বাবুরহাট প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প সময়েই নতুন বাবুরহাট বড় বাজার হয়ে ওঠে। আর সেই থেকে এটিই বাবুরহাট নামেই পরিচিতি পায়। গত শতকের ত্রিশের দশক থেকেই বস্ত্র শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এই এলাকায় রয়েছে বি.এল প্রিন্ট শাড়ি, জনি প্রিন্ট শাড়ি, পাকিজা প্রিন্ট শাড়ি, এটিএম লুঙ্গি, আমানত শাহ লুঙ্গি ও স্মার্ট লুঙ্গির কারখানা ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য কাপড়ের কারখানা। নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর কাপড়ের কারখানাগুলোর পণ্যের বেশিরভাগই বিক্রি হয়ে আসছে বাবুরহাটের মাধ্যমে। শাড়ি, থ্রি-পিস, লুঙ্গি, থানকাপড়, পপলিন কাপড়, ভয়েল কাপড়, জর্জেট, জাপানি সিল্ক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানি, কাতানসহ মসলিন কাপড়ও বিক্রি হয় সেখানে। রয়েছে হোম টেক্সটাইলের পণ্যও। ঢাকার ফ্যাশন হাউসগুলোর বড় চাহিদা মিটিয়ে থাকে সেখানকার কারখানাগুলো। এছাড়া ঢাকার ইসলামপুরের থান কাপড়ের প্রায় পুরোটাই জোগান দেয় বাবুরহাট। একসময় বাবুরহাটে কেবল রোববারে হাট বসলেও এখন বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারে হাট বসে। সপ্তাহের অন্যদিন সড়কের পাশে থাকা দোকানে সামান্য বেচাকেনা হয় বাজার বসিয়ে।

বাবুরহাটে ৫ হাজারের বেশি দোকানে প্রতি হাটে ২ হাজার কোটি টাকার মতো বেচাকেনা হলেও ঈদ মৌসুমে তা চার-পাঁচগুণ বেড়ে যায় বলে জানান বাবুরহাট বণিক সমিতির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন আহমেদ।

ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার যে কথা অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তার প্রভাব পড়ার কথা বলেছেন বাবুরহাটের ব্যবসায়ীরাও।

৩৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাবুরহাটে বিভিন্ন দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করে আসা আব্দুল মালেক এক দশক ধরে এলবি ক্লোথ স্টোরে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন।

“বাবুরহাটে প্রধানত নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষের পোশাক ও কাপড় বিক্রি হয়। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিক ও মার্চের শুরু দিকে এক মাস বিক্রি ভালো ছিল। রোজা শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি কমে যাওয়ায় সুতার দাম কমাইছিল মিল মালিকরা। তাতে পাইকারি রেটেও থান কাপড়ের প্রতি গজে কমপক্ষে ২ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

“এর পরের সপ্তাহে একটু বিক্রি ভালো হইছে। আমরা ভাবছিলাম বিক্রি বাড়বো। কিন্তু রোজা শুরু হওয়ার পরপরই বিক্রি কমে আমার অর্ধেকে নামছে। আর মাত্র দুইটা হাট আছে ঈদের আগে। কী হয় জানি না।”

আগের একই সময়ের তুলনায় এবার বাবুরহাটে বিক্রি চার ভাগের একভাগ কমে গেছে বলে মনে করেন মডার্ন ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক তাপস রায়।

“এই সময়ে দোকানে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশের কোনো সুযোগ ছিল না। ঠাসাঠাসি থাকত পাইকারের চাপে। এখন দ্যাখেন কত ফাঁকা। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি।”

১৩ জন পাইকার মিলে আড়াই লাখ টাকার মালামাল কিনেছেন তার দোকান থেকে। সেগুলো একটি ভ্যানে বোঝাই করে পাঠানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন দোকানের তিন কর্মী।

সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে তাপস বলেন, আগের মতো কেনাকাটা হলে এই ব্যবসায়ীদের অন্তত তিনটি ভ্যান লাগত।

গত বছরের রোজার মাস ও আগের এক মাস মিলিয়ে দুই মাস পুরোদমে ব্যবসা করতে পেরেছিলেন শ্রী-লক্ষী বস্ত্রালয়ের মালিক অসিত সাহা।

“এবার ব্যবসা গত ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছে। আর ব্যবসা হয়নি। একে তো দাম বেড়েছে। তারপর সুতার দাম এই বাড়ছে, আবার কমছে। এখানে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ব্যবসা কিছু লোকের কাছে চলে গেছে।

“সুতার দাম বৃদ্ধিতে ২০০ টাকার পণ্যটি এখন তিনশ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আর থান কাপড়ের প্রতি থানে কমপক্ষে ২০০ টাকা করে দাম বেড়েছে।”

অসিত সাহা বলেন, “নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের পুরুষরা লুঙ্গি পড়বেনই। অনেকে কমপক্ষে ঈদে নতুন একটি লুঙ্গি কিনে নামাজ পড়তে যান। কিনতু এবার লুঙ্গি বিক্রি হচ্ছে অনেক কম।”

কম দামি যে শাড়ি ও লুঙ্গি জাকাত হিসেবে বিতরণের জন্য বিত্তবানরা কেনেন, সেই পণ্য বিক্রয়েও ভাটার টান দেখছেন অসিত সাহা।

“দাম বৃদ্ধিতে তারা হয়ত পণ্য দিয়ে সামাল দিতে পারবেন না। নগদ টাকা দিয়ে দিবেন।”

লুঙ্গি ও ছাপা শাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ার কথা জানান আফতাব এন্টারপ্রাইজের বিক্রয়কর্মী মাসুদুর রহমান নোমান। গত আট বছর ধরে পাইকারি লুঙ্গি বিক্রেতা এ প্রতিষ্ঠানের কর্মী বলেন, “প্রতি চার পিস লুঙ্গিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দাম বাড়ছে সুতার কারণে।”

