নতুন ভ্যাট আইন: চাপে পড়বে দেশীয় শিল্প ও ভোক্তাশ্রেণি

Untitled-114-5cc4af7e62a54-5cc4cc2cc6fc1

দুই বছর স্থগিত থাকার পর আগামী অর্থবছর অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। আগামী ১৩ জুন (২০১৯-২০) অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। এটি হবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট, যিনি আগের মেয়াদে পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। নতুন বাজেটে আলোচনার মূল বিষয় হতে পারে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের বিষয়টি। ব্যবসায়ীসহ সংশ্নিষ্ট মহলে আইনটি এখনই আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কারণ, আইনটির কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত। ফলে এই আইন আগামী অর্থবছর থেকে কার্যকর হবে কি-না তা নিয়ে সংশয়ও আছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এবারের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা। কারণ, ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে হবে। তবে ভোক্তা বা জনগণকে চাপে ফেলা যাবে না। এদিকে আবার বাড়তি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য অর্জন করতেই হবে। এই ত্রিমুখী চাপ সামাল দিয়ে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ এই আইনটি বাস্তবায়ন করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং দাতাদের চাপ তো আছেই। ফলে সবাইকে খুশি রেখে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে অর্থমন্ত্রীকে।

আইএমএফের চাপে ২০১২ সালে এ ভ্যাট আইন করা হয়। ব্যবসায়ীদের  বিরোধিতার কারণে আইনটি এখনও কার্যকর করতে পারেনি সরকার। ব্যবসায়ীদের মূল আপত্তি সর্বক্ষেত্রে অভিন্ন  ভ্যাটহার ১৫ শতাংশ করা নিয়ে। ফলে যথারীতি ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন বহাল রয়েছে।

এনবিআর ও বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক সূত্রে জানা যায়, এফবিসিসিআইসহ শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মতামত নিয়ে অভিন্ন বা একটি রেটের পরিবর্তে একাধিক (মাল্টিপল) রেট করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নতুন আইনে ভ্যাটের হার হবে চারটি। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ৫ এবং সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ। অন্য দুটি হচ্ছে- সাড়ে ৭ এবং ১০ শতাংশ। তবে কোন খাতে কত হার হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চলছে এনবিআর কর্মকর্তাদের। এ ছাড়া বিশেষ ছাড় দিয়ে ট্যারিফ বা নির্ধারিত মূল্যের ভিত্তিতে ভ্যাট আদায়ের দীর্ঘ সময়ের প্রচলিত প্রথা অর্থাৎ ট্যারিফ ভ্যালু পদ্ধতি বাতিল হচ্ছে। ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে নির্দিষ্ট খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ইসিআরের উন্নত সংস্করণ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস প্রবর্তন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। বিতর্কিত এককালীন থোক বা ‘প্যাকেজ ভ্যাট’ এবং সেবার কতিপয় খাতে সংকুচিত মূল্য ভিত্তিতে ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হচ্ছে। উপকরণ ব্যবহারের বিপরীতে রেয়াত (ক্রেডিট) সুবিধা রাখা হচ্ছে সীমিত আকারে। এসব পরিবর্তন সংযোজন করে নতুন ভ্যাট আইন ফের সংশোধন হচ্ছে।

ব্যবসায়ীসহ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের নতুন ভ্যাট আইনটি আদর্শিক ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ, আধুনিক ভ্যাট ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রত্যেক স্তরে রেয়াত নিশ্চিত করা। এটা না করতে পারলে ‘ট্যাক্স অন ট্যাক্স’ বা করের ওপর কর চাপানোর নিয়ম তৈরি হবে। এতে করে পণ্য ও সেবা উভয়ক্ষেত্রে দাম বাড়বে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশীয় শিল্প ও ভোক্তা তথা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আসবে।

এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, নতুন আইনে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে না। এ ছাড়া সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশসহ উল্লিখিত চারটি রেট কার্যকর হলে রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়বে না। ভ্যাট বিশেষজ্ঞরা বলেন, নামেই নতুন আইন। আসলে পুরনো পথেই হাঁটছে সরকার। তাদের মতে, একাধিক রেটের নামে নতুন যে ভ্যাট আইন করছে সরকার তা ‘নতুন বোতলে পুরনো মদের’ মতো। তাদের মতে, নতুন আইন বর্তমান ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের চেয়েও খারাপ। এর চেয়ে বিদ্যমান আইনকে আরও আধুনিকায়ন করে তা বহাল রাখাই উত্তম বলে পরামর্শ দেন তারা। জানা যায়, বিদ্যমান আইনেও ভ্যাটের একাধিক রেট আছে। তবে চলমান আইনে অনেক ক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকায় আইএমএফ একে ‘জঙ্গল আইন’ হিসেবে অভিহিত করে। এর পরিবর্তে পুরনো আইনটি বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়নের কথা বলেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটি। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে- নতুন আইনটি কার্যকরে যে ধরনের উপযুক্ত পরিবেশ দরকার, তা নিশ্চিত হয়নি এখনও। ভ্যাট বিভাগ এবং ব্যবসায়ী মহলে এ দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এনবিআর সূত্র জানায়, নতুন আইনে আরও কিছু সংশোধনী আসছে। যে সব ব্যবসায়ী বছরে ৫০ লাখ টাকা লেনদেন করবে তাদের ভ্যাটের বাইরে রাখা হবে। অর্থাৎ ভ্যাটের অব্যাহতি সীমা পঞ্চাশ লাখ টাকা, যা মূল আইনে ৩৬ লাখ টাকা আছে। ছোট ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়ার লক্ষ্যে বার্ষিক লেনদেনের সীমা বর্তমানের ৮০ লাখ টাকা থেকে উন্নীত করে ৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে এবং তাদের ‘টার্নওভার কর’ ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে যে সব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় হয়, শুধু তারাই রেয়াত পাবেন বলে নিয়ম করা হচ্ছে নতুন আইনে। এর বাইরে যারা ৫, সাড়ে ৭ এবং ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দেবেন তাদের বেলায় কোনো ধরনের রেয়াতের ব্যবস্থা থাকছে না। এ ছাড়া আমদানি ও স্থানীয় পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়ের বর্তমান নিয়ম বহাল রাখা হচ্ছে। এসব প্রস্তাবও সংযোজন করা হচ্ছে।

