পল্লবী থানায় পিটিয়ে হত্যার মামলায় তিন পুলিশের বিচার

jony-murderer-si-zahidur-rahman-090920-02

সাড়ে ছয় বছর আগে থানায় নিয়ে গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনিকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় পল্লবী থানার তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

রায়ে বলা হয়েছে, পল্লবী থানার এসআই জাহিদুর রহমান খান, এএসআই রাশেদুল ইসলাম, এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টুকে যাবজ্জীবন সাজা খাটার পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দিতে হবে, যা দিতে না পারলে আরও ছয় মাস জেল খাটতে হবে তাদের।

অর্থদণ্ড ছাড়াও নিহতের পরিবারকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আসামিদের প্রত্যেককে। ক্ষতিপূরণের এই টাকা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিবারকে দিতে হবে এবং ক্ষতিপূরণ না দিলে আপিল করা যাবে না।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশ বুধবার আলোচিত এ মামলায় রায় ঘোষণা করেন।

এ মামলার বাকি দুই আসামি পুলিশের ‘সোর্স’ রাসেল ও সুমনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে রায়ে।

বিচারক বলেছেন, ২০১৩ সালের নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে কোনো মামলায় দেশে এটাই প্রথম রায়। আর তিন পুলিশ সদস্যকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এ আইনে সেটাই সর্বোচ্চ সাজা।

রায়ের পর্যবেক্ষণে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ বলেন, “ভিকটিমের তিনজন বন্ধু এ মামলার চাক্ষুষ সাক্ষী। তারা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, নির্যাতনের সময় ভিকটিম পানি চাইলে তার মুখে থুথু ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কেবল আইনের বরখেলাপ নয়, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।”

জনির ভাই এ মামলার বাদী ইমতিয়াজ হোসেন রকি আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার রায় শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, তারা জজ আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

আসামিদের মধ্যে পল্লবী থানার তখনকার এসআই জাহিদুর রহমান খান ও পুলিশের সোর্স সুমন কারাগারে আছেন। এএসআই রাশেদুল জামিনে ছিলেন, রায়ের পর তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আর এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু এবং পুলিশের সোর্স রাসেল জামিনে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তাদের পলাতক ঘোষণা করে এই রায় দেওয়া হয়েছে।

বাদীপক্ষে এ মামলা পরিচালনা করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সাভির্সেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনজীবী আবু তৈয়ব। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কেএম সাজ্জাদুল হক শিহাব ও তাপস পাল।

ইশতিয়াক হোসেন জনি

( ইশতিয়াক হোসেন জনি )

প্রতিক্রিয়া

তিন আসামির সর্বোচ্চ সাজার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে জনির ভাই রকি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টেয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ মামলায় আপসের প্রলোভন এবং একই সঙ্গে আমাদের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল বার বার। অনেক  অভিঘাত পেরিয়ে মামলাটির রায় ঘোষণা হয়েছে। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।

“আশা করেছিলাম, এসআই জাহিদ যেন জেল থেকে বের হতে না পারে। সে আশা পূরণ হয়েছে। আমরা সবাই আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এ আইন প্রণয়ন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ধন্যবাদ। এ রায় যেন উচ্চ আদালতে বহাল থাকে, সেই আশা করছি।”

এ মামলার পলাতক আসামি পুলিশের সোর্স রাসেল এখন এলাকায় ‘মাদক ব্যবসা’ করছে এবং নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রকি।

তিনি বলেন, “তার মাদক ব্যবসার সব খবর মিরপুর ও পল্লবী থানা পুলিশ জানে, অথচ তাকে গ্রেপ্তার করছে না।”

জনির মা খুরশিদা বেগম তার বাকি দুই ছেলে-মেয়ের নিরাপত্তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

তিনি বলেন, “আমরা চাই রায় দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি। আর যেন কেউ এভাবে সন্তান না হারায়। আর যেন কাউকে এভাবে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে মেরে ফেলা না হয়।”

নিহত জনির ১১ বছরের ছেলে মুরতজা হোসেন হৃদয়ও রায়ের সময় উপস্থিত ছিল আদালতে। সেও বলেছে, এ রায় যেন বহাল থাকে।

আদালতে উপস্থিত মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী সালমা আলী বলেন, “হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের ড্রাফটিংয়ে আমরাও ছিলাম। সেখানে মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে আইন যখন পাস হয়, তখন মৃত্যুদণ্ড সরিয়ে দেওয়া হয়। আপনারা দেখবেন, প্রতিবছর পুলিশের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয় আইনটা উঠিয়ে দেওয়ার। আমরা চাই,এ আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আসুক “

