কাউন্সিলর মিজানের বাসায় মিলল ৭ কোটি টাকার চেক

K-Mizan-samakal-5da0a371c1586

চলমান ‘শুদ্ধি’ অভিযানে গ্রেফতার ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানের মোহাম্মদপুরের বাসায় ও অফিসে অভিযান চালিয়ে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক ও এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে শুক্রবার ভোরে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থেকে তাকে র‌্যাব-২-এর একটি দল গ্রেফতার করে। পরে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিজানকে নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তার বাসায় ও অফিসে অভিযান চালায় র‌্যাব। গ্রেফতারের সময়ে তার কাছে পাওয়া গেছে নগদ দুই লাখ টাকা, অস্ত্র ও গুলি।

প্রাথমিক তদন্তে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, হাবিবুর রহমান মিজান পালিয়ে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন। এজন্য বৃহস্পতিবার তিনি ব্যাংক থেকে ৬৮ লাখ টাকা তুলে লাপাত্তা হন। তবে র‌্যাবের বিশেষ একটি দল তার পিছু নেয়। জনপ্রতিনিধিত্বের বাইরে সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা না থাকলেও মিজান এতো টাকা কোথায় পেলেন- সে বিষয়ে অনুসন্ধান করছে র‌্যাব। কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, দেশের বাইরেও বিভিন্ন রাষ্ট্রে তার অন্তত ১৫টি বাড়ি রয়েছে।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজান মোহাম্মদপুর এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। এর আগে তিনি ওই থানায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। স্থানীয় লোকজন তাকে ‘পাগলা মিজান’ নামেই চেনে। শুক্রবার তাকে গ্রেফতারের পর অভিযানের মধ্যেই মোহাম্মদপুর এলাকায় কয়েকশ লোক তার বিরুদ্ধে মিছিল করে স্লোগান দেন।

র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানের বিরুদ্ধে হত্যা ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাব এসব নথি পর্যালোচনা করছে। এছাড়া মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে সুর্নিদিষ্ট অভিযোগও আছে।

র‌্যাব সদস্যরা ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডে মিজানের বাসা ও অফিসে অভিযান চালান। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে শ্রীমঙ্গল থেকে আটক করার সময়ে চারটি গুলিভর্তি একটি পিস্তল ও নগদ দুই লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। ব্যাংক থেকে তোলা ৬৮ লাখ টাকা তিনি কোথায় রেখেছেন সে বিষয়ে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

মোহাম্মদপুরের ত্রাস: দুর্নীতি-সন্ত্রাস-ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন মিজান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। গ্রেফতার হওয়ার পর স্থানীয় লোকজন আনন্দ মিছিল করার পাশাপাশি তার অপকর্মের কথাও বলছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, মোহাম্মদপুর এলাকায় জমিদখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও বিহারী ক্যাম্পের মাদক, বিদ্যুৎ ও অবৈধ গ্যাসের লাইনের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। নানা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবকে তিনি এসব ক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুর এলাকায় একজন মুক্তিযোদ্ধা ও তার স্ত্রীকে তুচ্ছ ঘটনায় শত শত মানুষের সামনে জুতাপেটা করেন মিজান। তার অপকর্মের কথা কেউ মুখে বললেই নিজের বাহিনী দিয়ে নির্যাতন শুরু করতেন। মোহাম্মদপুর এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতা ও পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা তার কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তার ব্যাপারে নীরব থাকায় তিনি সাধারণ কাউকে পাত্তা দিতেন না। অপরাধ করেও তিনি এবং তার লোকজন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন।

চলমান অভিযানের মধ্যেও মিজানের অপকর্ম থামছিল না। গত ৫ অক্টোবর বিদ্যুৎ বিভাগ বিহারী ক্যাম্পে ৩২ কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া হওয়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে তিনি বিহারীদের উস্কে দেন। ওই ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে ইউনুস হত্যা, ২০১৬ সালে একটি জোড়া খুনের মামলায় তার নাম জড়িয়ে রয়েছে।

লোকমুখে যেভাবে তিনি ‘পাগলা মিজান’: কথিত আছে, কয়েক দশক আগে একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে পুকুরে নেমেছিলেন মিজান। পরে গ্রেফতার এড়াতে পরনের পোশাক খুলে রেখে তিনি পুকুর থেকে উঠে আসেন, পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন। সেই থেকে লোকজন তাকে ‘পাগলা মিজান’ হিসেবে চেনেন।

স্থানীয়রা বলছেন, এক সময়ে সিটি কর্পোরেশনের ম্যানহোলের ঢাকানা চুরি করতেন এই মিজান। এরপর গড়েছিলেন ছিনতাইকারী গ্রুপ। রাজনীতির ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে পুরো মোহাম্মদপুরের অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণই চলে আসে তার কাছে। নেতা থেকে হয়ে যান জনপ্রতিনিধিও।

কারো কারো মতে, মিজান আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী। এক সময়ে ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা হত্যা চেষ্টার আসামিও ছিলেন তিনি। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

Pin It