ক্রিসেন্ট লেদারের সেই কাদের গ্রেফতার

Untitled-10-5c51f90dd8478

প্রায় এক হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে বহুল আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী ক্রিসেন্ট লেদারের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরকে গতকাল বুধবার গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে তার নিয়ন্ত্রণাধীন তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনস্থ শুল্ক্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর গতকাল এ মামলা করে। এনবিআরের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলন করে এ খবর জানান। ক্রিসেন্ট লেদারের চেয়ারম্যান রফতানি না করেও সরকারি জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে আসে। এরপর থেকেই নানাভাবে সমালোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো।

শুল্ক্ক গোয়েন্দারা জানান, ক্রিসেন্টের তিন প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে মোট ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা পাচার করেছে। এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিলেছে। বিকেলে রাজধানী ঢাকার চকবাজার মডেল থানায় শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বাদী হয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে পৃথক এ মামলা করে। অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানগুলো রফতানির আড়ালে অবৈধ পন্থায় দেশ থেকে টাকা পাচার করেছে। এনবিআরের দাবি, তদন্তে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ মিলেছে।

শুল্ক্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর বলছে, এম এ কাদেরের প্রতিষ্ঠান ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড ৪২২ কোটি ৪৬ লাখ, রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড ৪৮১ কোটি ২৬ লাখ ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ লিমিটেড ১৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা পাচার করেছে। মোট টাকার পরিমাণ ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ। অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।

এই অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকায় শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধিত ২০১৫) অনুযায়ী রিমেক্স ফুটওয়্যার লি.-এর চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিটুল জাহান (মিরা) এবং অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লি. ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ লি.-এর চেয়ারম্যান এম এ কাদের এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতানা বেগম (মনি) ও জনতা ব্যাংক লি.-এর সংশ্নিষ্ট ১৩ কর্মকর্তাকে আসামি করে ৩০ জানুয়ারি ঢাকার চকবাজার মডেল থানায় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছে। মামলা নম্বর যথাক্রমে-৫৪, ৫৫ ও ৫৬। মামলা নম্বর ৫৪ ও ৫৬-এর অন্যতম আসামি ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লি. ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ লি.-এর চেয়ারম্যান এম এ কাদেরকে বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কাকরাইল থেকে শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর আটক করেছে।

ক্রিসেন্ট গ্রুপকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ বের করে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ায় জনতা ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও গতকাল মামলা করেছে শুল্ক্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। তারা হলেন- জনতা ব্যাংকের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ( ডিএমডি) জাকির হোসেন, জনতা ব্যাংকের তৎকালীন জিএম বর্তমানে কৃষিব্যাংকের ডিএমডি ফখরুল আলম, জনতা ব্যাংকের বর্তমান জিএম রেজাউল করিম, একই ব্যাংকের বর্তমান ডিজিএম কাজী রইস উদ্দিন আহমেদ, কে এম আসাদুজ্জামান, মো. ইকবাল, এজিএম মো আতাউর রহমান সরকার, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মগরেব আলী, মো.খায়রুল আমিন, প্রিন্সিপাল অফিসার মো. রহুল আমিন, সিনিয়র অফিসার আব্দুল্লা আল মামুন, মনিরুজ্জামান ও মো.সাইদুজ্জাহান।

গতকাল বিকেলে সেগুনবাগিচায় রাজস্ব ভবন মিলনায়তনে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আরও ১০ থেকে ১২ প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আরও মামলা হবে। তদন্ত শেষে গণমাধ্যমে বাকি প্রতিষ্ঠানের নামও প্রকাশ করা হবে।

এদিকে, অর্থ পাচারকারীদের কঠোর বার্তা দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, যারা এ কাজে জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, এদের সঙ্গে আপস করা হবে না।

তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, মাদক ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এনবিআর, দুদক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে কাজ করছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআইর সর্বশেষে প্রতিবেদনে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, টাকার অঙ্ক কমবেশি হতে পারে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ টাকা চলে যাচ্ছে অবৈধ উপায়ে। এ অবস্থায় বসে থাকা যায় না। সে জন্য পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুদক ও এনবিআর যৌথভাবে কাজ করছে। আমাদের বার্তা পরিস্কার, যারা টাকা পাচার করবে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে সরকার।

ক্রিসেন্টের অর্থ জালিয়াতি :লেদার রফতানি না করেও নগদ সহায়তা নেওয়াসহ নানা জালিয়াতি করে জনতা ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ায় ব্যাংক খাতে ব্যাপক সমালোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ। সুদসহ গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্রিসেন্টের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে তিন হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। যার পুরোটাই খেলাপি। নানা উপায়ে বের করে নেওয়া এসব অর্থের একটি অংশ পাচার ছাড়াও সাভার, হাজারীবাগসহ ঢাকার আশপাশে জমি কেনার তথ্য পেয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বিক্রির জন্য জনতা ব্যাংক দু’দফা নিলাম ডেকেও তা বিক্রি করতে পারেনি। মূলত সম্পদ মূল্যের তুলনায় ব্যাংকের কয়েকগুণ বেশি পাওনা এবং উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে নিলাম কার্যক্রম স্থগিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে এসব ঋণ ব্যাংকটির লোকাল অফিসে স্থানান্তর করা হয়। অনিয়মে এমডির সম্পৃক্ততার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এলেও মামলায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, হংকংয়ে নিবন্ধিত মোট ২১টি প্রতিষ্ঠানে শুধু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার ৭২২ কোটি টাকার ভুয়া রফতানি দেখায় ক্রিসেন্ট গ্রুপ। কোনো রফতানি না করে ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করে জনতা ব্যাংক ও অডিট ফার্মের যোগসাজশে সরকারি খাতের নগদ সহায়তা নেওয়া হয়। আবার সেই ভুয়া রফতানি বিলের বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের ঋণ সুবিধা দেয় ব্যাংক। এই ২১ প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই পরিচালক বা কোম্পানি সেক্রেটারি বাংলাদেশি। আর যেসব ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানগুলো রেজিস্টার্ড দেখানো হয়েছে তার সবই অস্তিত্বহীন। ভিন্ন ভিন্ন দেশে রফতানি দেখানো হলেও অর্থ এসেছে দুবাইয়ের এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে। ফলে রফতানি না করেই নগদ সহায়তা নেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অর্থ প্রেরণ করে সে অর্থ দেশে এনে রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসন দেখানো হয়েছে।

ভুয়া রফতানি দেখিয়ে নগদ সহায়তার নামে শুধু গত অর্থবছর ৪০৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা নেয় ক্রিসেন্ট গ্রুপের ৫ প্রতিষ্ঠান। আর ২০১৩ সাল থেকে ক্রিসেন্টকে দেওয়া হয় ৭০৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছর নেওয়া নগদ সহায়তার অর্থ গত জুলাইয়ে জনতা ব্যাংকের হিসাব থেকে কেটে সরকারি কোষাগারে ফেরত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর আগে নেওয়া নগদ সহায়তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ক্রিসেন্টের এসব অনিয়ম বিষয়ে সমকালে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর মধ্যে গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘হাজার কোটি টাকা দিয়ে বিপদে জনতা ব্যাংক’ এবং একই বছরের ৫ এপ্রিল ‘ঋণের নামে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল ক্রিসেন্ট’ শিরোনামের প্রতিবেদন ছিল উল্লেখযোগ্য।

সংশ্নিষ্টরা জানান, এসব ঋণ সৃষ্টিতে কোনো নিয়ম মানেনি ব্যাংক। যে কারণে এক সময় সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত জনতা ব্যাংক এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যাগ্রস্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। এককভাবে আর কোনো ব্যাংকের এত খেলাপি ঋণ নেই। আর গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের তিন হাজার ৯২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এক সময়ে মুনাফায় থাকা ব্যাংকটি এখন বড় লোকসানে পড়েছে।

Pin It