আফতাব এন্টারপ্রাইজে সর্বনিম্ন দরের চার পিস লুঙ্গি এখন ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গতবার যা বিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকায়। আর এবার সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকায় যে চারটি লুঙ্গি বিক্রি হচ্ছে, গতবার তা বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ২০০ টাকায়।

বিক্রি কমে যাওয়ার কথা বলেছেন ইত্যাদি স্টোরের বিক্রেতা জাবেদ আলমও। ঢাকার উত্তরা থেকে তার দোকানে লুঙ্গি কিনতে এসেছিলেন রিকশা গ্যারেজ মালিক জসিম উদ্দিন। গ্যারেজে থাকা রিকশাচালকদের প্রতিবছর ঈদে নতুন লুঙ্গি উপহার দেন তিনি।

“ঈদের দিনে একটা নতুন কিছু না দিলে কেমনে চলে। তারা ও তো আশায় থাকে। এবার ৩৬ জনকে লুঙ্গি দেব।”

বিক্রেতা জাবেদ আলম বলেন, “আগে দর-দাম বা কথা কওনের সুযোগ থাকত না। একবারই দাম কইতাম আর বিল বানাইতাম।

“এখন গ্রাহকদের বুঝাতে হয়। পণ্য কিনতে ডাকতে হয়। এই যে আপনের লগে কথা কইছি, আগের মতো হইলে চান্সই পাইতেন না কথা কওনের।”

তবে বাবুরহাটে বিক্রি কমার মত ঘটনার ব্যতিক্রমও দেখা গেছে আমানত শাহ এর বিক্রয় কেন্দ্রে। উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে ব্যবস্থাপক নূরে আলম  বলেন, “মূলত শবে বরাতের রাত থেকে আমাদের বিক্রি বাড়তে শুরু করে। এবারও পণ্যর দাম কিছুটা বাড়লেও বিক্রি আশাব্যঞ্জক।”

আমানত শাহ থেকে সাড়ে ৫০০ পিস লুঙ্গি ও ৪৫০ পিস শাড়ি কিনেছেন ঢাকার ধানমন্ডি থেকে আসা আলম। উপহারের জন্য সেগুলো কেনার কথা জানিয়ে বলেন, “কিছুটা সাশ্রয় করতে এ হাটে আসা।”

পুরো বাবুরহাট ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি ক্রেতার চাপ খুব একটা নেই। অনেক দোকানের কর্মী অলস সময় পার করছেন মোবাইলে ভিডিও গেম খেলে। কেউ বা বসে আছেন ক্রেতার পানে চেয়ে।

এবার পুরুষদের পোশাক বিক্রি বেশি কমেছে জানিয়ে মোহনীনি বস্ত্রালয়ের সেন্টু মিয়া বলেন, “সবার কাপড় বিক্রি কমলেও পুরুষদের বেশি কমেছে। যা বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে মেয়েদেরই বেশি। বিক্রি কম হওয়ায় মেয়েদের পোশাক ও গজ কাপড়ের দামও কমেছে রোজার শুরুতে। তারপরও বিক্রি বাড়ছে না।”

বাবুর হাটে পণ্য কিনতে এসেছিলেন টাঙ্গাইলের সাগরদিঘি এলাকার মমতাজ উদ্দিন। নিজের এলাকা থেকে নিয়ে আসা ছোট পিক-আপ ভ্যানে পণ্য বোঝাই করছিলেন শ্রমিক দিয়ে।

তিনি বলেন, “আগের কিছু মাল এখনও আছে। নতুন মাল নিতে আসলাম। যদি বিক্রি শেষ হয় তাহলে ঈদের আগে আবার আসা লাগব।”

বাবুরহাটে বেশি ভিড় দেখা যায় ওড়না, ছাপা শাড়ি, থ্রি-পিসের দোকানে। ঢাকা বস্ত্রালয়ে থ্রি-পিস কিনতে আসা কিশোরগঞ্জের কালিহাতির ব্যবসায়ী কামরুজ্জমান বলেন, “৩০০ থেকে ৩ হাজার টাকা দামের থ্রি-পিস আছে। এবার দামি পোশাক কম চলছে, তাই ৫০০ টাকা দামের চেয়ে নিচের দরের পোশাকই কিনছি।”

বাবুরহাট থেকে কেনা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ী। এক বা একাধিক ব্যবসায়ীর পণ্য একটি ট্রাকে বোঝাই শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন এসব ব্যবসায়ীরা। এতে দুই-তিন দিনও লেগে যায় কোনো ট্রাক বোঝাই করতে।

নির্দিষ্ট জেলার বা একই পথের পণ্য পরিবহনের জন্য একটি ট্রাকই ব্যবহার করা হয়। সেই ট্রাকে করেই পাইকারি পণ্য ক্রেতার কাছে চলে যায়।

ট্রাকে মালামাল পরিবহন প্রতিষ্ঠান মেসার্স বাকি সিদ্দিক এর কর্মী নয়ন মিয়া বলেন, “আগে সপ্তাহে সাত-আটটা ট্রাক লাগত। এখন তা অর্ধেকে নেমেছে।”

বিক্রি যে কমে গেছে, সেই কথা জানিয়ে বাবুরহাট বণিক সমিতির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফের ডটকমকে বলেন, “বাজারে ঘুরলে দেখা যায়, গতবারের চেয়ে বাজারে বিক্রি একটু নিচের দিকে। বিশ্ব পরিস্থিতি তো ভালো না। মানুষ আগে খাবে তারপর কিনবে।”

Pin It