গত মাসের শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে নতুন আইনে একটির পরিবর্তে তিনটি রেট নির্ধারণের বিষয়ে সমঝোতা হয়। অর্থমন্ত্রী এই তিনটি রেট বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান। সূত্র জানায়, উল্লিখিত তিনটি রেট নিয়ে পর্যালেচনা করে এনবিআর। রাজস্ব বোর্ড মনে করে- ৫, সাড়ে ৭ এবং ১০ শতাংশ রেট কার্যকর হলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে ব্যাপক ধস নামবে এবং রেয়াত দেওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। এনবিআর বলেছে, রেট সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ এবং আমদানি ও স্থানীয় হারে ভ্যাটের হার একই রাখা বাঞ্ছনীয় হবে। চারটি রেটসহ এসব বিধান রেখে নতুন আইন সংশোধন করে তা কার্যকর করলে রাজস্ব আয়ে তেমন প্রভাব পড়বে না। বিষয়টি অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করা হলে তাতে সম্মতি দেন তিনি। সেই লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে এনবিআর।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য :আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা ও গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, নতুন আইনে যে সব পরিবর্তন আনা হচ্ছে,তা কার্যকর হলে এবং সর্বক্ষেত্রে রেয়াতের সুযোগ না রাখলে করের বোঝা বাড়বে। এতে করে পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশীয় শিল্পখাত। চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ। এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, প্রস্তাবিত একাধিক রেট নির্ধারণ করে নতুন আইন কার্যকর হলে তা হবে আন্তর্জাতিক উত্তম ভ্যাট ব্যবস্থার পরিপন্থি। অনুকূল পরিবেশ তৈরি না করে এই আইন বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে না। এফবিসিসিআইর সাবেক পরামর্শক মঞ্জুর আহমেদ মনে করেন, নতুন আইনে রফতানির বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।

ব্যবসায়ীরা যা বললেন: একাধিক রেটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্যোগকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি মনে করনে, কোন খাতে কত রেট বসানো হবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর ওপর নির্ভর করবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে। এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ হালকা প্রকৌশল সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে কিছুটা প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ট্যারিফ ও সংকুচিত ভিত্তিমূল্য ব্যবস্থা বাতিল হলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত অনেক পণ্যের দাম বাড়বে। একই সঙ্গে সেবা খাতে চাপ আসবে।

যে সব খাতে প্রভাব পড়তে পারে: জানা যায়, নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম উপকরণ রড, ইট; সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ওষুধ, ভোজ্যতেল, আবাসন খাতের সিআইশিট, এম এস প্রোডাক্ট, লেখার কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট, বিভিন্ন জাতের মসলাসহ এরকম প্রায় একশ’টি দেশীয় পণ্য আছে। জনস্বার্থে এসব পণ্যে বিশেষ ছাড় দিয়ে ট্যারিফ মূল্য ভিত্তিতে কম হারে ভ্যাট আদায় করা হয় বর্তমানে। নতুন আইনে ট্যারিফ ভ্যালু বাতিলের কথা বলা হচ্ছে। এর পরিবর্তে বাজার মূল্যে প্রযোজ্য হারে ওই সব পণ্য থেকে ভ্যাট আদায় করা হবে। কোনো ধরনের রেয়াত থাকছে না। এতে করে ওই সব পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং জনজীবনে চাপ আসবে। এ ছাড়া বর্তমানে সেবা খাতের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, নির্মাণ সংস্থা, আসবাব, স্বর্ণালঙ্কার, তথ্যপ্রযুক্তিসহ ষোলটি খাত রয়েছে, যেখানে মূল্য সংযোজনের ওপর বা আংশিক মূল্যের ওপর ভ্যাট আহরণ করা হয়। নতুন আইনে এই নিয়ম বাতিল করে প্রকৃত লেনদেনের ওপর ভ্যাট আরোপের কথা বলা হচ্ছে। এ নিয়ম কার্যকর হলে ওই সব সেবা খাতের খরচ বাড়বে এবং জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।

Pin It