এ ধরনের মামলায় সবাইকে সাহায্য করার আহ্বান জানান অ্যাডভোকেট সালমা আলী। পুলিশ হেফাজতে ঝুট ব্যবসায়ী সুজন হত্যা মামলারও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে- এই প্রত্যাশার কথাও তিনি বলেন।

অন্য্যদিকে পুলিশ সদস্য রাশেদুল হাসান ও কামরুজ্জামান মিন্টুর আইনজীবী শাহীনুল ইসলাম অনি বলেন, “এ মামলার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের দপ্তর, পুলিশ সদর দপ্তর ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয় । বাদীপক্ষের কোনো সাক্ষী আমার দুই মক্কেলকে শনাক্ত করতে পারেননি। এ বিষয়ে আমি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের আদালতে জেরা করেছিলাম। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।”

এস আই জাহিদুর রহমান খানের আইনজীবী ফারুক আহাম্মাদ বলেন, “জাহিদের দুই লাখ টাকা নেই যে সে আপিল করতে পারবে। রায়ে বলা হয়েছে, নিহতের পরিবারকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ না দিলে আপিল করা যাবে না। সে কারণে আমরা রায়দানকারী জজ আদালতে ক্ষমা ভিক্ষার আবেদন করব।”

এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ

( এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ )

মামলা বৃত্তান্ত

২০১৪ সালের ৭ অগাস্ট জনির ভাই রকি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে ‘নির্যাতন ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে’ এই মামলা দায়ের করেন।

সেখানে বলা হয়, ওই বছর ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টরে ইরানি ক্যাম্পে বিল্লাল নামে এক ব্যক্তির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান গিয়েছিলেন জনি। মামলার বাদী রকি নিজেও ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন।

অভিযোগে বলা হয়, পুলিশের সোর্স সুমন মাতাল অবস্থায় ওই অনুষ্ঠানে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করলে জনি তাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেন। তখন ঝগড়ার এক পর্যায়ে জনি চড় মারলে সুমন ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়ে চলে যান।

আধা ঘণ্টা পর এসআই জাহিদসহ কয়েকজন পুলিশ এসে ওই অনুষ্ঠান থেকে জনিকে থানায় নিয়ে যান। সেখানে তার উপর নির্যাতন চলে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।

“জনিকে পল্লবী থানার হাজতে নিয়ে এসআই জাহিদসহ অন্য আসামিরা হকিস্টিক, ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে মারধর করে এবং জনির বুকের ওপর উঠে লাফায়। জনি পানি চাইলে জাহিদ তার মুখে থুথু ছিটিয়ে দেন।”

নির্যাতনে জনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললে তাকে ঢাকা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা জানান, আগেই মৃত্যু হয়েছে জনির।

মামলায় বলা হয়, ‘নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দিতে’ আসামিরা পল্লবীর ইরানি ক্যাম্প ও রহমত ক্যাম্পের মধ্যে ‘মারামারির মিথ্যা কাহিনী’ তৈরি করেছিল। ওই মারামারিতেই রকিসহ কয়েকজন গুরুতর আহত ও জনি নিহত হন দাবি করে এসআই শোভন কুমার সাহা (আসামি) পল্লবী থানায় একটি মামলাও করেছিলেন।

পল্লবী থানার তৎকালীন ওসি জিয়াউর রহমান ওই মামলাটিকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে ‘ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নিয়ে যান’ বলে বাদীর আর্জিতে উল্লেখ করা হয়।

সে সময় আদালত রকির আর্জি শুনে এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মারুফ হোসেন ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে তিন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুই সোর্সের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়।

রকির করা মামলায় পল্লবী থানার তৎকালীন ওসি জিয়াউর রহমান, এসআই আব্দুল বাতেন, রাশেদ, শোভন কুমার সাহা, কনস্টেবল নজরুলকেও আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু বিচার বিভাগীয় তদন্তে তারা অব্যাহতি পান। তদন্তকালে পুলিশের এএসআই রাশেদুল ও কামরুজ্জামান মিন্টুকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কামরুল হোসেন মোল্লা।

এ মামলার বিচারে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৪ জন সাক্ষীর বক্তব্য শুনেছে আদালত। গত ৯ ফেব্রুয়ারি আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেওয়ার পর গত সোমবার যুক্তিতর্ক শুনানিও শেষ হয়। এরপর রায় ঘোষণার জন্য বুধবার দিন রাখেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশ।

২০১৪ সালের জুলাই মাসে ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজনকে মিরপুর থানায় নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জনি হত্যা মামলার মূল আসামি এসআই জাহিদ। হাই কোর্টের আদেশে সুজন হত্যা মামলার কার্যক্রম এখন স্থগিত রয়েছে।

Pin It