পরীক্ষার রিপোর্ট পেতেই সপ্তাহ পার, দুর্ভোগ

image-159781-1592593871

নমুনা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে লাগে এক দিন ঠিকভাবে নমুনা না নেওয়ায় রিপোর্ট ভুল হচ্ছে  বিশেষজ্ঞদের মতামত উলটে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে

ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুরের পর নমুনা দেওয়ার সুযোগ মেলে। সেই রিপোর্ট পেতে ঢাকা শহরেই সময় লাগে অন্তত চার থেকে পাঁচ দিন। আর গ্রামগঞ্জের মানুষ কষ্ট করে জেলা শহরে গিয়ে নমুনা দেওয়ার পর এক সপ্তাহেও সেই রিপোর্ট পায় না। কোনো কোনো এলাকায় ১০ দিনও লেগে যায়। করোনা আক্রান্ত কি না, সেই পরীক্ষা করাতে গিয়ে সারাদেশে এভাবেই মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক সময়ে রিপোর্ট না পাওয়ার কারণে অনেক রোগীকে ঠিকমতো চিকিত্সা দেওয়া যাচ্ছে না। রিপোর্ট আসতে আসতেই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে সঠিক রিপোর্ট আসছে না। সকালে বলা হচ্ছে নেগেটিভ, আবার সন্ধ্যায় ফোন করে বলা হচ্ছে পজিটিভ। আবার অনেক পজিটিভ রোগীর রিপোর্ট আসছে নেগেটিভ। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ না করার কারণে রিপোর্টে ভুল আসছে। অদক্ষ লোকদের দিয়ে নমুনা নেওয়ার কারণে নমুনায় সঠিক চিত্র উঠে আসছে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্যবিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে নিতে না পারলে সঠিক রেজাল্ট আসবে না। এটা আবার আইসব্যাগে না রাখতে পারলে নষ্ট হয়ে যাবে। ডিপ ফ্রিজে রাখলে অনেক দিনেও নষ্ট হয় না। এখন কীভাবে এটা নেওয়া হচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। নমুনা নেওয়ার জন্য দক্ষ টেকনোলজিস্ট দরকার। যে কেউ চাইলেও নমুনা নিতে পারবেন না।

জানা গেছে, সারাদেশেই টেকনোলজিস্ট সংকট রয়েছে। একজন টেকনোলজিস্ট উদাহরণ দিয়ে বলেন, পুরো হবিগঞ্জে মাত্র একজন টেকনোলজিস্ট আছেন। তাহলে পুরো জেলার কাজটা কীভাবে হবে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ভিডিও কনফারেন্সে তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু মানুষকে নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠে নামানো হয়েছে। তারা আসলে সঠিকভাবে নমুনা নিতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রী ৩ হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এতদিন পরও এই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করা যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রী জরুরি ভিত্তিতে ১৮৩ জন টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে বলেন। সেটাও এখনো সম্ভব হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, নমুনা সংগ্রহের নিয়ম হলো নাকের ভেতরে একটা ওয়াল আছে যেটাকে বিটিএম (পাইনক্স) বলে, সেখান থেকে নমুনা নিতে হবে। বাইরে থেকে নমুনা নিলে সঠিক রিপোর্ট আসবে না। এক্ষেত্রে টেস্টে ভুল হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি থাকে। তিনি বলেন, এখন আমরা যে পর্যায়ে আছি, তাতে জেলা নয়, উপজেলা পর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল রিপোর্টের আরেকটি কারণ হচ্ছে নিম্নমানের কিট। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে যে কিট সাপ্লাই দেওয়া হয়েছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড়ও ওঠে। তারা বলছেন, করোনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দিয়েছেন, তাতে প্রতিটি উপজেলায় পিসিআর মেশিন বসানো সম্ভব ছিল। শুধু আমলাদের জটিলতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। এমনকি জেলা পর্যায়েও সব জায়গায় সেটা বসানো যায়নি। দ্রুত এই ব্যবস্থাটা করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, এর আগে বহুবার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু আমলাদের বিরোধিতা ও সিন্ডিকেটের ভাগাভাগির কারণে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগ চালাবেন চিকিত্সকরা। কিন্তু এটা চালাচ্ছেন আমলারা। আমলাদের বোঝাতে বোঝাতেই দিন চলে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সিন্ডিকেট তো আছে। মাস্ক কেলেঙ্কারির পরও এটা থামেনি। নিয়ম অনুযায়ী এখন তো আমলাদের বিরুদ্ধে দুদক সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফলে আমলারাও বেপরোয়া।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা টেকনিক্যাল কমিটি থেকে যে প্রস্তাব দেই, সেটার আসলে বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানে একটা সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। শুধু জেলা শহর নয়, যেসব উপজেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের অবকাঠামো ভালো, সেখানেও পিসিআর মেশিন বসিয়ে টেস্ট বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্যবিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির অন্য এক সদস্য বলেন, টেকনিক্যাল কমিটি থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়, মন্ত্রণালয়ে আমলারা সেটা কাটছাঁট করেন। তারা কি বিশেষজ্ঞ- এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এই কারণে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা চলছে। আসলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না। এই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ হলো, দ্রুত কিটের মান বাড়াতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর সিন্ডিকেট ভেঙে কাজগুলো দ্রুত সম্পাদন করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র টেকনোলজিস্ট বলেন, পরীক্ষার কিট আর স্যাম্পল কালেশনের কিট—দুটোর মানই খারাপ। দীর্ঘদিন পিসিআর মেশিনে কাজ করা এই টেকনোলজিস্টের মতে, তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাদের মাঠে নামানো হচ্ছে, তারা কী করবে, এই তিন দিনে কী শিখবে? আমরাই এত দিন কাজ করার পর হিমশিম খাই।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘সবাই যে বলছে, আমরা তিন মাস সময় পেয়েছি, কী করলাম? আসলে এখানে প্রস্তুতির কিছু নেই। যখন যেটা প্রয়োজন তখন সেটা করতে হবে। এটাই প্রস্তুতি। এখন আমরা যেটা প্রয়োজন হচ্ছে, সেটাই করছি। চাইলেও সবকিছু রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। পিসিআর মেশিন চাইলেই আনা যায় না। জার্মানি থেকে একটা পিসিআর মেশিন এনে জামালপুরে বসিয়েছি। সেটা ঠিকমতো কাজ করছে না। এই মেশিনগুলো চালানোর মতো দক্ষ জনবলও তো প্রয়োজন।’

Pin It