চতুর্মুখী তদন্ত শুরু

100-5c7308a2b63aa

পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে একাধিক সংস্থা। এরই মধ্যে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। তথ্য চেয়ে একাধিক সংস্থাকে চিঠিও দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। কীভাবে সেখানে আগুন লেগেছে, তা তথ্য-উপাত্তের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হতে চান তারা। এখনও আগুনের সূত্রপাত নিয়ে রয়েছে নানামুখী ভাষ্য। কারও মতে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত, কারও দাবি, সিলিন্ডার থেকে। ঘটনাস্থলের আশপাশের দোকান থেকে পাওয়া সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্নেষণ করেও পরিস্কারভাবে নির্ণয় করা যাচ্ছে না আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে।

বিস্ম্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক ড. শামসুল আলম গতকাল রোববার সমকালকে বলেন, আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে তদন্তে অগ্রগতি রয়েছে। কীভাবে আগুন লেগেছে তার একটি ধারণা পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী গতকাল সকাল ১১টার দিকে চুড়িহাট্টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ম্ফোরণ ও আগুনের ঘটনায় আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্তদের বক্তব্য নিচ্ছি। সবার সঙ্গে কথা বলে এবং প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের আলোকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ বের করার চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পক্ষে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও  সংস্থাটির উপপরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দেবাশীষ বর্ধন সমকালকে বলেন, একাধিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও পরিদর্শন করা হবে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এখনও সংগ্রহ চলছে। কাজ গুছিয়ে এনে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে জমা দেওয়া হবে।

একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশন, বিস্ম্ফোরক পরিদপ্তর, রাজউক, ডিপিডিসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে জানতে চাওয়া হয় ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের প্রতিষ্ঠানের জমির মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য। এ ছাড়া ওয়াহেদ ম্যানশনের আন্ডারগ্রাউন্ডসহ বিভিন্ন তলায় কারা কীভাবে বিস্ম্ফোরকের গুদাম ভাড়া নিয়েছেন। যারা বিস্ম্ফোরকের মজুদ গড়ে তুলেছেন, তারা পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়েছেন কি-না। ঘটনার দিন চকবাজারে কোনো ট্রান্সমিটার বিস্ম্ফোরণ বা বৈদ্যুতিক কোনো গোলযোগের কারণে দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে কি-না তাও জানতে চাওয়া হয়।

তদন্ত সূত্র জানায়, এরই মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে সেলিম মোহাম্মদ মিঠু নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী সমকালকে বলেন, ঘটনার দিন ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলতে তিনি ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের গলিতে যান। ওই সময় সেখানে যানজট ছিল। একটি পিকআপে ৬-৭টি গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। হঠাৎ একটি সিলিন্ডার ছিটকে পড়ে। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

বাবুল নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে প্রায়ই কেমিক্যালের গন্ধ বেরিয়ে আসত। সেখানে ছিল নানা ধরনের দাহ্য পদার্থের গুদাম। ওই গুদামের ভেতর থেকে বিস্ম্ফোরণ ঘটে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় ছিল গ্যাভি কসমেটিকসের গুদাম। ওই গুদামের কর্ণধারকে খোঁজা হচ্ছে। এ ছাড়া একই ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে কেমিক্যালের গুদামের মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ওই মালিকের নাম শামীম। তবে ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাই সোহেল ও হাসানকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। ওয়াহেদ ম্যানশনে কেমিক্যালের গুদাম ছিল, নাকি সেখানে নকল পণ্য তৈরি করা হতো, তাও নিশ্চিত হতে চায় তদন্ত সংস্থা।

সূত্র জানায়, আগুনের উৎস নিশ্চিত হওয়ার জন্য একাধিক বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থলের আলামত পরীক্ষা করছে। ধ্বংসস্তূপে সিলিন্ডারের কোনো অংশ রয়েছে কি-না তাও খুঁজে দেখা হচ্ছে। শনিবার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের আন্ডারগ্রাউন্ডের গোডাউনের কেমিক্যাল অপসারণের কাজ শেষ না হওয়ায় গতকালও ট্রাকে করে সেগুলো সরানো হচ্ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ‘তারা নিরাপদে বাস করতে চান পুরান ঢাকায়। এ এলাকায় কোনো ধরনের রাসায়নিক গোডাউন থাকতে পারবে না। বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো পরিদর্শন করেন।

‘গাড়ি রেখে দৌড় দেই’:চুড়িহাট্টা শাহি মসজিদের পূর্ব পাশে সড়কের ওপর অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া প্রাইভেটকারটির চালক ওহাব শিকদার গতকাল ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা গাড়িটি দেখতে এসেছিলেন। পুড়ে যাওয়া গাড়ির ধ্বংসাবশেষই শুধু দেখলেন তিনি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানালেন- প্রাইভেটকারটির মালিকের নাম আমিনুল ইসলাম। ঘটনার সময় গাড়িতে মালিকের দুই আত্মীয় ছিলেন। হাজী ওয়াহেদ ভবন পার হয়ে চুড়িহাট্টা মোড়ে গাড়ি নিয়ে যানজটে আটকে যান তিনি। এর দুই-এক মিনিটের মধ্যে পেছনের দিকে বিকট শব্দ শোনেন, এর পরই আগুন। তিনি বলেন, ‘আগুন দেখে গাড়ি সামনে টানার চেষ্টা করি। এরই মধ্যে গায়ে আগুনের তাপ লাগে। মনে হচ্ছিল আগুন ছুটে আসছে। গাড়ির যাত্রীদের নেমে যেতে বলি। আমিও দ্রুত নেমে দৌড় দেই।’

পঞ্চম দিনেও উৎসুক জনতার ভিড় :ঘটনার পঞ্চম দিন গতকালও উৎসুক জনতার ভিড় ছিল ঘটনাস্থলে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দেখতে আসছেন পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলো। শাহআলীর গুদারাঘাট থেকে আসা শফিকুর রহমান নামে এক তরুণ বলেন, ‘কৌতূহল থেকে এখানে এসেছি। এত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটল, যাতে ৬৭ জন প্রাণ হারাল সেই ঘটনাস্থল দেখার কৌতূহল তো থাকবেই।’ চুড়িহাট্টার পাঁচটি গলির মুখে পুলিশ বাঁশ ও তার বেঁধে দর্শনার্থীদের ভেতরে প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করে। এর পরও উৎসুক জনতা ভেতরে ঢুকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ঘুরে দেখছিল।

শোকের ব্যানারে ছেয়ে গেছে চুড়িহাট্টা :অগ্নিকাণ্ডে ৬৭ জন প্রাণ হারানোর ঘটনায় শোক জানিয়ে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিউদ্যোগে শতাধিক ব্যানার টানানো হয়েছে চুড়িহাট্টা মোড় ও আশপাশের সড়ক ও ভবনে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতেও ঝুলছে শোকের ব্যানার। সব ব্যানারই কালো জমিনের ওপর সাদা লেখা।

Pin It