ক্ষোভে ফুঁসছে শিক্ষার্থীরা

image-491401-1637869507

বুকে সহপাঠী হারানোর নীল-বেদনা, চোখে-মুখে ক্ষোভের আগুন নিয়ে ফুঁসছে শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর ঘটনার বিচার, সড়ক আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ ছয় দফা দাবি করেন তারা।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বর, জিরো পয়েন্ট, ফার্মগেট, শান্তিনগর মোড়ে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজপথ।

তাদের হাতে হাতে ছিল বিভিন্ন লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড। সেখানে যেসব লেখা স্থান পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ছিল-‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’, ‘পরবর্তী নাঈম কে?’, ‘নক্ষত্রগুলো রাস্তায় পিষুক, গ্রহাণুগুলো শাসন করুক’, ‘শাবাশ বাংলাদেশ পৃথিবী অবাব তাকিয়ে রয়, সড়কে মরছে মেধা তবু কারও টনক নড়ার নয়’, ‘আমার ভাই মরল কেন, সব সাথীদের খবর দে, শক্ত কঠিন দুর্গ গড়ে বেপরোয়াদের কবর দে’।

সকাল ১০টা থেকে টানা ৪টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচি চলে। বিকালে তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস।

তিনি তাদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। তবে দাবিদাওয়া বাস্তবায়ন না হলে ফের রোববার থেকে আন্দোলনে যাবেন-এমন হুঁশিয়ারি দেন তারা।

এদিকে শিক্ষার্থীরা সারা দিন রাস্তায় অবস্থানের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। আগের কয়েকদিনের মতো সপ্তাহের শেষদিনেও জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

আর গ্রেফতার হওয়া ওই গাড়ির চালককে (যিনি একজন ডিএসসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মী) বৃহস্পতিবার তিন দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।

এছড়া ডিএসসিসি থেকে অবৈধভাবে গাড়ি বরাদ্দ করে চালানোয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. হারুন মিয়া ও গাড়ি চালানোর কাজে সহযোগিতা করায় আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. আব্দুর রাজ্জাককে কর্মচ্যুত করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বুধবার সকালে রাজধানীর গুলিস্তানে ডিএসসিসির গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ঘটনার পরপরই ওইদিন মতিঝিল এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে তার সহপাঠীরা বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করে।

বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো বেলা ১১টায় তারা কলেজের সামনে জড়ো হয়। এরপর সাড়ে ১১টা নাগাদ তারা শাপলা চত্বরের সড়কে অবস্থান নেয়।

তারা সেখানে প্রকৃত আসামির গ্রেফতার এবং দ্রুত বিচার দাবি করে। সেখানে কিছু সময় অবস্থান নিয়ে পরে তারা যায় গুলিস্তানের সেই জায়গায়, যেখানে নাঈমের মৃত্যু হয়েছে।

সেখানে আরও অবস্থান নেয় কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে সেখানকার আশপাশের এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ।

এছড়া সকাল ১০টায় আরও কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ফার্মগেট এলাকায় সড়কে অবস্থান নেয়। বেলা ১১টার দিকে তারা সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়।

শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পয়েন্টে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আশপাশের সব সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বেইলি রোডের মুখে শান্তিনগরের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে।

এছাড়া গাড়িচাপায় নটর ডেম শিক্ষার্থী নাঈমের মৃত্যুর ঘটনায় উত্তরায় বিক্ষোভ করেছে সেখানকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেয়।

উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, মাইলস্টোন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক শ ছাত্র উত্তরা আজমপুর থেকে হাউজবিল্ডিং পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয়।

তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ এবং ‘হত্যা মামলার আইন চাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। একই সঙ্গে তারা নিরাপদ সড়কের দাবি তোলে। তারা বাসের ভাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক করার দাবি কার্যকর করতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

এই সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উত্তরা থেকে বনানী এবং উত্তরা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা ও আশুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়।

বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে যোগ দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী হত্যার বিচার এবং ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের জেরে পাশ হওয়া আইন বাস্তবায়নসহ ৬ দফা দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা।

দাবিগুলো হলো: সবার জন্য সড়ক নিরাপদ করা, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পর পাশ হওয়া আইন বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া, নাঈমের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে বিচার নিশ্চিত করা, নাঈমের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, গুলিস্তানের মতো ব্যস্ততম সড়কে পথচারী-সেতু স্থাপন করা ও সব ধরনের ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা।

বিকাল ৪টার দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস নগর ভবনের প্রধান ফটকে এসে দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।

মেয়র তার বক্তব্যে বলেন, ইতোমধ্যে নাঈম হত্যার সঙ্গে জড়িত গাড়িচালককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেওয়া হয়েছে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ফাঁসির দাবি উঠালে তাদের আশ্বস্ত করে তিনি নিজেও তার ফাঁসি দাবি করেন।

নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াও এ ঘটনায় যেসব কর্মকর্তার অবহেলা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন মেয়র। তাছাড়া নিহত নাঈমের নামে জিরো পয়েন্টে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের হাফ পাশ ভাড়া কার্যকর, লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ দিলে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল ও সরকারি সংস্থার গাড়ি কর্তৃক দুর্ঘটনা ঘটলে ওই সংস্থার দায়সহ শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে লিখিত দিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে উপস্থাপনের আশ্বাস দেন তিনি।

এদিকে মেয়রের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী রিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমাদের আন্দোলনে নগরবাসীর ভোগান্তির জন্য দায়ী সিটি করপোরেশন। তথাপিও নগরপিতার প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। দাবি আদায় না হলে আবারও আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

পরিচ্ছন্নতাকর্মী রিমান্ডে : নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীকে নাঈম হাসানকে গাড়িচাপা দেওয়ার মামলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাসেল খানের ৩ দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জেল হোসেন এ আদেশ দেন।

এদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার এসআই আনিছুর রহমান আসামি রাসেলকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। অপরদিকে আসামিপক্ষে রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করা হয়। জামিন শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, আসামি রাসেল সিটি করপোরেশনের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। আর এটা একটা দুর্ঘটনা। এ সময় বিচারক জানতে চান রাসেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না জবাবে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, কিছুদিন আগে তার লাইসেন্স হারিয়ে গেছে। এ বিষয়ে জিডিও করা হয়েছে। এরপর বিচারক বলেন, এটা একটা আলোচিত ঘটনা। একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কেন, কী উদ্দেশ্যে এ ঘটনা ঘটেছে, লাইসেন্স আছে কি না, তা জানার জন্য আসামির ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হলো।

আদালত সূত্র জানায়, ২৪ নভেম্বর বেলা ১১টার দিকে গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের দক্ষিণ পাশে নাঈম হাসানকে ধাক্কা দেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ট্রাক। এ সময় গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাসেল খান। পরে গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ও এলাকার টহল পুলিশ ট্রাকসহ রাসেলকে আটক করে। রাতে এ ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীর বাবা বাদী হয়ে মামলা করেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের পল্টন থানার পরিদর্শক (ট্রাফিক) মশিউর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছেন। সেই সময় যান চলাচল বন্ধ থাকে।

Pin It